চিনা ফোন বয়কটের স্লোগান যতই জনপ্রিয় হোক, বাজারে তার প্রভাব কিন্তু এখনও কমই। —প্রতীকী চিত্র।
বড়সড় শোরুম ম্যাডান স্ট্রিটের ধারে। মূলত মোবাইল এবং গ্যাজেটস। শোকেসের পর শোকেসে ভর্তি সার সার চিনা মোবাইল। দোকানে ঢুকেই অতএব ভাবনায় পড়ে যেতে হয়। যে ভাবে চিনা পণ্য বয়কটের স্লোগান জনপ্রিয় হচ্ছে দেশ জুড়ে, তাতে এই সব দোকানের কী হাল হবে! চিনা সংস্থাগুলো তো বিপুল সংখ্যক মোবাইল বেচে বসে রয়েছে ডিলার এবং রিটেলারদের। বয়কট জোরদার হয়ে উঠলে দীর্ঘ মেয়াদে চিনা সংস্থার কী হাল হবে, সে না হয় বেজিং ভেবে নিক। কিন্তু আপাতত ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কী হাল হবে, ভাবনা তা নিয়েই।
শোরুমের কর্মীদের মুখে অবশ্য চিন্তার লেশমাত্র নেই। বয়কট যে রকম জোরদার হচ্ছে, তাতে ব্যবসা ধাক্কা খাবে না? ওপোর কাউন্টারে বসে মুচকি হাসলেন সোমা। ‘‘আপনার কি মনে হচ্ছে সত্যিই বয়কট হচ্ছে?’’ মৃদু প্রশ্ন তাঁর। হচ্ছে না? প্রশ্নের উত্তর সোমাকে দিতে হল না। বছর ২৪ এক তরুণ কাচের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। মুখে কলকাতার নামী ফুটবল ক্লাবের লোগো লাগানো মাস্ক। বোঝাই যায় যে, ঘটি-বাঙাল লড়াইয়ের আবেগপ্রবণ শরিক। কিন্তু চিন বিরোধী আবেগ একটুও নাড়া দেয়নি তাঁকে। হাতের চিনা মোবাইলের স্ক্রিন সোমার মুখের সামনে তুলে ধরে আর একটি চিনা সেলফোনের ছবি দেখালেন তিনি। রিয়েলমি ফোনের ছবি, সঙ্গে কনফিগারেশনও লেখা। শোরুম জানাল, ওই ফোন ‘আউট অব স্টক’। আর একটাও কথা খরচ না করে নিমেষে বেরিয়ে গেলেন তরুণ। অর্থাৎ ওই ফোন ছাড়া অন্য কিছুর কথা ভাবতেই পারছেন না। বয়কটের কথা ভাবা কত কঠিন, ভেবে দেখুন তা হলে।
সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের উপরে ইলেকট্রনিক্সের রমরমে বাজার ‘ই-মল’। লকডাউনের জেরে প্রায় আড়াই মাস বন্ধ ছিল। মল খুলতেই ভিড় আছড়ে পড়েছে। মলে ঢোকার পথে থার্মাল গান আর স্যানিটাইজারের পাহারা পেরিয়েই ঢুকতে হচ্ছে। কেনাবেচাও মোটের উপরে শারীরিক দূরত্ব বিধি মেনেই চলছে। কিন্তু চিনা পণ্যের সঙ্গে দূরত্ব বহাল রাখার গরজ সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না ক্রেতাদের মধ্যে। ই-মলের দোতলায় ব্যস্ত স্টল অ্যাগনিকম কমিউনিকেশনস। মালিক আপাতত কলকাতায় নেই, বিহারে নিজের দেশের বাড়িতে গিয়েছেন। কর্মীরাই সামলাচ্ছেন স্টল। নোকিয়া আর য়ের কাউন্টার যিনি সামলান, সেই সোনু জানালেন, ‘‘স্যামসাং-এর বিক্রি ঈষৎ বেড়েছে। কিন্তু ওপো, ভিভো, রিয়েলমি, শাওমি, ওয়ান প্লাসের বিক্রিতে কোনও কমতি নেই। লকডাউনের আগে যেমন বিক্রি হত, এখনও তেমনই।’’ কেমন বিক্রি হত লকডাউনের আগে? সোনুরা জানাচ্ছেন, ওপোর ফোন বিক্রি হত মাসে ৫০-এর আশেপাশে। চলতি মাসের তিন সপ্তাহে বিক্রি হয়ে গিয়েছে ৪০-এর কাছাকাছি।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক রিপোর্ট: নিয়ন্ত্রণরেখায় শক্তিতে ভারত-চিন কে কোথায় এগিয়ে
অর্থাৎ ভারত-চিন বিবাদের কোনও ছাপই পড়েনি চিনা ফোন এবং গ্যাজেটসের বিক্রিতে? সোনু, সোমারা জানাচ্ছেন, একেবারে পড়েনি, তা নয়। তবে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বয়কটের প্রবণতাটা কম। চল্লিশোর্ধ্ব খরিদ্দার যাঁরা আসছেন, তাঁদের অধিকাংশই বলছেন, চিনা বাদে অন্য ফোন দেখাতে। কিন্তু তরুণদের মধ্যে সে সংখ্যাটা নামমাত্র।
এ তো গেল কলকাতার ছবি। যমজ শহর হাওড়ার ছবি কেমন? বড়সড় মোবাইল ফোন ডিলার মেট্রোপলিটন ইলেকট্রনিক্স জানাচ্ছে, চিনা ফোন হু হু করেই বিকোচ্ছে। সংস্থার মালিক অভিজিৎ দাশগুপ্তর কথায়, ‘‘আমাদের এখানে বরাবরই স্যামসাং-এর বিক্রিই বেশি। আমরা মাসে যত ফোন বিক্রি করি, তার ৬০ শতাংশই স্যামসাং-এর। বাকি ৪০ শতাংশ চিনা মোবাইল। এখনও অনুপাতটা সে রকমই রয়েছে। ভারত-চিন সীমান্তের পরিস্থিতি বা বয়কটের স্লোগান খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। চিনা ফোনের বিক্রি যদি কমে থাকে, ৫ শতাংশ কমেছে।’’
কেন কমেনি চিনা ফোন এবং গ্যাজেটসের বিক্রি, তার ব্যাখ্যাও দিলেন অভিজিৎ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমত, দু’আড়াই মাস তো সব বন্ধ ছিল। কিন্তু তাতে তো বাজারে মোবাইলের চাহিদা কমে যায়নি। প্রতি মাসেই তো নির্দিষ্ট একটা চাহিদা রয়েইছে। লকডাউন খুলতেই সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। দু’আড়াই মাসে যাঁদের কেনাকাটা আটকে ছিল, তাঁরা সবাই এখন একসঙ্গে হাজির। দ্বিতীয়ত, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ফোনের চাহিদাও এই সময়ে বেশি। কারণ ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনাও এখন প্রায় পুরোটাই স্মার্টফোনে চলছে। তাই অনলাইন ক্লাসগুলোর জন্য বাচ্চাদের এখন ফোন কিনে দিতেই হচ্ছে। অতএব চাহিদা তুঙ্গে। তাই অত বাছবিচারের সময় নেই। বাজারে যে ফোন পাওয়া যাচ্ছে, সেটাই লোকে কিনে নিচ্ছে।’’
কলকাতার মতো হাওড়াতেও কিন্তু কমবয়সীদের পকেটেই চিনা ফোন ঢুকছে বেশি। অপেক্ষাকৃত বয়স্ক ক্রেতাদের মধ্যে বয়কটে সাড়া দেওয়ার প্রবণতা বেশি। অভিজিৎ দাশগুপ্তের ব্যাখ্যা, ‘‘চিনা সংস্থাগুলো যতটা কম দামে ফোনে যত ভাল কনফিগারেশন এবং ফিচারস দিচ্ছে, যত ভাল ক্যামেরা দিচ্ছে, যত মসৃণ ভাবে চলছে, অন্য কোনও সংস্থা তেমন দিতে পারছে না। এখন ক্লাস ফাইভের একটা বাচ্চাকে তো কেউ ১৫-২০ হাজার টাকার ফোন কিনে দিতে চাইবেন না। ৮-১০ হাজারের ভিতরেই বাজেটটা বেঁধে রাখতে চাইছেন অধিকাংশ। ওই দাম অথচ ভাল ফিচারস, এটা ওপো, ভিভো ছাড়া কেউই তেমন দিতে পারছে না।’’
আগের মতোই বিকোচ্ছে চিনা ফোন। —প্রতীকী চিত্র।
কোরীয় সংস্থা স্যামসাং অবশ্য দাম কিছুটা কমিয়েছে সম্প্রতি। এবং তার পর থেকে স্যামসাং-এর বিক্রিও বেশ বেড়েছে বলে খবর কলকাতা-হাওড়া দুই শহরেই। ম্যাডান স্ট্রিটের দোকান হোক বা ই-মল, হাওড়ার মেট্রোপলিটন ইলেকট্রনিক্স হোক বা বারাসতের শোরুম, সব জায়গাতেই এই একই প্রবণতা টের পাওয়া যাচ্ছে।
এক শোরুম মালিকের ব্যাখ্যা, ‘‘এত দিন বন্ধ থাকার পরে বাজার খুলেছে, ফলে চাহিদা কিছুটা বেশি। লকডাউনের কারণে স্মার্ট ফোনের প্রয়োজনটাও বেড়েছে। এই যে অতিরিক্ত বাজারটা তৈরি হল, সেটা কিন্তু স্যামসাং ধরে নিল বেশ খানিকটা। সেখানে ওপো, ভিভো, রিয়েলমি, শাওমি একটু পিছিয়ে।’’ কোন মন্ত্রে স্যামসাং ধরতে পারল এই অতিরিক্ত চাহিদার বাজারটা? ওই ব্যবসায়ী বলছেন, ‘‘প্রথমত, ভাল কনফিগারেশন এবং ভাল ফিচারের বেশ কিছু নতুন ফোন আগের চেয়ে বেশ কিছুটা কম দামে বাজারে এনেছে স্যামসাং। দ্বিতীয়ত, বয়কটের স্লোগান কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে বাজারে। অতএব চিনা ফোন বাদ দিয়ে বাজেটের মধ্যে ভাল ফোন এখন স্যামসাং-ই।’’
তা-ই যদি হবে, তা হলে তো স্যামসাং-এর বিক্রি আরও অনেক বেশি বেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। ৫ শতাংশ বা ১০ শতাংশ বৃদ্ধিতে আটকে থাকছে কেন? হাওড়ার অভিজিৎ দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘এই মাসে সবটা বুঝতে পারবেন না। আমরা তো গোটা মাসের হিসেবটা বলছি। কিন্তু এই মাসের শুরু থেকে তো চিনা পণ্য বয়কটের ডাকটা ছিল না। গত এক-দেড় সপ্তাহ ধরে বয়কটের প্রবণতাটা বাড়ছে। তার আগে তো সব স্বাভাবিকই ছিল। গোটা একটা মাসের ব্যবসার হিসেব হাতে পেতে হলে জুলাই মাসের বেচাকেনার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তার আগে পুরো ছবিটা স্পষ্ট হবে না।’’
দোকান বা শোরুমের কেনাবেচায় যদিও বা বয়কটের ছাপ সামান্য হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে, অনলাইন খরিদ্দারিতে কিন্তু তার লেশমাত্র নেই। অন্তত এখনও পর্যন্ত নেই। চিনা সংস্থা ওয়ান প্লাস সম্প্রতি নতুন বাজারে ছেড়েছে ‘এইট প্রো’ মডেল। জুনের তৃতীয় সপ্তাহেই অনলাইন শপিং-এর গেটওয়ে খুলেছিল সংস্থাটি। কয়েক মিনিটের মধ্যে গোটা ভারতের স্টক খালি হয়ে যায়। যত জন কিনতে পেরেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি সংখ্যক সম্ভবত চেষ্টা করেও সে দিন বুক করতে পারেননি ফোন। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় তা নিয়ে তুমুল ক্ষোভও উগরে দেন। অনেক দিন ধরে ‘ওয়ান প্লাস এইট প্রো’-র জন্য অপেক্ষা করেও কেন কিনতে পারা গেল না! কেন মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে স্টক ফুরিয়ে গেল! এমন নানা প্রশ্ন তুলে অনেকেই উষ্মা বা বিরক্তি জাহির করেছেন ফেসবুক বা টুইটারে।
অর্থাৎ শুধু কলকাতা-হাওড়া বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশেই কিন্তু প্রবণতা একই রকম। তা হলে কি চিনা ফোন, চিনা গ্যাজেটস, চিনা পণ্য বয়কটের ডাক ছাপই ফেলছে না ভারতের বাজারে?
ভারতীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন— ছাপ একেবারে ফেলছে না, তা নয়। কিন্তু যেটুকু ছাপ পড়ছে, সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি আরও বাড়বে, তা দেখার জন্য সামনের মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আরও পড়ুন: কাশ্মীর থেকে ঢুকেছে ৪-৫ জঙ্গি? দিল্লিতে জঙ্গি হানার সতর্কতা
চিনা ব্যবসায়ীরা অর্থাৎ চিনা সংস্থাগুলির উচ্চপদস্থ মহল কী বলছে? বয়কটের স্লোগান কি আদৌ ধাক্কা দিতে পারল তাদের ব্যবসায়? কোনও উত্তর নেই। চিনের সরকার যেমন কঠোর গোপনীয়তার নীতিতে বিশ্বাসী, চিনা সংস্থাগুলির কর্তারাও ঠিক সেই প্রশিক্ষণেই অভ্যস্ত। হোম অ্যাপ্লায়েন্সেসের অত্যন্ত নামী চিনা সংস্থা হুয়াওয়ে। ভারতের সে সংস্থার বিনিয়োগ এবং ব্যবসা গত কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে। ভারত-চিন সীমান্তে উত্তেজনা এবং তার প্রেক্ষিতে চিনা পণ্য বয়কটের স্লোগান ওঠার পরে ভারতে হুয়াওয়ের ব্যবসার অবস্থা কী রকম? ধাক্কা খাওয়ার আভাস রয়েছে কি? সংস্থার কর্পোরেট কমিউনিকেশন বিভাগ কোনও তথ্য দিতে রাজি নয়। যে জনসংযোগ সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে হুয়াওয়ে, তাদের মাধ্যমে স্পষ্ট জানানো হল— এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা সম্ভব নয়। ঠিক একই রকম মন্তব্য এসেছে শাওমির তরফ থেকেও। ব্যবসা ধাক্কা খেয়েছে, নাকি মসৃণ ভাবেই চলছে, সে বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হয়নি সংস্থার জনসংযোগ বিভাগ।
চলতি মাসের শেষে ব্যবসার হিসেব কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কিছুটা আভাস মিলছে। বয়কটের প্রভাব সত্যিই যদি পড়ার হয়, জুলাই মাসে আরও বেশি করে বোঝা যাবে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। কিন্তু এত কম দামে এত সুযোগ-সুবিধার ফোন আর কোন সংস্থাই বা দেবে? বিকল্প যদি বাজারে না আসে, তা হলে বয়কট কী ভাবে সফল হবে? প্রশ্ন উঠছে বাজারে। ‘‘স্যামসাং এখন কম বাজেটের বেশ কয়েকটা ভাল ফোন বাজারে এনেছে ঠিকই। কিন্তু চিনা ফোনগুলো বাজার কাঁপানো শুরু না করলে স্যামসাং-ও কি দাম কমাত?’’ প্রশ্ন তুলছেন এক স্যামসাং ডিলারই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy