পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খুলতে এগারো আবেদনকারীকে নীতিগত ভাবে অনুমোদন দিল ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক।
এর মধ্যে ডাক বিভাগ, ন্যাশনাল সিকিউরিটিজ ডিপোজিটরি (এনএসডিএল)-র মতো সরকারি সংস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই আছে রিলায়্যান্স ইন্ডাস্ট্রিজ, আদিত্য বিড়লা নুভোর মতো প্রথম সারির কর্পোরেট সংস্থা। ভোডাফোন এম-পেসা, এয়ারটেল এম কমার্স-এর মতো টেলিকম শিল্পের প্রতিনিধি যেমন তালিকায় ঠাঁই পেয়েছে, তেমনই সবুজ সঙ্কেত পেয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা টেক মহীন্দ্রা। অনুমোদন পেয়েছেন সান ফার্মার প্রতিষ্ঠাতা-এমডি দিলীপ শান্তিলাল সাংভি এবং পেটিএমের প্রতিষ্ঠাতা-সিইও বিজয় শেখর শর্মাও।
বুধবার জারি করা বিজ্ঞপ্তিতে শীর্ষ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ১১টি পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খোলার জন্য এই নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হল ১৮ মাসের জন্য। এর মধ্যে যাবতীয় শর্ত পূরণ করতে পারলে, তবেই পরিষেবা চালুর চূড়ান্ত লাইসেন্স মিলবে। এই ব্যাঙ্কগুলি সাফল্যের মুখ দেখলে, আরও পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খোলার ছাড়পত্র দেওয়া হবে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। উল্লেখ্য, পেমেন্টস ব্যাঙ্ক খুলতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছে আবেদন জমা পড়েছিল মোট ৪১টি।
অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির দাবি, ‘‘এর ফলে অনেক বেশি টাকা আসবে ব্যাঙ্কিং শিল্পে। গ্রামে আরও অনেক বেশি সংখ্যক মানুষের দরজায় পৌঁছে যাবে ব্যাঙ্ক।’’ যেমন, রিলায়্যান্সের প্রস্তাবিত পেমেন্টস ব্যাঙ্কে স্টেট ব্যাঙ্কের ৩০% অংশীদারি থাকবে বলে জানিয়েছেন কর্ণধার অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। এয়ারটেলের ব্যাঙ্কের পরিকল্পনা রয়েছে ১৯.৯% শেয়ার কোটাক-মহীন্দ্রা ব্যাঙ্ককে দেওয়ার।
গত বছর জুলাইয়ে বাজেট বক্তৃতাতেই পেমেন্টস ব্যাঙ্ক তৈরির পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করেছিলেন জেটলি। তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় এ নিয়ে খসড়া নির্দেশিকা প্রকাশ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। চূড়ান্ত নির্দেশিকা জারি হয় ২০১৪ সালের ২৭ নভেম্বর।
সেখানে বলা হয়েছিল, পেমেন্টস ব্যাঙ্ক তৈরির মূল লক্ষ্য, ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সুবিধা দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তেও সকলের দরজায় পৌঁছে দেওয়া। যাতে সেখানে অন্তত তুলনায় ছোট অঙ্কের আমানত জমা করা যায়। তার মারফত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় টাকা পাঠাতে পারেন সাধারণ মানুষ। বিশেষত ঘর ছেড়ে অন্য শহর বা ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকেরা।
ছোট ব্যবসায়ী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মীরাও এই ব্যাঙ্কের পরিষেবায় উপকৃত হবেন বলে শীর্ষ ব্যাঙ্কের দাবি। শুধু তা-ই নয়। পেমেন্টস ব্যাঙ্ক মারফত অনলাইনে কর দেওয়া থেকে শুরু করে ই-কমার্সের বিভিন্ন লেনদেনে টাকা মেটানোর পরিষেবা মিলবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ব্যাঙ্ক ব্যবহার হতে পারে স্কুল-কলেজের বেতন মেটানো থেকে পেনশন পাওয়ার মতো হাজারো কাজে। এমনকী আগামী দিনে সরকারি ভর্তুকির টাকা সরাসরি অ্যাকাউন্টে পেতেও পেমেন্টস ব্যাঙ্ক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে বলে তাঁদের অভিমত।
পুরোদস্তুর বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের সঙ্গে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের ফারাক কোথায়, তা-ও অবশ্য গোড়া থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যেমন, এই ব্যাঙ্ক ধার দিতে পারবে না। ফলে ক্রেডিট কার্ড দেওয়ার প্রশ্নও নেই। আপাতত এক জন গ্রাহকের কাছে জমা নেওয়া যাবে না এক লক্ষ টাকার বেশি আমানতও (পরে অবশ্য তা বাড়তে পারে)। গ্রাহকদের এটিএম বা ডেবিট কার্ড ইস্যু করা যাবে। বিক্রি করা যাবে কম ঝুঁকির মিউচুয়াল ফান্ড এবং বিমা প্রকল্পও।
বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ মনে করছেন, দেশে ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় আক্ষরিক অর্থেই বিপ্লবের সূচনা হতে পারে পেমেন্টস ব্যাঙ্কের হাত ধরে। যার প্রধান হাতিয়ার হবে প্রযুক্তি। কারণ তাঁদের মতে, এই সমস্ত পেমেন্টস ব্যাঙ্ক সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কের মতো বড় শাখা খুলে যত না ব্যবসা করবে, তার থেকে অনেক বেশি আঁকড়ে ধরবে ইন্টারনেটকে। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে। আবার অন্য দিকে, খুলে যাবে নিত্য-নতুন উদ্ভাবনী চিন্তার দিগন্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি মাসে, এমনকী প্রতি সপ্তাহে ব্যবসার নতুন কৌশল দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রযুক্তির হাত ধরে ব্যাঙ্কিং পরিষেবাও সেই দ্রুততায় বদলাবে, ঠিক যে ভাবে গত এক-দেড় দশকে আমূল পাল্টে গিয়েছে দেশের টেলিকম শিল্প।
পেমেন্টস ব্যাঙ্ক গড়তে সম্মতির তালিকা দেখে প্রশ্নও যে ওঠেনি, তা নয়। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আজ বহু দিন ধরেই ব্যাঙ্কিং পরিষেবায় পা রাখতে উন্মুখ দেশের প্রথম সারির শিল্প সংস্থাগুলি। কিন্তু এত দিন তাদের এই চৌহদ্দিতে ঢুকতে দেয়নি শীর্ষ ব্যাঙ্ক। তা হলে এ বার এক লপ্তে এতগুলি কর্পোরেট সংস্থাকে অনুমোদন দেওয়া হল কী ভাবে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রধানত যে-কারণে কর্পোরেট সংস্থাকে এত দিন ব্যাঙ্ক খুলতে দেওয়া হত না, তা হল স্বার্থের সংঘাত। মনে করা হত, এক বার ব্যাঙ্ক খুলতে পারলে, নিজের ব্যবসাকেই আগে ঋণ জোগাবে তারা। কিন্তু পেমেন্টস ব্যাঙ্কে সেই সমস্যা নেই। কারণ, ধার দেওয়ার এক্তিয়ারই নেই তাদের। তা ছাড়া, সেখানে সাধারণ মানুষের টাকা যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা-ও যথাসম্ভব নিশ্চিত করতে চেয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। যেমন, এই ব্যাঙ্ক খুলতে শেয়ার মূলধন হতে হবে অন্তত ১০০ কোটি টাকা। শীর্ষ ব্যাঙ্কের নিয়ম মেনে টাকার নির্দিষ্ট অংশ তাদের কাছে তো গচ্ছিত রাখতেই হবে, সেই সঙ্গে অন্তত ৭৫ শতাংশ লগ্নি করতে হবে সুরক্ষিত সরকারি ঋণপত্রে।
পেমেন্টস ব্যাঙ্কের ছাড়পত্র পেয়ে এ দিন প্রত্যাশিত ভাবেই ওই পরিষেবা চালু করতে মুখিয়ে থাকার কথা বলেছেন সফল আবেদনকারীরা। ভোডাফোন ইন্ডিয়ার এমডি-সিইও সুনীল সুদ-এর মতে, এই লাইসেন্স তাঁদের সাহায্য করবে ভারতকে ক্রমশ নগদবিহীন লেনদেনের দিকে নিয়ে যেতে। এয়ারটেল মুখপাত্রের দাবি, এর দৌলতে এমন বহু মানুষের দরজায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছবে, যাঁরা এত দিন তা থেকে বঞ্চিত ছিলেন। যত দ্রুত সম্ভব এই পরিষেবা শুরু করতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে টেক মহীন্দ্রা-সহ বাকিরাও।
কেন্দ্রের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের দাবি, সকলের দরজায় ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে ডাক বিভাগ। সারা দেশে ১.৫৪ লক্ষ ডাকঘরের মধ্যে ১.৩০ লক্ষই গ্রামাঞ্চলে। ফলে তাদের হাত ধরে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ছবি আমূল বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশেষজ্ঞরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy