তাৎক্ষণিক হতাশা। বাজেটের পরে বাজার।
বাজেট বাজারের আশা পূর্ণ করতে পারেনি। বাজেটের জাদুদণ্ড হাতে নিয়ে জেটলি রাতারাতি অর্থনীতির ভোল পাল্টে দেবেন, নানা রকম ছাড়ে ভরিয়ে দেবেন এবং ‘টপ গিয়ারে’ নিয়ে যাবেন সংস্কারের কাজ এমনটাই আশা করেছিল শেয়ার বাজার। যাতে ভর করে সেনসেক্স পৌঁছে গিয়েছিল ২৬ হাজারে। কিন্তু সূচক সেই উত্থান আর ধরে রাখতে পারেনি বাজেট পেশ হওয়ার পরে। অর্থনীতির আকাশে নানা স্তরে মেঘ থাকায় অরুণ জেটলির প্রথম বাজেট তেমন ভাবে অরুণোদয় ঘটাতে পারেনি। বাজার চেয়েছিল রাতারাতি ম্যাজিক। সরকারের বক্তব্য সবই হবে, তবে সময় লাগবে।
রেল এবং মূল বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় সেনসেক্স এরই মধ্যে ১,০০০ পয়েন্ট পড়েছে। বাজেটের মুখে যাঁরা শেয়ার বিক্রি করে লাভ ঘরে তোলেননি, তাঁরা নিশ্চয়ই এখন আফসোস করছেন। লোভকে সব সময়েই একটি সীমার মধ্যে বেঁধে রাখতে হবে। তা না-হলে গাছের পাকা ফল গাছেই পচে নষ্ট হবে।
এ বার এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, বাজার কেন এতটা হতাশ হয়েছে জেটলির প্রথম বাজেট প্রস্তাবে।
• যেমন আশা করা হয়েছিল, আর্থিক সংস্কারকে তেমন গতি দেওয়ার প্রস্তাব নেই। এ ব্যাপারে প্রথম বাজেটেই জেটলি তেমন বেশি সাহসী হতে পারেননি।
• অতীত দিন থেকে কার্যকর করা আয়কর আইনকে পুরোপুরি রদ করা হয়নি। এর ফলে কোনও সদর্থক বার্তা পৌঁছে দেওয়া যায়নি বিদেশি লগ্নিকারীদের দফতরে।
• অনেক ক্ষেত্রেই ভর্তুকি বহাল রাখা হয়েছে।
• ব্যক্তিগত করদাতাদের যতটা কর ছাড় দেওয়া হয়েছে, তার কতটা বাজারে আসবে তা নিয়ে সংশয় আছে। চড়া পণ্যমূল্য, বর্ধিত রেল ভাড়া এবং তেলের মূল্যবৃদ্ধিই খেয়ে নেবে কর সাশ্রয়ের সিংহভাগ।
• দেশের লগ্নিকারীদের ইক্যুইটি বাজারে টেনে আনার কোনও চটকদারি প্রস্তাব বাজেটে নেই। চিদম্বরমের আনা রাজীব গাঁধী ইক্যুইটি প্রকল্প আদৌ তেমন সাফল্য পায়নি।
• পিপিএফে বার্ষিক লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা ৫০,০০০ টাকা বাড়ানো হলেও এই টাকা কিন্তু শেয়ার বাজারে প্রবাহিত হবে না।
• ব্যাঙ্কিং-সহ কয়েকটি শিল্প হতাশ বাজেট প্রস্তাবে।
• ‘কর-ফাঁকি আইন আগামী বছর থেকে চালু হতে পারে’ এক মন্ত্রীর এই বক্তব্য আশঙ্কা ছড়ায় বাজারে।
ছোট মেয়াদে বাজার পড়েছে কমবেশি ৪%। এটি কিন্তু আদৌ তেমন বড় পতন নয়। এতটা উঁচু বাজারে যে-কোনও সংশোধনে এই মাপের পতন হতেই পারে। আর এই পতন পুরোটাই বাজেটের জন্য হয়েছে, তা-ও মনে করার কারণ নেই। বিশ্বকাপে বিপর্যয়ের পরে দেশের অর্থনীতিতেও বিপর্যয় দেখা দিয়েছে রোনাল্ডোর দেশে। পর্তুগালের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক ব্যাঙ্কো এস্পিরিতো স্যান্তো দায় মেটাতে ব্যর্থ হওয়ায় আবার আশঙ্কার মেঘ দেখা দেয় বিশ্ব বাজারে। অল্প হলেও এর প্রভাব ভারতীয় বাজারেও পড়ে।
তবে একটু দীর্ঘ মেয়াদের কথা মাথায় রেখে জেটলির বিভিন্ন প্রস্তাবকে বিশ্লেষণ করলে বিজেপি সরকারের প্রথম বাজেটকে হয়তো ততটা খারাপ লাগবে না। বরং কিছুটা গঠনমূলক বলেই মনে হবে। তাৎক্ষণিক উত্তেজনা সৃষ্টিকারী তেমন মশলা বাজেটে না-থাকলেও লম্বা মেয়াদে বাজারের জন্য অনেক কিছুই আছে ২০১৪-’১৫-র বাজেটে। এ বার সেগুলি দেখব এক নজরে।
• প্রতিরক্ষা এবং বিমা শিল্পে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা ২৬% থেকে বাড়িয়ে ৪৯% করার প্রস্তাব। আশা, এই প্রস্তাব কার্যকর হলে বিমা শিল্পে এফডিআই বর্তমানের ৬,০০০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২০-র মধ্যে পৌঁছে যাবে ৫০,০০০ কোটিতে। কর্মসংস্থান ২ লক্ষ থেকে বেড়ে হতে পারে ৬ লক্ষ।
• পরিকাঠামো শিল্পে ঢালাও বরাদ্দ। এর ফলে দ্রুত উন্নতি ঘটবে দেশের নানা পরিকাঠামোয়, যা শিল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে বাড়বে কর্মসংস্থান।
• রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় বিলগ্নিকরণের পথে মোটা টাকা সংগ্রহ। শেয়ার বাজারের কাছে এটি একটি বড় সুখবর।
• গৃহনির্মাণ শিল্পকে চাঙ্গা করার প্রয়াস। গৃহঋণের সুদের উপর অতিরিক্ত করছাড় দেওয়ার ফলে এই শিল্পে চাহিদা বাড়বে। এই শিল্পে উৎপাদন বাড়লে তা চাহিদা বৃদ্ধিকরবে ইস্পাত, সিমেন্ট, অ্যালুমিনিয়াম-সহ আরও বেশ কয়েকটি শিল্পে। আর তার পাশাপাশি বাড়বে কর্মসংস্থানও।
• মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য ভাল বরাদ্দ।
• একই কেওয়াইসি দিয়ে এ বার থেকে সব রকম আর্থিক লেনদেন করার সুবিধা।
• বিভিন্ন ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ দ্রুত কমিয়ে আনার ব্যবস্থা।
• শুল্ক ছাড় দেওয়ার কারণে কয়েকটি শিল্পে সুদিন ফেরার সম্ভাবনা।
• দেশে বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ বাড়াতে কর ব্যবস্থার সরলীকরণ। এ দেশে লগ্নিতে লাভ হলে তা মূলধনী লাভ হিসেবে গণ্য হবে ও তার উপর কর দিতে হবে ১৫% হারে।
• শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রে মোটা টাকা বরাদ্দ।
এক কথায় গোটা অর্থনীতির উন্নতির জন্য সব কিছুর উন্নতি প্রয়োজন। আর সে সবেরই রসদ আছে এই বাজেটে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ভালর পাল্লাটাও কিন্তু কম ভারী নয়। সব দেখে মনে হবে, সরকারের সদিচ্ছা এবং প্রয়াস দুই-ই আছে। উন্নয়নের দিশা অবশ্যই আছে, তবে রাতারাতি ভোল পাল্টে যাবে এমন অসম্ভব আশা কখনওই করা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, সরকার ক্ষমতায় এসেছে মাত্র দেড় মাস আগে। এত বড় দেশের নানা জটিল সমস্যা বুঝতেই তো কম করে বছরখানেক চলে যাবে। আর মাত্র ৯ মাস বাদেই পরের বাজেট। আশা করা যায়, ২০১৫-’১৬ সালের বাজেট হবে অনেক বেশি পরিণত, বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সব দিক থেকে দেখলে মাঝারি থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বাজারের হতাশ হওয়ার কথা নয়। হাওয়ায় ভর করে সূচক অনেকটাই উঠেছিল। এ বার তাকে একটু সময় দিতে হবে পরিস্থিতি অনুযায়ী যথাযথ জায়গায় পৌঁছে যেতে। তার পর আমরা আবার উত্থান দেখতে পাব। দুটো-একটা চমকে নয়, গোটা অর্থনীতির অগ্রগতিতে ভর করে যদি সূচক ওঠে, তবে তা স্থায়িত্ব পায়। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে না।
বাজেট নিয়ে লগ্নিকারীদের মনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকলেও শুক্রবার থেকেই বাজার আবার ভাল খবর পেতে শুরু করেছে। ফলাফলের মরসুমের গোড়াতেই ভাল খবর পেশ করেছে অগ্রণী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিস। আশার তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে আয় এবং লাভ দুই-ই। প্রথম ত্রৈমাসিকে সংস্থার মুনাফা ২১.৬% বেড়ে পৌঁছেছে ২,৮৮৬ কোটি টাকায়। ইপিএস অতিক্রম করেছে ৫০ টাকা। তাদের আশা, ২০১৪-’১৫ সালে কোম্পানির আয় বাড়তে পারে ৫.৬% থেকে ৭.৬%। গোটা বাজারে ধস নামা সত্ত্বেও শুক্রবার এই খবরে চাঙ্গা ছিল তথ্যপ্রযুক্তি শেয়ারগুলি। আর একটি ভাল খবর হল শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি। মে মাসে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে ৪.৭%, যা গত ২০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। উন্নতি ঘটেছে খনন, কারখানার উৎপাদন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, মূলধনী পণ্য উৎপাদন ইত্যাদির মতো নানা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে।
আশা করা যায়, এই জোড়া ভাল খবর সোমবার চাঙ্গা রাখবে শেয়ার বাজারকে। বাজেটের পরে এ বার বাজারের নজর থাকবে কোম্পানি ফলাফল এবং বর্ষার গতিবিধির উপর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy