দেশের আর্থিক সঙ্কোচন মানে সাধারণ নাগরিকের পকেটে টান। প্রতীকী ছবি।
উন্নয়ন না বৃদ্ধি? না কি বৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন? কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বক্তব্য থেকে এটা মনে হতেই পারে যে উন্নয়নের জন্য আলাদা কোনও প্রয়াসের প্রয়োজন নেই। তাই আর্থিক বৃদ্ধি মানেই উন্নয়ন। বৃদ্ধি হলে সেই অর্থনীতি নামক গাছে উন্নয়নের ফল এমনিই ফলবে। কিন্তু তা কি ফলে? না। কারণ, আর্থিক বৃদ্ধির স্বাদ সবার জিভে ঠেকাতে গেলে প্রয়োজন অধিকারের সাম্যের পরিবেশ। আর ভারতের অর্থনীতিতে নাগরিক তারই অভাব বোধ করছেন প্রতিনিয়ত।
আরও এগোনোর আগে প্রেক্ষিত তৈরির জন্য বৃদ্ধি-চিত্রটার উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। মাথায় রাখতে হবে কোভিড শুরু হওয়ার ঠিক আগের আর্থিক বছর আমরা শেষ করেছি মাত্র ৪ শতাংশ বৃদ্ধি নিয়ে। তার আগের পাঁচ বছর ধরেই বৃদ্ধির হার ক্রমাগত পড়েছে। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় বৃদ্ধি আর উন্নয়ন সমার্থক, তা হলেও তো মানতে হবে উন্নয়নের হার পড়েছে। কিন্তু আমরা এই সমীকরণের রাস্তায় হাঁটব না। শুধু মাথায় রেখে দেব এই তথ্যটুকু।
এটাও মাথায় রাখা যাক যে ২০১৯-২০ সাল শেষ হওয়ার মুখেই কোভিড আক্রান্ত ভারতে লকডাউন জারি হয়। ঝাঁপ পড়ে বাজারে। তাই আর্থিক উন্নয়ন বা বৃদ্ধির আলোচনা সব সময়েই ওই ২০১৯-২০ সালের প্রেক্ষিতেই করা হয় এবং হবে। কারণ ২০২০-২১ ছিল এক ব্যতিক্রম। ওই বছরে লকডাউনের কারণে অর্থনীতির সঙ্কোচন হয় ৭.৩ শতাংশ। কোভিডের ছোবল থেকে দেশ বাঁচাতে আমাদের গৃহবন্দি হওয়া ছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না। তার ফলে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া আর্থিক কর্মকাণ্ড প্রায় শূন্যে পৌঁছেছিল গত বছর। আর এই কারণেই অর্থিনীতির সঙ্কোচন। চিন ছাড়া (জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ২.৩ শতাংশ), বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই এই আর্থিক সঙ্কোচনের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে ভারত অবশ্যই ব্যতিক্রম নয়।
বৃদ্ধির হারের অঙ্কটা আর একটু দেখে নেওয়া যাক। বোঝার জন্য ধরে নেওয়া যাক ২০১৯-২০ সালে জাতীয় উৎপাদন ছিল ১০০। ২০২০-২১ সালে ৭.৩ শতাংশ সঙ্কোচন হওয়ার কারণে তা গিয়ে দাঁড়ায় ৯২.৭ এ। এবার সেখান থেকে অন্তত ২০১৯-২০ সালের স্তরে ফিরতে বৃদ্ধির হার হতে হবে ৮ শতাংশের আশেপাশে। মাথায় রাখতে হবে গোটা বছরের বৃদ্ধি যদি ৮ শতাংশের মতো হয় তা হলে আমরা ফিরে পাব ২০১৯-২০ সালের জাতীয় উৎপাদনে। অর্থাৎ, ২০১৬ সালের (৮.২৫৬ শতাংশ) পর থেকে যে বৃদ্ধির হার আমরা ছুঁতে পারিনি, দু’বছরের জাতীয় উৎপাদনের ‘ক্ষতি’ মিটিয়ে উঠতে পারব সেই হার ছুঁতে পারলে। তার পরই আমরা আসলে বৃদ্ধির আলোচনায় নামতে পারব।
এ বার একটু আসল অঙ্কটায় চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। ২০২০-২১ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে তার আগের বছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের তুলনায় দেশ হারিয়েছিল ৮ লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। চলতি বছরে ২০২০-২১-এর তুলনায় আমরা লাভ করেছি ৫ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অতিমারির বছরে ওই একই সময়ের স্তরে পৌঁছতে আমাদের আরও ৩ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় উৎপাদন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তা করে উঠতে পারিনি। এই ক্ষতিটা পূরণ করতে পারলে তবেই আমরা নিট বৃদ্ধির অঙ্ক কষার রাস্তায় হাঁটতে পারব।
ফেরা যাক সেই মূল প্রসঙ্গে। দেশের আর্থিক সঙ্কোচন মানে তো দেশের আর্থিক কর্মকাণ্ডের সঙ্কোচন। কাজ বন্ধ হওয়া, আয় বন্ধ হয়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া। সোজা কথায় সাধারণ নাগরিকের পকেটে টান। আর পকেটে টান মানেই তো বাজারে পণ্যের উপর অধিকারেও টান। এটা তো সোজা অঙ্ক। যদি বাজারে সব পণ্যের দাম একই থাকে কিন্তু নাগরিকের আয় কমে যায় তা হলেও কিন্তু পণ্যের অধিকার খর্ব হয়।
কোভিডের আগেই এক দিকে যেমন দেশের বৃদ্ধির হার কমছিল, তার পাশাপাশি বাড়ছিল আর্থিক বৈষম্য। তথ্য বলছে ১৯৯০ সালে ভারতে বিত্তের অঙ্কে শীর্ষের এক শতাংশ দেশের আয়ের ১১ শতাংশ ভোগ করতেন। অতিমারি শুরু হওয়ার আগেই তাঁরা ভোগ করতে শুরু করেন ২১ শতাংশ। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে দেশের মানুষের মধ্যে আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। বড়লোক আরও বড়লোক হয়েছেন। দেশের আয়ে সাধারণের ভাগ ফলে কমেছে বই বাড়েনি।
বাজার অর্থনীতিতে উন্নয়নের মূল ব্যাখ্যার প্রাথমিক শর্ত কিন্তু এই বৈষম্য কমা। আর এইখানেই আসে সরকারের নীতির প্রশ্ন। সরকারের আয়-ব্যয় নীতির সঙ্গে ব্যবসায়ী সংস্থার আয়-ব্যয় নীতির মূল প্রভেদ কিন্তু একটাই। ব্যবসায়ী সংস্থার আর্থিক সঞ্চালনার মূল নির্ধারক হল লাভ। আর সরকারি আর্থিক নীতির মূল সঞ্চালক বা নির্ধারকই হল নাগরিকের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ। সরকারের ঋণ নীতি আর ব্যবসায়িক ঋণ নীতিরও মূল ফারাক ওই নাগরিকের স্বার্থ বনাম সংস্থার লাভের ফারাক দিয়েই নির্ধারিত হয়।
ব্যবসায়িক নীতির সাফল্য তাই যেমন তার লাভ বাড়ানোর দক্ষতায় নির্ধারিত হয়, সরকারি নীতির দক্ষতাও তেমনই দেখা হয় নাগরিকের স্বাচ্ছন্দ বৃদ্ধির অঙ্কে। রান্নার গ্যাসের অঙ্কই ধরা যাক। সাধারণের পকেটের টান বাড়ছে পাশাপাশি বাড়ছে খাওয়ার খরচ। ভোজ্য তেল কেনা সাধ্যাতীত হয়ে উঠছে। বিশ্ব বাজারে যখন পেট্রোপণ্যের দাম কমছে আমাদের দেশের মানুষ দাম বাড়ার কারণেই গাছের ডাল-পালা কুড়িয়ে উনুনের আঁচ দিয়ে রান্নার রাস্তায় ফিরছে। প্রধানমন্ত্রীর প্রথাগত উনুনহীন ভারতীয় রান্নাঘরের স্বপ্নের উপর ছাই ঢেলে। আর সাধারণ হারাচ্ছে পণ্যের অধিকার। বাড়ছে বৈষম্য।
অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন যে আগের সরকার ঋণ করে পেট্রোলিয়ম পণ্যের দাম সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে বেঁধে রাখায় তাঁকে সেই ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। তাই তিনি বাধ্য হচ্ছেন সাধারণের উপর এই দায় চাপাতে। না, তিনি অবশ্যই ‘সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে’ এই বাক্যবন্ধটি ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাঁর দাবি নিয়ে সংশয়ের জায়গা তৈরি হয়েছে আয় ও দায়ের অঙ্ক মিলিয়ে।
২০২০-২১ সালে পেট্রোপণ্যের উপর কর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার আয় করেছে ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে এই খাতে কেন্দ্র আয় করেছিল ১ লক্ষ ৯৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরে এই খাতে কেন্দ্র আয় করবে আনুমানিক ৩ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
এ বার পেট্রোপণ্যের দাম ধরে রাখতে যে ঋণপত্র ছাড়া হয়েছিল তাতে ২০২৬ সালের মধ্যে ৩৭ হাজার কোটি টাকার সুদ দিতে হবে। আসলের দায় দাঁড়িয়েছে ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি টাকা। দুই মিলিয়ে দায়ের অঙ্ক তো দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৬৭ হাজার কোটি টাকা! অথচ ২০১৯-২০ সালেই এই দায়ের থেকে অনেক বেশি টাকা এই খাতে কর বাবদ আয় করেছে কেন্দ্র! আর চলতি আর্থিক বছরে এই দায় মেটানোর খাতে তো বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ৯৯৮৯.৯৬ কোটি টাকা! তবুও নাগরিকের পকেটে টান বাড়িয়ে কেন পেট্রোপণ্যের দাম লাগাতার বেড়ে চলেছে?
কোভিড চলাকালীন সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পের ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় কেন্দ্রীয় সরকার বলেছিল এই টাকা এক লপ্তে খরচ হবে না। ভাবুন, বাড়ি করতে গিয়ে ঋণ করছেন। প্রথম কিস্তি মেটাতে কষ্ট হলেও আপনি জানেন সময়ের সঙ্গে আপনার আয় বাড়বে। আর কিস্তির দায় আপনার আয়ের আনুপাতিক হিসাবে কমবে।
সরকারও উন্নয়নের স্বার্থে ঋণ করে একই অঙ্কে। সেন্ট্রাল ভিস্তা নিয়ে খরচ প্রসঙ্গে সরকারি যুক্তির ভিত্তিও তাই। কিন্তু সরকার সেন্ট্রাল ভিস্তার খরচ নিয়ে যে যুক্তি দিচ্ছেন, তার ঠিক উল্টো পথে হাঁটছেন পেট্রো বন্ডের দায় চোকানোর দায় মেটানোর যুক্তি নিয়ে।
উন্নয়ন হলে আর্থিক বৃদ্ধি বাড়বে। কর বাবদ আয় বাড়বে। আর ঋণের আনুপাতিক দায়ও কোষাগারের উপর কমবে। কিন্তু দেশের উন্নতি হবে। মানে নাগরিককে রান্না ঘরের খরচ সামলাতে গ্যাসের উনুন ছেড়ে গাছের ডাল কুড়িয়ে পুরনো পন্থায় চাল ফোটাতে হবে না।
কিন্তু আমরা এখন কী দেখছি? ঠিক সেটাই যেটা এই সরকারও দেখতে চায় না বলে দাবি করেছিল। উজ্জ্বলা যোজনার মূল কথাটাই ছিল নারীর ক্ষমতায়ন। সরকারের দাবিও তাই ছিল। দাবি আর বাস্তবের ফারাক এখন এতটাই যে যাঁদের জন্য এই প্রকল্প তাঁদের কথা বাদ দেওয়া যাক, আর্থিক ভাবে তাঁদের উপরের শ্রেণিতে যাঁরা তাঁরাও ওই একই পথে হাঁটার কথা ভাবছেন।
এটা তো একটা উদাহরণ। সামগ্রিক আর্থিক পরিচালন অবস্থা যা তাতে সরকারের নীতির আর উন্নয়নের দাবির মধ্যে বোধহয় একটা বৈষম্য তৈরি হয়েছে। বাজারি অর্থনীতিতেও উন্নয়নের দাবি হল এমন ভাবে নীতি পরিচালনা যাতে নাগরিকের পণ্যের অধিকারে টান না পড়ে। কিন্তু কোষাগার পরিচালনার নীতির মধ্যে কোথাও গিয়ে বোধহয় ব্যবসায়িক নীতিই প্রধান হয়ে উঠছে। তাই এখন আসল প্রশ্ন হল মূল বৃদ্ধির রাস্তায় অর্থনীতি ফিরলেও যে বাজারী বৈষম্য ইতিমধ্যেই বৃদ্ধি পেয়ে যেখানে পৌঁছেছে সেখানে দাঁড়িয়ে নাগরিক তার পণ্যের অধিকার ফিরে পাবে তো? বৃহত্তর উন্নয়নের দাবি না হয় ছেড়েই দিলাম। আসল তর্কটা কি তা হলে বৃদ্ধি বনাম উন্নয়ন নয়? আসল তর্কটা কি তা হলে উন্নয়ন না অবনয়ন তাই নিয়েই?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy