রঘুরাম রাজন। -ফাইল চিত্র।
কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খুলতে দিলে আর্থিক কাঠামো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে বলে সতর্ক করলেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। গত শুক্রবার এই সুপারিশ করেছিল রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের বিশেষ অভ্যন্তরীণ কমিটি। সোমবার প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্যের সঙ্গে মিলে লেখা এক প্রবন্ধে রাজনের প্রশ্ন, এখনই কেন এই প্রস্তাব আনা হল? তাঁদের হুঁশিয়ারি, এতে যে সব সংস্থার ঘাড়ে বিপুল ঋণের বোঝা এবং ভাল রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে, তারা বেশি করে লাইসেন্স পেতে ঝাঁপাতে পারবে। তৈরি হবে স্বার্থের সংঘাত। তাই এই সুপারিশ আপাতত আলমারি বন্দি করে রাখার কথা বলেছেন তাঁরা।
প্রাক্তন গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরের মতে, ভারতে কোনও ব্যাঙ্ক যাতে দেউলিয়া হয়ে ব্যবসা না-গোটায়, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়। আমজনতা সেখানে টাকা রেখে নিশ্চিন্ত থাকেন। বিপুল পুঁজি পায় ব্যাঙ্কগুলিও। কিন্তু তা সত্ত্বেও খামতি যে থাকে, সে কথা বলেছেন তাঁরা। তাঁদের মতে, শুধু আইন করেই যদি নিয়ম ও নজরদারি কার্যকর করা যেত, তা হলে অনুৎপাদক সম্পদের সমস্যা থাকত না। তা ছাড়া, কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলতে না-দেওয়ার কারণ মূলত দু’টি। প্রথমত, তারা নিজেরাই ব্যাঙ্ক চালালে চাইলে নজরদারি ছাড়া টাকা হাতে পাবে। দ্বিতীয়ত, এতে অর্থনৈতিক (এবং রাজনৈতিক) ক্ষমতা কুক্ষিগত হবে নির্দিষ্ট কিছু সংস্থার হাতে।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সুপারিশ
• বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ব্যাঙ্ক খোলার অনুমতি।
• যে এনবিএফসির মালিক কর্পোরেট সংস্থা ও যাদের ৫০,০০০ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ আছে, শর্তসাপেক্ষে তাদের ব্যাঙ্কে রূপান্তরিত হতে সায়।
• নতুন ব্যাঙ্ক তৈরির ন্যূনতম মূলধন ৫০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ১০০০ কোটি করা। স্মল ফিনান্স ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রে তা ২০০ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৩০০ কোটি টাকা।
• বেসরকারি ব্যাঙ্কে প্রোমোটারের অংশীদারির সর্বোচ্চ সীমা ১৫% থেকে বাড়িয়ে ২৬% করা।
‘যে সংস্থা ঋণ নিচ্ছে, তারাই ব্যাঙ্কের মালিক হলে সেই ব্যাঙ্ক ঠিক সিদ্ধান্ত নেবে কী করে? বহু সময়ে যেখানে স্বাধীন নিয়ন্ত্রকেরই নানা বিষয় চোখ এড়িয়ে যায়।’
‘অভ্যন্তরীণ কমিটির কিছু প্রস্তাব মানা যেতে পারে। কিন্তু কর্পোরেট সংস্থাকে ব্যাঙ্ক খুলতে অনুমতি দেওয়া নিয়ে তাদের মূল সুপারিশ তাকে তুলে রাখাই ভাল।’
‘আইন মেনে ব্যাঙ্ক খোলার সায় দিলেও এতে সুবিধা পাবে দেশের সেই সব বড় কর্পোরেট সংস্থা, যাদের ইতিমধ্যেই ন্যূনতম মূলধন রয়েছে। বিপুল ঋণ থাকা ও রাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী সংস্থাগুলির সুবিধা হবে বেশি। তারা লাইসেন্স পেতে ঝাঁপাতে পারবে।’
রঘুরাম রাজন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর
বিরল আচার্য, প্রাক্তন ডেপুটি গভর্নর
রাজন ও আচার্যের তোপ, কারণ ছাড়া হঠাৎ কমিটি তৈরির ঘটনা বিরল। এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হল যে, এখন তা গঠন করতে হল? আর সেই কমিটি এই প্রস্তাব দিল। প্রস্তাবনাপত্রের টিকাতেই বলা হয়েছে, যে ক’জন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে, এক জন বাদে তাঁদের কেউই কর্পোরেটের ব্যাঙ্ক খোলার পক্ষে মত দেননি। অথচ তা সত্ত্বেও চূড়ান্ত প্রস্তাব হিসেবে তা পেশ হয়েছে! ব্যাঙ্ক নয় এমন আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফসি) এবং পেমেন্টস ব্যাঙ্কের পুরোদস্তুর ব্যাঙ্ক হওয়ার রাস্তা সরলের প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করেছেন তাঁরা।
মূল্যায়ন সংস্থা এসঅ্যান্ডপি-রও মত, ভারতে সংস্থা পরিচালনা নিয়ে এমনিতেই প্রশ্ন রয়েছে। ব্যাঙ্কিং শিল্পের ঘাড়ে চেপে আছে বিপুল অনুৎপাদক সম্পদের বোঝা। তার উপরে এই প্রস্তাব আর্থিক ক্ষেত্রের ঝুঁকি বাড়াবে।
কমিটির সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তুলেছে ব্যাঙ্ক সংগঠনগুলি। আইবকের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সঞ্জয় দাস এবং এআইবিইএ-র সভাপতি রাজেন নাগর বলেন, ‘‘যারা অনুৎপাদক সম্পদ বৃদ্ধির জন্য মূলত দায়ী, তাদেরই ব্যাঙ্কের মালিক করতে উঠেপড়ে লেগেছে কেন্দ্র।’’ স্টেট ব্যাঙ্কের প্রাক্তন কর্ণধার প্রতীপ চৌধুরীর দাবি, ‘‘আমেরিকা, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানির মতো উন্নত দেশেও এই প্রথা চালু নেই।’’ শিল্প সংস্থার হাতে ব্যাঙ্কের মালিকানা থাকলে সাধারণের টাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে শীর্ষ ব্যাঙ্কের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy