কমছে উৎপাদন সূচক, বাড়ছে শেয়ার বাজার
শেয়ার বাজার লাফিয়ে বাড়ছে। ছুঁতে চাইছে ৫০ হাজারে ঘর। দু’মাস ধরে ঊর্ধমুখী থেকে শিল্প উৎপাদন সূচক নেমেছে।খুচরো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সূচকও গোঁত্তা খেয়েছে। রাজ্যে রাজ্যে করোনা টিকা পৌঁছচ্ছে এবং দেশ জুড়ে দৈনিক করোনা আক্রান্ত রেকর্ড সংখ্যায় কমে আবার বেড়ে ১৬ হাজার ছুঁয়েছে। দুয়ারে নির্বাচন। দেশ জুড়ে চলছে কৃষক আন্দোলন।
এ বড় কঠিন সময়। উৎপাদন সূচক গোঁত্তা খেলেও শেয়ার বাজারের এতটা লাফ বোধের অগম্য। মাথায় রাখতে হবে, বাইরে থেকে যতই মনে হোক দারুণ অবস্থা, ফ্রাঙ্কলিন টেম্পলটনের ঋণপত্রের ফান্ড কিন্তু গুটিয়ে গিয়েছে কয়েক হাজার বিনিয়োগকারীর টাকাকে অনিশ্চয়তায় রেখে। কিন্তু তা অন্য প্রসঙ্গ। যেটা দেখার তা হল, অর্থনীতি জুড়ে ডামাডোল আর সূচকগুলোর অস্থির নড়াচড়া। চারদিকের আবহে অনিশ্চয়তার কুয়াশা। আর এই অনিশ্চয়তা গ্রাস করেছে বিশ্বের প্রায় সব দেশকেই।
অথচ অনেকেই ভেবেছিল ২০২১ সালে পা রেখে হয়ত গোটা বিশ্ব একটু নিঃশ্বাস নিতে পারবে। কিন্তু কোভিডের নিরন্তর খোঁচায় ২০২১ কী ভাবে কাটবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নতুন করে চেপে বসেছে। বিশ্বব্যাঙ্কের ‘গ্লোবাল ইকনমিক আউটলুক ২০২১’-এর পাতায় পাতায় সেই দুশ্চিন্তার ছবি। ব্রিটেন নতুন কোভিডের আক্রমণ থেকে বাঁচতে আবার লকডাউনকেই ঢাল করেছে। নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া বাইরে ঘোরাঘুরি করলে ২০০ পাউন্ড ফাইন। আগের সব নিষেধাজ্ঞা ফিরে এসেছে জনজীবনে। ইটালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়াও একই রাস্তায় হাঁটছে। স্পেন বলছে ভ্যাকসিন পেলেও তা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট স্বাস্থ্যকর্মীর অভাব। গ্রিস বলছে সূচের অভাবে ভ্যাকসিন দেওয়া সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন: মূল্যবৃদ্ধির স্বস্তি কাড়ল শিল্পে ফের সঙ্কোচন
আমাদের দেশেও কত দিনে সবার কাছে ভ্যাকসিন গিয়ে পৌঁছবে তার সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। সব ব্যাপারে সরকারকে দোষ দিয়ে থাকি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে, উন্নত দুনিয়ার উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সবার কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছনো নিয়ে নানান সমস্যা মাথাচাড়া দিয়েছে। মানব সভ্যতা এই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কোনওদিনই হয়নি। তবে একটা বিষয় নিশ্চিত, আজ হোক বা কাল ভ্যাকসিন পৌঁছবে সবার কাছেই। কবে পৌঁছবে? এই প্রশ্নটার উত্তর জরুরি। সরকারও বোধহয় চায় এই উত্তরটা ঠিক মতো জানতে। কিন্তু আপাতত কোভিডের কারণে গোটা বিশ্বেই বাজারের দরজা আর অবারিত নয়।
আর দুয়ারে যদি আগল পড়ে তা হলে তো পেটে টান পড়বেই। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে তাই ২০২১ ঘিরে দুশ্চিন্তার কথাই প্রতিফলিত। দীর্ঘদিন বাজার বন্ধের পরে কলকারখানা চালু হযেছে। বিশ্ব জুড়ে আর্থিক কর্মকাণ্ডও ঢিমে তালে বাড়ছে। কিন্তু বিশ্ব ব্যাঙ্ক চিন্তিত কোভিডের দীর্ঘকালীন প্রভাব নিয়ে। আর্থিক জীবনের ব্যাখ্যাটাই বদলে দিয়েছে কোভিড। গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা, সরকারি ঋণ, বাজেট পরিচালনা এবং কোভিডের চাপে ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে মেরামত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের রাস্তায় ঠিকঠাক হাঁটা, মুদ্রানীতি পরিচালনা— বিশ্ব ব্যাঙ্ক এই ক্ষেত্রগুলোকেই আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসাবে নির্দিষ্ট করেছে।
আর এই প্রেক্ষিতেই বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভয়, আবার না বিশ্ব বাজারে মন্দার সুনামি আছড়ে পড়ে! নীতি সমালোচকরা একে ফোর্থ ওয়েভ বলছেন। বিশ্ব ব্যাঙ্কও এই আশঙ্কাকে একই নামে ডাকছে। এর আগেও তিন বার ঋণের বাজারে ধসের কারণে বিশ্ব জুড়ে মন্দা হয়েছে। একটা তো এই সে দিন ২০০৬-’০৭ সালে। গোটা বিশ্বেই অতিমারির সময়ে সরকারি আর বেসরকারি ঋণের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। মাথায় রাখতে হবে, অতিমারির আগেই কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে ঋণের বোঝা যে ভাবে বাড়ছিল তাতেই ভুরু কুঁচকেছিল বিশেষজ্ঞদের। তার উপরে অতিমারির চাপে নতুন ঋণের বোঝা সামলাতে যে স্তরের নীতি স্বচ্ছতা প্রয়োজন তা থাকবে কি না সংশয়ের জায়গাটা সেখানেই।
না। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ঋণ বন্ধ করতে বলছে না। উল্টে বাজার সামলাতে যাতে ঋণ সহজলভ্য হয় তা দেখা উচিত বলেই মনে করছে। কিন্তু এখানেও জোর সেই স্বচ্ছতার উপরে। ঋণ না পেলে, বিনিয়োগ হবে না। তাই ঘুরে দাঁড়াতে নতুন ঋণের জোগান জরুরি। কিন্তু যাঁরা ইতিমধ্যেই ঋণ নিয়েছেন অথচ অতিমারির কারণে ঠিক মতো শোধ দিতে পারছেন না তাঁরা একটা দল। আর এক দল হল যাঁরা আর শোধই দিতে পারবেন না। নীতি নির্ধারকদের এখন সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ হল, এই তিন শ্রেণির ঋণগ্রহীতার কথা মাথায় রেখেই নীতি তৈরির রাস্তায় হাঁটা। আর স্বচ্ছতা বজায় রেখেই।
আরও পড়ুন: ভারতে পা রাখছে টেসলা, কর্নাটকে তৈরি হচ্ছে বিশাল কারখানা
সরকারি ঋণ সামলানোর কৌশল আর বেসরকারি ঋণ সামলানোর কৌশল এক হতে পারে না। কিন্তু দুই ক্ষেত্রেই নজরদারির একটা প্রশ্ন থেকে যায় বইকি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের ভয়ের জায়গাটা বোধহয় এখানেই। আর প্রশ্নের জায়াগটা বোধহয় রাজনৈতিক চাহিদা আর আর্থিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে ভারসাম্য রেখে নীতি নির্ধারকরা এগতে পারবেন কি না তা নিয়েই। সংস্কারের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনিশ্চয়তার আবহের দৃষ্টান্ত তো আমরা আমাদের দেশে দেখতেই পারছি। এই মুহূর্তে তার সব থেকে বড় উদাহরণ কৃষি সংস্কার বিল নিয়ে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলন। অথবা ভোডাফোন নিয়ে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায়কেও মেনে নিতে আপত্তি থাকা। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে কোথাও গিয়ে সেই স্বচ্ছতা ফেরাতে হবে যেখানে তারা মনে করবে যে সরকার নাগরিকের স্বার্থ রক্ষার নামে নিজের জেদ বজায় রাখতেই ব্যগ্র নয়।
আরও একটা দিক নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্ক দুশ্চিন্তার কথা প্রকাশ করেছে আর তা হল বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্য। কোভিডের সময় বিশ্ব জুড়েই আমরা দেখেছি কী ভাবে আর্থিক বৈষম্য বেড়েছে। ভারতের ক্ষেত্রেও এই বিষয়টা সাম্প্রতিক কালে বহুচর্চিত। উন্নয়নের প্রথম শর্তই হল এই বৈষম্য কমানো। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অতিমারির সময়ে এবং লকডাউন ওঠার পরেও এই বৈষম্য বাড়ছেই। এই বৃদ্ধিকে থামিয়ে উল্টো রাস্তায় হাঁটাতে না পারলে কিন্তু অশান্তি বাড়তেই থাকবে। তাতে বিনিয়োগের আবহে বিষ বাড়বে বই কমবে না আর উন্নয়নের চাকারও উল্টো দিকে গড়ানো অব্যাহত থাকব।
আসলে চ্যালেঞ্জটা এখন শুধু আর্থিক বৃদ্ধির নয়, চ্যালেঞ্জ হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য কমিয়ে আর্থিক বৃদ্ধির। বিশ্ব ব্যাঙ্কের রিপোর্টের ইঙ্গিতটা সেটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy