হঠাৎ করে হাতে আসা টাকা বিনিয়োগ করে বেশ খুশি ছিলেন স্বপনবাবু। ভাবছিলেন, মেয়াদ শেষে বেশ মোটা টাকা ঘরে তুলবেন। কিন্তু আসল সময়ে দেখা গেল হাতে টাকা এসেছে প্রত্যাশার চেয়ে কম। কেন এমন হল, তা খুঁজে বার করতে গিয়ে বুঝলেন করের যে হিসেব তিনি করেছিলেন, তা বেশ কয়েক বছরের পুরনো। নতুন নিয়মে পাল্টে গিয়েছে সেই হিসেব। ফলে এখন তুলনায় বেশি কর দিচ্ছে হচ্ছে, হাতে আসছে কম। এমন অবস্থা যাতে আটকানো যায়, সেই পথই খুঁজতে আজকের আলোচনা। দেখে নেওয়া কোন প্রকল্পে লগ্নির পরে মেয়াদ শেষে বা সম্পত্তি বিক্রি করে হাতে আসা টাকায় কী হারে কর দিতে হবে। তার হিসেবই বা হবে কী ভাবে। যাতে শেষ মুহূর্তে ধাক্কা না-লাগে। চলুন দেখি।
শেয়ার
বেশ কয়েক বছর আগে পর্যন্ত শেয়ারে লগ্নির পরে এক বছর ধরে রেখে তা বিক্রি করলে যে মুনাফাই হত না-কেন, তাতে কর লাগত না। কিন্তু দু’তিন বছর হল বদলেছে সেই নিয়ম। এখন—
• কোনও শেয়ার কেনার পরে ১২ মাস ধরে রেখে বিক্রি করলে মুনাফা হলে, সেই লাভকে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ বলা হয়। ২০১৭-১৮ সাল থেকে সেই অঙ্ক ১ লক্ষ টাকার বেশি হলে, তার উপরে ১০% করে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভকর (এলটিসিজি) চাপে।
• একমাত্র সিকিউরিটিজ় ট্রান্জ়াকশন ট্যাক্স (এসটিটি) দেওয়া থাকলে তবেই আয়কর আইনের ১০ (৩৮) ধারায় এই সুবিধা মিলবে।
• তবে এ ক্ষেত্রে ইনডেক্সেশনের (মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিয়ে লাভ হিসেব করা) সুবিধা পাওয়া যাবে না।
• শেয়ার এক দিনের বেশি অথচ ১২ মাসের কম ধরে রেখে বিক্রি করে মুনাফা হলে, লাভের উপরে ১৫% হারে স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভকর (এসটিসিজি) বসে।
• এই অর্থবর্ষ পর্যন্ত ডিভিডেন্ড বাবদ আয় ১০ লক্ষ টাকার মধ্যে হলে কর দিতে হবে না। তার বেশি হলে বসবে ১০% হারে কর।
• তবে এ বারের বাজেটের ঘোষণা অনুসারে, পরের অর্থবর্ষ (২০২০-২১) থেকে যে ডিভিডেন্ডই হাতে আসুক না-কেন, তা বছরে মোট আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আয়করের প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে।
মিউচুয়াল ফান্ড
বাজারে বিভিন্ন ধরনের মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। তার প্রকৃতির উপরে নির্ভর করে করের বদল হয়। যেমন—
শেয়ার ভিত্তিক ফান্ড (ইকুইটি ফান্ড)
• শেয়ারের মতোই ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রেও এক বছরের বেশি সময় ধরে রেখে বিক্রি করলে তা দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ ধরা হবে। একই ভাবে সেই অঙ্ক ১ লক্ষ টাকার বেশি হলে, তার উপরে ১০% কর চাপবে।
• যদি ১ বছরের মধ্যে ফান্ডের ইউনিট বিক্রি করে মুনাফা হয়, তা হলে তার উপরে ১৫% এসটিসিজি বসবে।
ঋণপত্র নির্ভর বা অন্যান্য ফান্ড
• ইকুইটি ছাড়া অন্যান্য ফান্ডের ক্ষেত্রে তিন বছর ইউনিট ধরে রাখার পরে বিক্রি করে মুনাফা হলে তা দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভ হিসেবে বিবেচিত হবে। যার উপরে ২০% হারে কর বসবে। তবে এতে মিলবে ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা।
• ৩৬ মাসের মধ্যে ইউনিট বেচে মুনাফা করলে তা হবে স্বল্পমেয়াদি মূলধনী লাভ। তার উপরে লগ্নিকারীর আয়ের স্তরের ভিত্তিতে কর চাপবে।
• শেয়ারের মতোই এ বছর ফান্ড থেকে ডিভিডেন্ড বাবদ আয় ১০ লক্ষ টাকার মধ্যে থাকলে, কোনও কর দিতে হবে না। কিন্তু পরের বছর থেকে সেই ডিভিডেন্ড আয়ের সঙ্গে যোগ হয়ে কর চাপবে।
সোনা
লগ্নির অন্যতম গন্তব্য হিসেবে সোনার কদর রয়েছে আমাদের মধ্যে। এ ক্ষেত্রেও হাতে আসা সোনা অথবা কাগুজে সোনার উপর নির্ভর করে তাতে কী ধরনের কর বসবে—
• গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (ইটিএফ) এবং গোল্ড ফান্ডের উপরে শেয়ার নয় এমন ফান্ডের হিসেবেই কর বসে।
• গোল্ড বন্ড থেকে প্রাপ্য সুদ লগ্নিকারীর আয়ের সঙ্গে যোগ হয় এবং তার উপরে আয়ের স্তর অনুসারে আয়কর চাপে।
• গোল্ড বন্ড ভাঙানোর সময়ে উৎসে কর (টিডিএস) অথবা এলটিসিজি চাপে না।
• হাতে থাকা সোনার বার-কয়েন বা গয়না বিক্রি করে মুনাফার ক্ষেত্রেও শেয়ার নয় এমন ফান্ডের হিসেবেই কর বসে। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি লাভকরে ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা পাওয়া যায়।
স্থায়ী আমানত ও রেকারিং
• ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে স্থায়ী আমানত ও রেকারিং ডিপোজিটের ক্ষেত্রে সুদ বাবদ আয়ে কর দিতে হয়। তবে এ ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত ছাড় পাওয়া যায়।
• প্রবীণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে একটি অর্থবর্ষে সুদ বাবদ ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয়ে টিডিএস কাটা হয় না।
• অন্যান্যদের ক্ষেত্রে সেই অঙ্ক হতে হবে ৪০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
• স্থায়ী আমানত থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। তার বেশি হলে টিডিএস কাটা হয় না-ঠিকই, কিন্তু পুরোটা আয়কর রিটার্নে দেখাতে হয়।
• যদি ব্যাঙ্কে প্যান দাখিল করা থাকে, সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক নিজে থেকে ১০% টিডিএস কেটে নেবে। আর তা না-থাকলে ২০% কাটবে।
সংস্থার স্থায়ী আমানত
• বছরে ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত সুদে টিডিএস নেই। তার বেশি হলে ১০% হারে কর বসবে।
• তবে এই প্রকল্প থেকে সব সুদকে আয়কর রিটার্নের ফর্মে ‘ইনকাম ফ্রম আদার সোর্সেস’ অংশে দেখাতে হয়।
করমুক্ত বন্ড
• এই বন্ড থেকে মেয়াদ শেষে প্রাপ্য সুদ করমুক্ত।
• ১২ মাসের মধ্যে বাজারে বন্ড বিক্রি করে মুনাফা হলে আয়ের স্তর অনুসারে করের হার ঠিক হবে।
• ১২ মাসের বেশি সময় ধরে রেখে বিক্রি করে মুনাফা হলে দিতে হবে এলটিসিজি। যার হার ১০%। তবে এতে ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা মিলবে না।
নন-কনভার্টিবল্ ডিবেঞ্চার
• ডিম্যাটে রাখা নথিভুক্ত নন-কনভার্টিবল্ ডিবেঞ্চারের (এনসিডি) ক্ষেত্রে উৎসে কর চাপবে না। তা না-হলে একটি অর্থবর্ষে সুদ বাবদ আয় ৫,০০০ টাকা ছাড়ালে কর দিতে হবে।
• এনসিডি বন্ড থেকে পাওয়া সুদের ক্ষেত্রে লগ্নিকারীর আয়ের ভিত্তিতে করের হার ঠিক হবে।
• ডিবেঞ্চার কেনার এক বছরের মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জে সেটি বিক্রি করে যদি লাভ হয়, সে ক্ষেত্রে এসটিসিজি চাপবে। লগ্নিকারী আয়ের ভিত্তিতে তার হার স্থির হবে।
• এক বছরের বেশি কিন্তু মেয়াদ শেষের আগে বিক্রি করে লাভ হলে ১০% হারে এলটিসিজি দিতে হবে। এতে ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা নেই।
জীবন বিমা
জীবন বিমার ক্ষেত্রে করের হিসেবটা একটু জটিল। নিয়ম অনুসারে, কোন সময়ে বিমা করা হয়েছে অথবা তার প্রিমিয়াম এবং বিমার অঙ্কের (সাম অ্যাশিয়োর্ড) উপরে ভিত্তি করে কর দিতে হবে কি না, তা ঠিক হয়।
এনডাওমেন্টের ক্ষেত্রে—
• ২০০৩ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে কেনা যে-সমস্ত পলিসিতে বছরে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিমার অঙ্কের (কভারেজ) ২০ শতাংশের বেশি, সেগুলিই আয়করের আওতায় আসবে। তার কম হলে মেয়াদ শেষে হাতে আসা পুরো টাকাই করমুক্ত।
• যে-সমস্ত পলিসি ২০১২ সালের ১ এপ্রিলের পরে কেনা সেগুলিতে বছরে প্রিমিয়ামের পরিমাণ বিমার অঙ্কের (সাম অ্যাসিওর্ড) ১০ শতাংশের বেশি হলেই তা করের আওতায় পড়বে। এ ক্ষেত্রেও তার কম হলে মেয়াদ শেষের পরে মেলা টাকা করমুক্ত।
• ২০১৩ সালের ১ এপ্রিলের পরে নেওয়া পলিসির ক্ষেত্রে আয়কর আইনের ৮০ইউ এবং ৮০ডিডিবি ধারায় বলে দেওয়া নির্দিষ্ট রোগ অথবা অক্ষমতা থাকা ব্যক্তির বিমার প্রিমিয়াম হতে হবে সাম অ্যাশিয়োর্ডের ১৫ শতাংশের বেশি। কম হলে আগেরগুলির মতোই হাতে মেলা টাকা করমুক্ত থাকবে।
• পলিসি বন্ধক রেখে ধার নিলে, সেই টাকার উপর কর দিতে হবে না।
• টিডিএস দিতে হবে না পলিসি ‘পেড-আপ’ (প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ) করলেও।
• নির্ধারিত সময়ের আগে পলিসি সারেন্ডার করলে (প্রিমিয়াম দেওয়া বন্ধ করে টাকা তুলে নেওয়া) অবশ্য কর লাগবে। তবে সে ক্ষেত্রেও সাম অ্যাশিয়োর্ড এবং বিমার প্রিমিয়ামের অনুপাত হিসেব করে কর দিতে হবে কি না, তা ঠিক হবে।
• ২০০৩ সালের ১ এপ্রিলের আগে কেনা কোনও পলিসির ক্ষেত্রেই কর লাগবে না। অর্থাৎ, সেগুলিতে মেয়াদ শেষের পরে পুরো টাকাই মিলবে। বার্ষিক প্রিমিয়াম বিমার অঙ্কের যত শতাংশই হোক না-কেন।
• কোনও বছরে আয়কর আইনের ১০ (১০ডি) ধারায় আওতায় না-থাকা পলিসিগুলি থেকে হাতে আসা টাকার পরিমাণ ১ লক্ষের বেশি হলে, তার উপরে ৫% টিডিএস দিতে হবে। যা আয়কর রিটার্ন থেকে ফেরতের আর্জি জানানো যেতে পারে।
• এক লক্ষ টাকার কম হাতে এলে টিডিএস কাটবে না। তবে লগ্নিকারীকে কর দিতে হতে পারে।
ইউলিপের ক্ষেত্রে—
• এ ক্ষেত্রেও এনডাওমেন্টের মতোই কর হিসেব হয়। যদি বিমার অঙ্ক ও প্রিমিয়ামের অনুপাতের সমস্ত শর্ত পূরণ হয়, তা হলে কোনও কর দিতে হবে না।
• বিমাকারীর মৃত্যু হলে নমিনির হাতে আসা টাকা করমুক্ত।
• পলিসি চালুর পরে পাঁচ বছরের মধ্যে তা সারেন্ডার করলে, হাতে আসা টাকা ওই বছরের আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং সেই অনুসারে কর দিতে হবে। পাঁচ বছরের পরে কিন্তু মেয়াদ শেষের আগে পলিসি সারেন্ডার করলে হাতে আসা টাকায় কোনও কর বসবে না।
স্থাবর সম্পত্তি
• জমি বা বাড়ি-ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে ২৪ মাস বা তার আগে বিক্রি করে মুনাফা হলে, তা স্বল্পমেয়াদি লাভ হিসেবে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে বসে এসটিসিজি। যার হার স্থির হয় বিক্রেতার আয়ের স্তরের উপরে ভিত্তি করে।
• ২৪ মাসের বেশি দিন ধরে রেখে বেচার ক্ষেত্রে লাভ হলে ২০% হারে দীর্ঘমেয়াদি মূলধনী লাভকর দিতে হয়। এতে ইন্ডেক্সেশনের সুবিধা মেলে। সে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বছরের ভিত্তিতে ওই ইনডেক্সেশন ঠিক হয়।
• তবে খেয়াল রাখতে হবে যে, এই ২৪ মাসের সময়সীমা মানা হবে যদি সম্পত্তি ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের পরে বিক্রি করা হয়। তার আগে হলে কিন্তু এই সময়সীমা হবে ৩৬ মাস।
• বাড়ি ভাড়া বাবদ আয় মালিকের আয়ের সঙ্গে যুক্ত হয় এবং সেই স্তরের ভিত্তিতে করের হার ঠিক হয়।
• বাড়ি ভাড়া বাবদ অফিস থেকে প্রাপ্য ভাতা (হাউস রেন্ট অ্যালাওয়েন্স বা এইচআরএ) অথবা বাড়ি ভাড়া বাবদ মাসে ৫০,০০০ টাকার বেশি হলে ৫% টিডিএস কাটা হবে।
• বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দর ৫০ লক্ষের বেশি হলে ক্রেতাকে ১% টিডিএস দিতে হবে।
• বাড়ি-ফ্ল্যাটের সরকারের ঠিক করা দাম (ভ্যালুয়েশন) যদি ১০ লক্ষ টাকার বেশি হয়, তা হলে প্যান উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক।
• স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে হওয়া মুনাফা যদি ৫৪ইসি বন্ডের মতো প্রকল্পে লগ্নি করা হয় অথবা ওই টাকা দিয়ে দ্বিতীয় কোনও বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনা হয়, সে ক্ষেত্রে ওই মুনাফার উপরে কর দিতে হয় না। তবে সে ক্ষেত্রে পাঁচ বছর লগ্নি ধরে রাখতে হবে।
• সম্পত্তি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তার চেয়ে সরকার নির্ধারিত মূল্য (স্ট্যাম্প ডিউটি নির্ধারণের জন্য) যদি ৫ শতাংশের বেশি না-হয়, তখন দলিলের মূল্যকেই দাম ধরা হবে। তার ভিত্তিতে কর হিসেব হবে।
• আর সরকার নির্ধারিত দাম যদি ৫ শতাংশের বেশি হয়, তা হলে সেটিকেই সম্পত্তির হস্তান্তর মূল্য ধরে কর বসবে।
লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy