মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যাঁরা, তাঁদের আয় কিন্তু তাল মিলিয়ে বাড়ছে না। ফাইল চিত্র ।
শুধু আইনে লেখা অধিকার নয়। সে অধিকার কার্যকর করারও অধিকার থাকা চাই। গণতন্ত্রের মূল কথাটাই তো তাই। আর এটা বোঝার জন্য বিরাট কোনও তত্ত্ব বোঝার শিক্ষার প্রয়োজন নেই। যেমন, নিজের অধিকার রক্ষায় পুলিশের সাহায্য চাওয়ার অধিকার আপনার আছে। কিন্তু পুলিশ যদি আপনার অভিযোগ না নিতে চায়, তা হলে সেই অধিকার যে শুধু খাতায় কলমেই থেকে যায় তা-ই নয়, তা গণতান্ত্রিক কাঠামোতেও কুঠারাঘাত করে।
তা আরও ক্ষুণ্ণ হয় যখন একই অভিযোগ কোনও প্রভাবশালী করলে পুলিশ শুধু তা সঙ্গে সঙ্গে নথিবদ্ধ করে তাই নয়, তার সমাধানে ক্ষমতার বাইরে গিয়েও হস্তক্ষেপ করতে লালায়িত হয়। অর্থাৎ, তৈরি হয় আইনের বাইরে গিয়েও আর এক আইনের বলয় যার কোনও সাংবিধানিক স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও সেটাই আইন হয়ে ওঠে। আর এটা বোঝার জন্য তো কোনও বিশেষ শিক্ষার প্রয়োজন নেই। আমাদের জীবন যাপনের অভিজ্ঞতাই এটা আমাদের বলে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত।
এই একই যুক্তি কিন্তু গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় আর্থিক ব্যবস্থাতেও প্রযোজ্য। আর তাই আর্থিক নীতি আলোচকরা দারিদ্র এবং বৈষম্য নিয়ে এতটা চিন্তিত থাকেন। ব্যাপারটা একটু খোলসা করা যাক। যেমন, আপনি পয়সা থাকলে বাজারে যা পাওয়া যায় তার মধ্যে যা খুশি কিনতে পারেন। অর্থাৎ, আপনার রেস্ত আপনার কেনার অধিকারের নির্ণায়ক। এ বার ভাবুন, আজ থেকে মাত্র কয়েক বছর আগেও যা আপনার দৈনন্দিন জীবন যাপনের অঙ্গ ছিল তা এখন আপনার পকেটে ছ্যাঁকা দিচ্ছে। আর সে ছ্যাঁকা থেকে বাঁচতে পাল্লা দিয়ে কিন্তু আপনার বেতন তো বাড়ছেই না, হয়ত কমেও যাচ্ছে।
ব্যাপারটা আরও একটু সহজ করে বোঝা যাক। আপনি কয়েক বছর আগেও যে রান্নার তেল ১০০ টাকার মতো লিটারে কিনতেন তা এখন ২০০ টাকা দিয়ে কিনছেন। অর্থাৎ আপনার ভোজ্য তেলের খাতে খরচ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। একই ভাবে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের দাম। এমনকি, উনুনের আগুনেরও। শরীর খারাপ হলেও সেই একই হাল। ওষুধের দামও আকাশ ছুঁতে চাইছে। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতেও ভয় লাগে। সর্বস্বান্ত হওয়ার ভয়। আর সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এই ভয়ের পরিসর কিন্তু আর দরিদ্র বা দিনমজুরের মধ্যে আটকে নেই। এই ভয়ে আজ তথাকথিত মধ্যবিত্তও জর্জরিত!
কারণ, আপনার স্বচ্ছলতার একক আপনার মাসের শেষে আয় নয়। আপনার স্বচ্ছলতার সূচক আসলে কিন্তু প্রাত্যহিক প্রয়োজন মেটানোর পরে আপনার হাতে কত পড়ে থাকে সেই অঙ্কটাই। দারিদ্রের অঙ্কে এই রাশি সব সময়ই খুব জরুরি। যার দৈনন্দিন জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় খরচের পরে হাতে কিছু থাকে না, সে কিন্তু দারিদ্র সীমার দরজায় বলে মনে করে নেওয়া যেতে পারে। আপনার আয় কিন্তু দামের এই দৌড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে না। ক্রমাগত এই দৌড়ে আপনার আয় কিন্তু কোভিডের আগে থেকেই হার মানতে শুরু করেছে। কোভিড উত্তর আজ কিন্তু সচ্ছলতার জমিটা এই কারণেই আপনার কাছে একটু বেশিই পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে।
আর জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় খরচ মেটানোর ক্ষমতাও নেই যাঁদের অর্থাৎ যাঁদের উদ্বৃত্ত শূন্য শুধু নয়, তা ঋণাত্মক, সে দরিদ্র বা হতদরিদ্র। বিভিন্ন সমাজে জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় খরচের অঙ্ক বিভিন্ন। আর তাই বিভিন্ন সমাজে দারিদ্রসীমার অঙ্কটাও এক নয়। আর এই কারণেই গরীব দেশের থেকে তুলনামূলক ভাবে বড়লোকের দেশে দারিদ্রসীমা উপরে।
এ বার ভাবুন, আপনার আয়ের জন্য কর্মক্ষেত্রে যেতে হবে। তেলের দাম ক্রমবর্ধমান। সরকারের দাবি, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বাড়ায় দেশেও পেট্রল, ডিজেল আর রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ছে। আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, তা হলে তেলের দাম পড়লে তার প্রতিফলন আমাদের জীবনে দেখি না কেন? এর উত্তর কিন্তু আপনি পান না। কারণ তা হয়ত বললে দেশ জুড়ে আর্থিক সাফল্যের ঢাকের চামড়া ফুটো হয়ে যেতে পারে সেই ভাবনায়।
উত্তরটা কিন্তু সোজা। আমাদের আমদানির পরিমাণ রফতানির থেকে অনেক বেশি হওয়ায় ডলারের চাহিদা বেড়েই চলেছে। আর পড়ছে টাকার দাম। তাই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম পড়লেও আমাদের ঘরের টাকার অঙ্কে তা কেনার দাম বেড়েই চলেছে! তাই সরকার যখন রেকর্ড রফতানির দাবি নিয়ে সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে আমাদের অগ্রগতির কথা তখন, সেই মার্চ মাসে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৮৭০ কোটি ডলারে। অঙ্কটা ডলারেই পড়ুন। কারণ, মার্চের তুলনায় টাকার দাম আরও পড়েছে। তাই তুলনা করতে ডলারেই দেখে নেওয়া ভাল হিসাবটা। আর গোটা আর্থিক বছর ধরলে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৯২৪০ কোটি ডলারে! তাই বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বাড়তে থাকায় টাকার দামও পড়ছে এবং বাড়ছে তেলের দাম। তা ভোজ্য হোক বা জ্বালানির। আর তা বাড়াচ্ছে বাকি সব পণ্যের দাম।
এ বার ফিরি আমাদের অঙ্কে। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত যাঁরা, তাঁদের আয় কিন্তু তাল মিলিয়ে বাড়ছে না। তাই তাঁদের আয় ও প্রয়োজনীয় খরচের মধ্যে ব্যবধান কমছে। কমছে উদ্বৃত্ত। কমছে তাঁদের পণ্য পছন্দের অধিকার। গ্যাঁটে কড়ি না থাকলে বাজারে গিয়ে পছন্দের অধিকার ফলানোর অধিকারই তো বাজেয়াপ্ত হয়ে যায়! তাই বেচারা আম জনতা শুধু আইনি অধিকারেই দুর্বল হচ্ছে না। দুর্বল হচ্ছে আর্থিক অধিকারেও।
বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব অনুযায়ী আয়ের হিসাব ভারতের নাগরিকদের ভাগ করলে মাঝের যে ৪০ শতাংশ তাঁদের জাতীয় সম্পদের ৩০.৮ শতাংশের উপর অধিকার ছিল ২০১২ সালে। আর ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২২.৯ শতাংশে। শীর্ষ ১০ শতাংশের ক্ষেত্রের ছবিটা একদম বিপরীত। ছিল ৬২.৮ শতাংশ তা বেড়ে হয়েছে ৭৪.৩ শতাংশ। জাতীয় সম্পদের উপর অধিকার কিন্তু বেড়েছে শুধু শীর্ষে থাকা ১০ শতাংশেরই।
এর মানে তো সোজা। শীর্ষ ১০ শতাংশের নিচে যাঁরা তাঁরা প্রয়োজনীয় খরচ আর আয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখতে পারেননি আয় তাল মিলিয়ে না বাড়ার জন্যই। কিন্তু জাতীয় সম্পদ তো বেড়েছে! কারণটা হল অতি উচ্চবিত্তের বা ধনীর লাভ বাড়লেও তা কম আয়ের মানুষের কাছে বর্ধিত মাস মাইনের অঙ্কে প্রতিফলিত হয় নি। বাজারে ধনীর অধিকার বাড়ে এই বিশাল বৈষম্যের কারণেই। তাতে কিন্তু বাজারই শেষে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বেশি। ধাক্কা খায় উন্নয়নও। আর তা থেকে ক্ষতি হয় সবারই। কারণ, চাহিদার উপর নির্ভর করে উৎপাদনের প্রসার। আর বাজারের এই ভোটটা আসে সাধারণের কাছ থেকেই।
বাজারের এই বৈষম্য কিন্তু বাজার ঠিক করতে পারবে না। এই অঙ্কটাও কিন্তু ওই আইনি অধিকারের মতোই। আইন যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা আইনের বাইরে গিয়ে বিশেষ অধিকার দাবি করলে সাধারণ নাগরিক তাঁর গণতান্ত্রিক অধিকার হারান। কারণ আইনি অধিকারের বৈষম্য খর্ব করে আপনার নাগরিক অধিকার। আর তা ঠিক করতে প্রয়োজন শুধু নীতি নয় তার সঠিক প্রয়োগের সদিচ্ছা। ঠিক একই ভাবে, বাজারের ক্ষেত্রেও হানিকর এই বৈষম্যকে ঠিক করতে প্রয়োজন সঠিক নীতির এবং তার সঠিক প্রয়োগের।
যে রান্নাঘরে আমরা গ্যাসের উনুন পৌঁছে দিয়েছি সেই রান্নাঘরে রান্নার জন্য গ্যাসের জোগান অব্যাহত রাখাটাই কিন্তু প্রয়োজনীয় নীতি। তা কেড়ে নিলে বৈষম্য বাড়ার পথে ইন্ধনই দেওয়া হয় এটাও কিন্তু বোঝার প্রয়োজন আছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy