রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন। —ফাইল চিত্র
কেন্দ্রের যুক্তি, দেশে আর্থিক ঝিমুনির জন্য দায়ী বিশ্বব্যাপী মন্দা। কিন্তু সেই দাবি খারিজ করে বরং মোদী সরকারের ঘাড়েই দোষ চাপালেন রঘুরাম রাজন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, অর্থনীতির বেহাল দশার জন্য সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দফতরের দিকেই তির ছুড়লেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর। তাঁর বক্তব্য, বর্তমান সরকারের আর্থিক নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা আসে প্রধানমন্ত্রী এবং ঘনিষ্ঠ বৃত্ত থেকে। তাতে রাজনৈতিক ফায়দা হতে পারে, অর্থনীতির গতি বাড়ে না। বর্তমানে দেশে ‘বৃদ্ধিতে মন্দা’ চলছে বলে মন্তব্য করে রাজনের দাওয়াই, অর্থনীতিকে উন্মুক্ত না করলে গতি আসবে না।
নোটবন্দির সিদ্ধান্ত আরবিআই-এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছিলেন। নোট বাতিলে যে তেমন কিছুই লাভ হয়নি দেশের বা অর্থনীতির— এমন মতবাদও বারবারই উঠে এসেছে তাঁর কথায়। এ হেন রঘুরাম রাজন এ বার সরব মোদী সরকারের আর্থিক নীতি নিয়ে। আর এ বার অভিযোগের আঙুল তুললেন খোদ প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দফতরের দিকে।
একটি জাতীয় সংবাদমাধ্যমে নিজেই একটি প্রতিবেদন লিখেছেন প্রাক্তন আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের প্রাক্তন কর্তা রাজন। রবিবার প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে দেশের বর্তমান বেহাল অর্থনীতির কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ‘ভুলটা বোঝার জন্য প্রথমেই আমাদের নজর দেওয়া দরকার বর্তমান সরকারের কেন্দ্রীভূত বৈশিষ্ট্যের দিকে। শুধু সিদ্ধান্ত নেওয়াই নয়, এমনকি পরিকল্পনা ও ধ্যানধারণাও আসে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দফতরের ঘনিষ্ঠ গুটিকয়েক লোকের কাছ থেকে।’
এই নীতি কতটা কার্যকরী? অর্থনীতিকে এই সংকীর্ণ গণ্ডিতে বেঁধে ফেলার নীতির তীব্র সমালোচনা করে রাজনের তোপ, ‘ওটা দলের রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে কাজে লাগে। কারণ এই গুটিকয়েক ব্যক্তির জ্ঞান সীমিত। যেখানে নির্দিষ্ট কোনও অ্যাজেন্ডা শীর্ষে থাকে না এবং সারা দেশের বদলে রাজ্য স্তরের ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেটা আর্থিক সংস্কারে কোনও কাজে আসে না।’
আরও পড়ুন: উন্নাওয়ের নির্যাতিতাকে চোখের জলে চিরবিদায়, ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা গ্রাম
অর্থনীতিবিদ রঘুরাম রাজন আবার ইউপিএ জমানার শেষ দিকেও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিংহ। তিনি নিজেও অর্থনীতিবিদ। স্বাভাবিক ভাবেই দুই সরকারের তুল্যমূল্য আলোচনাও উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। রাজন লিখেছেন, ‘আগের সরকারের উপর জোটের দায়বদ্ধতা ছিল। কিন্তু তারা সব সময় অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করার পথে এগিয়েছে।’ উল্টো দিকে ‘অতিরিক্ত কেন্দ্রীভূতকরণ, নির্দিষ্ট মন্ত্রিগোষ্ঠীর অনুপস্থিতি এবং নির্দিষ্ট দূরদৃষ্টির অভাব’-এ দুষ্ট মোদী সরকার, মত রাজনের। অথচ আর্থিক সংস্কারের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এই বিষয়টিতেই সবচেয়ে উদার হওয়া উচিত বলে মনে করেন রাজন।
তবে নিজের লেখায় রাজন যে যে শুধুই মোদী সরকারের খুঁত ধরেছেন এমন নয়। তিনি লিখেছেন, ‘মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেছিল ‘মিনিমাম গভর্নমেন্ট, ম্যাক্সিমাম গভর্ন্যান্স’ স্লোগান নিয়ে। কিন্তু এটা অনেকেই ভুল বোঝেন। এর অর্থ, সরকার আরও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করবে। এটা নয় যে সাধারণ মানুষ ও বেসরকারি সংস্থাকে উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করতে দেওয়া হবে না। সরকারের অটোমেশন এবং উপভোক্তাদের টাকা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠানোর সিদ্ধান্ত উল্লেখযোগ্য সাফল্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্কুচিত হয়নি, বরং প্রসারিত হয়েছে।’
শিল্পে বিনিয়োগ, উৎপাদিত পণ্য বিক্রি, কর্মসংস্থান সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক সংকোচনের ইঙ্গিত। মন্দার পূর্বাভাস। বলছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু সরকার তথা অর্থমন্ত্রী সেটা মানতে নারাজ। কিন্তু রাজন বলছেন, ‘সরকারের অভ্যন্তরীণ বা বাইরের সব সমালোচনাকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে দেগে না দিয়ে শুরুতেই সমস্যার ব্যাপকতা বোঝা দরকার। তাছাড়া সরকারের এই বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসা দরকার যে এই সমস্যা ক্ষণস্থায়ী নয়। খারাপ খবর চেপে দেওয়া বিভিন্ন সমীক্ষাকে প্রভাবিত করলেও সমস্যা থেকে দূরে সরে যাবে।’
আরও পড়ুন: ভিক্টোরিয়ার পাঁচিলে বসে তরুণীদের কটূক্তি, উইনার্সের আচমকা হানা, পাকড়াও ৬
রাজনের মতে, ‘ভারত এখন বৃদ্ধি সংকোচনের মধ্যে রয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় রয়েছে উল্লেখযোগ্য হতাশা।’ লিখেছেন, ‘দেশীয় শিল্পগুলি নতুন বিনিয়োগ করছে না এবং বিনিয়োগের এই স্থিতাবস্থা এটাই প্রমাণ করে যে কোনও কিছু খুব গভীরভাবে ভুল পথে যাচ্ছে।’
দুর্বল অর্থনীতি, আর্থিক বৃদ্ধি, জিডিপি নিয়ে বিরোধীরা হামেশাই সরকারকে আক্রমণ করেন। পাল্টা জবাবে মোদীর মন্ত্রীরাও অর্থনীতির দুর্বলতার দায় পূর্বতন ইউপিএ সরকারের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক এই চাপানউতোরের সমাধানও করে সরকারের বিপক্ষেই ব্যাট ধরেছেন রাজন। তাঁর মতে, ‘মন্ত্রীদের দাবি মতো সমস্যা যদি উত্তরাধিকার সূত্রে এসেও থাকে, তাহলে সাড়ে পাঁচ বছর পর সেগুলি সমাধান করার দায় বর্তমান সরকারের। অর্থনীতিতে সংস্কারের একটা ধাক্কা যেমন দেওয়া দরকার, তেমনই কী ভাবে সরকার পরিচালিত হবে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিও বদলানো দরকার।’
২০২৪ সালের মধ্যে ৫ লক্ষ কোটি মার্কিন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছে মোদী সরকার। রাজনের মতে, সেই উচ্চতায় পৌঁছতে হলে এখন থেকেই বছরে ৮-৯ শতাংশ হারে ধারাবাহিক বৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি, তাতে সেই স্বপ্ন ক্রমেই অসম্ভবের দিকে এগোচ্ছে বলেই মনে করেন প্রাক্তন আরবিআই গভর্নর।
প্রথম বার এনডিএ সরকার যখন ক্ষমতায় এসেছিল, সেই ২০১৪ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ছিলেন রঘুরাম রাজন। কার্যত শুরু থেকেই নানা ইস্যুতে তাঁর সঙ্গে সরকারের সঙ্ঘাত বাড়তে থাকে। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই মেনে নিতে পারেননি রাজন। ২০১৬ সালে তাঁর তিন বছরের জন্য কার্যকালের মেয়াদ শেষ হলেও তাঁকে গভর্নর পদে দ্বিতীয়বার নিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু সেই সঙ্ঘাতে সরকার মেয়াদ বাড়ায়নি। রাজন নিজে অবশ্য বলেছিলেন, তিনিই দ্বিতীয় বার আর দায়িত্ব নিতে চাননি। এ হেন রাজন নোটবন্দি থেকে মোদী সরকারের নানা সিদ্ধান্ত বা আর্থিক নীতির সমালোচনা করেছেন। ফের তিনি কলম ধরলেন। এবং এ বারও তাঁর কলমে মোদী সরকারের সমালোচনার পাল্লাই বেশি ভারী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy