বাজার চাঙ্গা হওয়ায় আশার আলো দেখছে অর্থমন্ত্রক। ছবি: পিটিআই
সোমবার কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ২০২১-২২ সালের বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন। এই দেশে কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের অপরিসীম গুরুত্ব আছে। এই বার্ষিক অনুশীলন ভবিষ্যতের রাজকোষ নীতি বা ফিসকাল পলিসি-র অভিমুখ বলে ধরা হয়। আর তাই এ বারও আগের প্রতিটি বাজেটের মতোই উন্মুখ হয়ে আছি ১ ফেব্রুয়ারির ওই ক্ষণটির জন্য। অতিমারির প্রেক্ষিতে এ বার তো আগ্রহ আরও বেশি। গোটা বিশ্ব ও দেশের অর্থনীতি অতিমারি ও মন্দায় জর্জরিত। মাথায় রাখতে হবে যে আর্থিক নীতির রূপরেখা অর্থনীতির অবস্থানের উপর নির্ভর করে। আর এই অভূতপূর্ব মন্দার প্রেক্ষিতে এই বাজেট নিয়ে আগ্রহও যে অভূতপূর্ব হবে তাতে আর সন্দেহ কি?
প্রশ্ন হল, দেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থাটা কেমন? এখানে আমি জটিল অঙ্ক কষে দুরূহ মডেল সহযোগে বর্তমানের বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতের কথা বলতে চাইছি না। অতীতের গর্ভে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্ম। তাই করোনা আঘাত কতখানি তীব্র তা বোঝার জন্য অতিমারির ঠিক আগে বিশ্ব ও ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা বোঝা প্রয়োজন। সেই অবস্থাই বর্তমানের অর্থনৈতিক দুর্দশা, নীতিনির্ধারণ ও আগামী দিনের আর্থিক গতিপ্রকৃতির দিক নির্ণয় করবে। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে এখন আর্থিক বৃদ্ধির বিচার করার জন্য জিডিপি-র নতুন, কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ, পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়।
ভারতের বৃদ্ধির হার প্রত্যেক ত্রৈমাসিকে ক্রমান্বয়ে পিছু হটেছে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের শেষ ত্রৈমাসিকে সর্বনিম্ন ৩.১ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। এই হ্রাস অবশ্য বেশ দীর্ঘমেয়াদি। গত দশকের শুরু থেকেই অর্থনীতির চাকা শ্লথ, বৃদ্ধির হার বারবার ওঠানামা করেছে। এরই মধ্যে ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে শীর্ষে পৌঁছেছিল বৃদ্ধির হার, তার পর থেকেই নিম্নমুখী গতি অব্যাহত। দেখা যায় ২০১৬ সালের পরে হ্রাস আগের বৃদ্ধির তুলনায় অনেক বেশি তীব্র এবং বৃদ্ধির বক্ররেখা একটি বিপরীত ভি-আকৃতির (নীচের লেখচিত্র দ্রষ্টব্য)। বৃদ্ধির এ ধরনের হ্রাস দেশের দৈর্ঘ ও প্রস্থ জুড়ে। এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ২০১৯-এর শুরু থেকে লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি, যা মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বা ইনফ্লেশন টার্গেটিং-এর সহনশীলতা-সীমা অতিক্রম করেছে।
লকডাউন ভারতের অর্থনীতির এই মন্থর গতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এক দিকে যেমন কাজের দিন কমে যাওয়ায় আয় কমল আর চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকল, অন্য দিকে উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় জোগান হ্রাস পেল। মহামারিজনিত লকডাউন ও পরবর্তী সময়ে, মানে এই অর্থবর্ষে, বৃদ্ধির হারের হ্রাস তাই অব্যাহত আছে। বৃদ্ধির হার শূন্যের অনেক নীচে। প্রথম ত্রৈমাসিকের প্রায় - ২৪ শতাংশের পরে দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকেও – ৭.৫ শতাংশ। বাকি দুই ত্রৈমাসিকে হারটি শূন্যের তলাতেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও বিভিন্ন সূচকের ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক বাজার নিয়ে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু তা আলেয়া কিনা সময়ই বলবে। লকডাউনে চাহিদা কম থাকায় মূল্যবৃদ্ধি খানিকটা হলেও স্তিমিত, কিন্তু এই সময়ে জোগান অপ্রতুল থাকায় তা সহ্যসীমা লঙ্ঘন করবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। লকডাউনের কথা মাথায় রেখেই বলি, ধারাবাহিক এই বৃদ্ধির হ্রাস কাঠামোগত। লকডাউন আগুনে ঘৃতাহুতি মাত্র, বৃদ্ধির হ্রাসকে তীব্র করতে ইন্ধন জুগিয়েছে। তাই এক দিকে স্বল্পকালীন নীতির যেমন প্রয়োজন আছে, অন্য দিকে সংস্কারও অপরিহার্য।
শুধু কি বৃদ্ধির হার কমেছে? মানুষ কর্মহীন হয়েছেন, পরিযায়ী শ্রমিক দীর্ঘ সময়ের জন্য কর্মচ্যুত হয়ে পথে বসেছেন। বেরোজগারির জন্য বেশিরভাগ মানুষের মাসিক আয় সঙ্কুচিত হয়েছে। তাই দিন যাপন করার জন্য সবারই জমানো পুঁজিতে হাত পড়েছে। যাঁরা দারিদ্রসীমাকে ইদানিং কালে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন, রোজগার না থাকায় আবার দরিদ্র হয়েছেন। যাঁরা দরিদ্র ছিলেন, তাঁরা হয়েছেন দরিদ্রতর। অন্য দিকে, এক নতুন নিরীক্ষাভিত্তিক তথ্য বলছে, এই সময়ে ভারতবর্ষে ধনীদের আয় ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এই বছরে আর্থিক বৈষম্য বাড়ারও তাই সমস্ত ইঙ্গিত পাচ্ছি। মানুষের খাদ্যসংস্থান, বিশেষ করে লকডাউন ও পরবর্তী কিছু সময়ে, ছিল না বললেই চলে। খাদ্যসুরক্ষা আইন আছে। কিন্তু মানুষ, বিশেষত দীনদরিদ্র ও ক্ষুধার্তরা, খাদ্য ও পুষ্টির নিরিখে কতখানি সুরক্ষিত?
আর সরকারি কোষাগারের অবস্থা? অতিমারি সামলাতে গিয়ে অর্থভাণ্ডারের হাল খারাপ। ক্ষমতার বাইরে গিয়ে সরকার ব্যয় করেছেন, অন্য দিকে সরকারের আয় অনেকটা কমেছে। ফলে এই অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষ ঘাটতি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করবেই ও ঋণের বোঝা বাড়বেই। এই হিসাব রাজ্যগুলির সামগ্রিক রাজকোষ ঘাটতি ধরা হয়নি! এই দীর্ঘ আর্থিক মন্দা থেকে মুক্তির উপায় কী? স্বাভাবিক ভাবেই আশা করা যায় যে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন না করলে দুর্দশাগ্রস্ত অর্থনীতির হাল আরও খারাপ হবে। এই রকম আপেক্ষিক ধীরগতিতে যখন অর্থনীতি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, প্রাথমিক ভাবে দরকার ব্যবস্থাপনা, বিশেষত সরকারি ব্যয়, যা অর্থনীতিকে খানিক চাঙ্গা করবে। ইদানীং অবশ্য ভারতবর্ষ-সহ অন্যান্য দেশ নিউ কনসেনশাস ম্যাক্রোইকনমিক্স ও মুদ্রানীতি দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। অতিমারির সময়ে কি তার অন্যথা হবে?
যদিও ভারতের বৃদ্ধি ব্যক্তিগত ব্যয় ও বিনিয়োগ নেতৃত্বাধীন, ব্যক্তিগত উপভোগের খরচ এখন তলানিতে, বেসরকারি বিনিয়োগের সম্ভবনাও কম। এই মন্দাবস্থায় সাধারণত চাহিদা পুনরুজ্জীবিত হয় সরকারি ব্যয়ের সাহায্যে। আর তখনই বেসরকারি বিনিয়োগ ও সামগ্রিক চাহিদা চাঙ্গা হয়। যদিও বিশ্বায়ন পরবর্তী কালে বহির্বাণিজ্য গুরুত্ব পেয়েছে, কিন্তু এই সময়ে তা বৃদ্ধির চালিকাশক্তি হতে পারে না। কারণ মন্দা তো বিশ্ব জুড়েই।কেন্দ্রীয় সরকার কেমন করে এই মন্দার মোকাবিলা করলেন? লকডাউনের শুরুতে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করলেন। ভারতকে ‘আত্মনির্ভর’ করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে অর্থনীতিকে, বিশেষ করে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে চাঙ্গা করতে ঘোষণা করা হল ঋণনীতি। সঙ্গে এল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিস্তৃত ও গভীর সংস্কার। এই সব ঘোষণার কিছু দিন পরেই মান্থলি ইকনমিক রিভিউ–তে দাবি করা হল যে শুকিয়ে যাওয়া অর্থনীতিতে গ্রিন স্যুট বা ঘুরে দাঁডানোর সঙ্কেত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্ত তাতে সবুজ পাতা ধরার আগেই তা আবার শুকিয়ে গেল! এই দশ মাসে মুদ্রানীতি, ঋণনীতি ও সংস্কারের মাধ্যমে দশ মণ তেল পুড়ল, ইজ অফ ডুয়িং বিজনেস-এ ক্রমে ভারতের স্থান উপরে উঠল, কিন্তু দেশের আর্থিক অবস্থা ফেরার লক্ষণ দেখা গেল না। আরও নাজেহাল হল। ঋণগ্রস্ত ও দুর্দশায় জর্জরিত অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ঋণগ্রহণে অক্ষম থেকে গেল। নয়া স্বাভাবিক (নিউ নর্মাল) পরিস্থিতিতে শিল্প ও পরিষেবার বিকাশ ও কর্মসংস্থান আশানুরূপ বাড়ল না। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক জরিপ করতে পারেনি। ভাবা হয়েছে লকডাউনে সরবরাহ বাধাগ্রস্থ হওয়ার জন্য ব্যবসার বিস্তার হয়নি। এই ভাবনা আংশিক সত্য মাত্র। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে জোগান ব্যবস্থায় সংস্কার ও স্বাভাবিক সরবরাহের সঙ্গে চাহিদা বাড়ানোর দিকে যথেষ্ট নজর দেওয়া উচিত ছিল।
তা হলে বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য কী?এই বাজেটে চাহিদার উন্মেষই একমাত্র করণীয়। তবে চাহিদা সামলানো বিষয়টি চ্যালেঞ্জের, বিশেষত সরকারী রাজস্ব যখন তলানিতে! এই অবস্থায় আরও সরকারি ব্যয় বৃহত্তর আর্থিক ঘাটতির ঝুঁকি এনে দেবে! তাই কী সরকার এই পথে না হেঁটে বিকল্প রাস্তা খুঁজেছিলেন? জনসমূহের ঋণের বোঝা বাড়লেও, মন্দার সময়ে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি ও চাহিদার উন্মেষ অপরিহার্য পদক্ষেপ। এই রাস্তায় হাঁটলে, বাজেটের উপকরণ কী কী হতে পারে?
প্রথম, যদিও মন্দাকালীন সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি বলতে বেশিরভাগ সময়ে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বোঝায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের সঙ্গে স্বল্পকালীন ব্যয়ও থাকা বাঞ্ছনীয়। এই স্বল্পকালীন ব্যয়ে যেমন এক দিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দান-খয়রাতি থাকবে, অন্য দিকে এমন কিছু স্বল্পকালীন প্রকল্প থাকবে যাতে কর্মদিবস তৈরি হবে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ যাবে পরিকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায়। দ্বিতীয়, দ্রুত আর্থিক পুনরুদ্ধারের জন্য গ্রামীণ ও নগর উভয় ক্ষেত্রের কর্মসূচিতে ব্যাপক ব্যয়বৃদ্ধি একান্ত প্রয়োজন। যেমন মহাত্মা গাঁধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান প্রকল্পে ব্যয়বরাদ্দ আরও বাড়ানো নিশ্চিত ভাবে প্রয়োজন, অন্য দিকে তেমনই শহরাঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এখন আবশ্যিক। তৃতীয়, বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য পরিষেবার, বিশেষত জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য পরিকাঠামো, অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। চতুর্থ, মহামারি পরবর্তী সময়ে কাজের ধারা পাল্টানোর প্রেক্ষিতে স্বয়ংচলন বা অটোমেশন-এর প্রসার ও সেই সংক্রান্ত দক্ষতা অর্জনে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি দরকার। তালিকায় এই রকম আরও অনেক ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধির কথা বলা যায়। কিন্তু, বাধ সাধবে এফআরবিএম আইন। অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে গেলে শূন্য রাজস্ব ঘাটতি ও নিয়ন্ত্রিত রাজকোষ ঘাটতি থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা উচিত। কিন্তু অর্থমন্ত্রী এই বিশাল দায়ভার বহন করতে সক্ষম হবেন তো?
অতিমারি পরবর্তী সময়ে সারা পৃথিবী আবার এক ‘রাজস্বঘটিত ঐক্যমত্য’ বা ‘ফিস্কাল কনসেনশাস’-এর দিকে এগোচ্ছে, ভারতবর্ষে কি তার অন্যথা হবে? উপসংহারে বলা যায়, এই বাজেটে আর্থিক বৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে বাজেট প্রস্তাবের পরেও আর্থিক পুনরুদ্ধার অধরা থাকবে। অন্য দিকে এই জনসমূহের ব্যয়কে সঙ্কুচিত করা মানেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে আরও পিছিয়ে দেওয়া। অর্থনীতি স্থিতিশীল হলেই প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যেতে পারে, নচেৎ নয়।
(লেখক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy