করের গুঁতো বোধহয় একেই বলে। প্রিয় মানুষের কাছ থেকে উপহার পেয়েও আনন্দে ভেসে যাওয়ার উপায় নেই। বরং ভয়ে ভয়ে খাতা-কলম-ক্যালকুলেটর টেনে বসতে হয় এটা দেখার জন্য যে, সেই পাওয়ার বিনিময়ে আপনাকে কত টাকা দিতে হবে রাজকোষে! কর গোনার বাধ্যবাধকতা হিসেবে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব হোক বা শুভানুধ্যায়ী, প্রয়োজনে যদি কেউ কাউকে কিছু দেন, তাতেও বিঁধে থাকতে পারে কর-কাঁটা। যা অস্বস্তিকর। কিছু ক্ষেত্রে সমস্যারও।
তবে সব উপহার বা দানেই যে কর দিতে হয়, এমন নয়। করছাড়ের সুযোগ রয়েছে এখানে। রয়েছে করের বোঝা হালকা করার নিয়ম-কানুন। তাই উপহার বা দান গ্রহণের আগে বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকুন। কার থেকে পাচ্ছেন, কখন বা কেন এবং সর্বোপরি কতটা— দান-করের হিসেব-নিকেশ হয় এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর মিলিয়ে। দাতা দান করে ছাড় পেলেন, অথচ গ্রহীতা কর দিতে দিতে হয়রান— এই পরিস্থিতিও এড়ানো যাবে সে ক্ষেত্রে। আজ তাই এই বিষয়টিতেই চোখ রাখব আমরা—
আইন বলছে...
আগে উপহার বা দানের উপর কর বসত ১৯৫৮ সালের গিফ্ট ট্যাক্স অ্যাক্ট অনুযায়ী। কিন্তু তা এখন অবলুপ্ত। পরিবর্তে আয়কর আইনের ৫৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে এই করের খুঁটিনাটি। যেখানে চোখ রাখলে পরিষ্কার হয়ে যায়—
• ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দান করমুক্ত
• বিনিময়ে কিছু না-দিয়ে কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে যদি ৫০ হাজার টাকার বেশি মূল্যের কিছু (নগদ অথবা পণ্য) পাওয়া যায়, তবে তার পুরোটাই (কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া) করযোগ্য
• ৫০,০০০ টাকা পেরোলে করযোগ্য দান বা উপহার প্রাপকের অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত আয়ের সঙ্গে যোগ হয় এবং তার উপর কর দিতে হয় প্রযোজ্য হারে
• স্থাবর সম্পত্তি দান হিসেবে পাওয়া গেলে (কয়েকটি ক্ষেত্র বাদে), তার স্ট্যাম্প ডিউটির জন্য যে সরকারি মূল্যায়ন হবে, তা অন্যান্য সূত্র থেকে আয় হিসেবে ধরা হবে
• বিনামূল্যে প্রাপ্ত কোনও সম্পত্তির বাজার দর (ফেয়ার মার্কেট ভ্যালু) ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে, তার পুরোটার উপরেই কর বসবে
আরও পড়ুন: নোটবন্দির নাকচে কোপ দেশের জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিতে
চিন্তা নেই যেখানে
কিছু কিছু দান বা উপহার আছে, যেগুলি হাতে এলে কর-চিন্তার ছায়া পড়ে না। এ ক্ষেত্রে তার পরিমাণ যা-ই হোক না কেন। তাই প্রিয়জনের উপহারই হোক বা প্রয়োজনের দান, কোথা থেকে তা ঝুলিতে এল বা কে দিলেন, চিন্তামুক্ত থাকতে সেটা জানা জরুরি। যেখান থেকে নগদ বা পণ্য দান অথবা উপহার হিসেবে পেলে করের প্রশ্নই ওঠে না, সেগুলি হল—
• কোনও আত্মীয়ের (সঙ্গের সারণিতে দেওয়া হল আত্মীয় বলতে কাদের বোঝায়) থেকে
• বিয়ের সময়ে
• উইল মারফত
• দাতার মৃত্যুকালীন ইচ্ছে অনুযায়ী
• কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা লোকাল অথরিটির (যেমন পুরসভা) তরফে
• আয়কর আইনের ১০ (২৩সি) ধারায় তালিকাভুক্ত কোনও ফান্ড ফাউন্ডেশন, বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ট্রাস্ট ইত্যাদি থেকে অনুদান হিসেবে
• ১২এএ ধারায় নথিবদ্ধ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে
ছাড়ের সুযোগ
যুগ যুগ ধরে সমাজে দানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। যাঁদের অনেক অর্থ আছে ও যাঁদের প্রয়োজন রয়েছে, সেই দুইয়ের মধ্যে সেতু গড়ে দেয় দান। বহু মানুষ রয়েছেন, যাঁরা নিজের সম্পদের কিছুটা ভাল কাজে বা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে খুশি মনে দেন। তাঁদের সুবিধা করে দিতে এবং আরও বেশি মানুষকে দানে উৎসাহী করতে কিছু করছাড়ের ব্যবস্থা করেছে সরকারও। সে ক্ষেত্রে কোন ধরনের সংস্থায় কতটা দান করলে কত শতাংশ করছাড় পাওয়া যাবে, তা বলা রয়েছে আয়কর আইনের ৮০জি ধারায়।
এগুলি হল—
• সরকার অনুমোদিত কিছু ফান্ড এবং প্রতিষ্ঠানে যত টাকাই দান করুন না কেন, তার ১০০ শতাংশের উপর করছাড় মেলে। যেমন, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় ত্রাণ তহবিল, জাতীয় প্রতিরক্ষা তহবিল ইত্যাদি
• সরকার অনুমোদিত কয়েকটি ফান্ড এবং প্রতিষ্ঠানে যত টাকাই দিন না কেন, দানের ৫০ শতাংশের উপর পাওয়া যায় করছাড়। এর মধ্যে আছে জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল ফান্ড, প্রধানমন্ত্রীর খরা ত্রাণ তহবিল ইত্যাদি
• আয়কর দফতর অনুমোদিত কোনও বেসরকারি দাতব্য ট্রাস্টে দানের ৫০ শতাংশের উপর করছাড় পাওয়া যায়। শর্ত, দানের পরিমাণ দাতার মোট আয়ের ১০ শতাংশের বেশি হবে না। তবে নগদে দান হিসেবে কোনও সংস্থা ও রাজনৈতিক দলকে ২,০০০ টাকার বেশি দেওয়া যাবে না।
এ ছাড়া, এই ধারার বাইরে আয়কর আইন স্বীকৃত আত্মীয়রা বাড়ি, জমি, ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পত্তি লিখিত ভাবে দান করলে, কর দিতে হয় না প্রাপককেও। এ ক্ষেত্রে দলিলের উপর তাঁর স্ট্যাম্প ডিউটি পড়বে সরকারি মূল্যায়নের মাত্র ০.৫%। রেজিস্ট্রেশন ফি লাগবে ১.১%। আর অনাত্মীয়ের ক্ষেত্রে সম্পত্তি উইল মারফত পেলে চিন্তা নেই।
পথ সাশ্রয়েরও
কাছের লোককে উপহার দিয়ে বা দান করেও পরোক্ষে কর সাশ্রয় সম্ভব।
• যেমন, বাবা/মা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ের পড়াশোনা চলানোর খরচ বাবদ প্রতি মাসে টাকা না দিয়ে, থোক নগদ দান হিসেবে সন্তানের অ্যাকাউন্টে জমা করতে পারেন। এই টাকায় প্রাপ্ত সুদ দিয়ে সেই পড়াশোনা চলতে পারে। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাটা বেরিয়ে যাওয়ায় বাবা/মাকে আর তার সুদে কর গুনতে হবে না। একটি সাধারণ চিঠি বা চুক্তির মাধ্যমে এই দানের নথি তৈরি করা যায়।
• এমনিতে কোনও আত্মীয়ের থেকে দান বা উপহার গ্রহণ করলে, তাতে করের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ধরুন, স্বামী তাঁর স্ত্রীকে কোনও তহবিল উপহার দিলেন, আর স্ত্রী তা লগ্নি করে আয় করলেন। সে ক্ষেত্রে আয়কর অফিসার উপযুক্ত মনে করলে সেই আয় স্বামীর আয়ের সঙ্গে যোগ করতে পারেন। ফলে তখন স্বামীকে প্রযোজ্য হারে কর দিতে হবে।
সাবধানের মার নেই
কার থেকে কী উপহার পাবেন, বা কে আপনাকে তাঁর কোন মূল্যবান সম্পত্তি দান করে যাবেন, সেই সিদ্ধান্তে আপনার হয়তো কোনও হাত থাকে না। কিন্তু যেটা ঝুলিতে এসে পড়ল, সেটি যে করমুক্ত, তা প্রমাণ করার দায় কিন্তু আপনার। এমনকী যদি তা করযোগ্য হয়, তবে সেই টাকার উপরে কর হিসেব করে রাজকোষে ঠিক সময়ে তা জমা দেওয়ার দায়িত্বও আপনার উপর বর্তাবে। কাজেই এই সব দায় ও দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুতিও নিতে হবে আপনাকেই। কী ভাবে? জেনে রাখুন—
• টাকা-পয়সা, সোনা, গয়নাগাঁটির মতো অস্থাবর সম্পত্তি পেলে দাতা বা উপহার প্রদানকারীর কাছ থেকে হলফনামা নিয়ে রাখুন
• জমি-বাড়ির মতো স্থাবর সম্পত্তি হাতে এলে, গিফ্ট ডিড রেজিস্ট্রি করান
• দাতা বা উপহার প্রদানকারীর প্যান কার্ডের এবং তাঁর শেষ অর্থবর্ষের আয়কর রিটার্নের ফোটোকপি নিয়ে রাখুন। আপনাকে অত দামি উপহার দেওয়ার আর্থিক সঙ্গতি তাঁর সত্যিই আছে কি না, সেটা প্রমাণ করার জন্যই এগুলি লাগতে পারে
• যদি চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট মারফত টাকা পান, তা হলে সেটির ফোটোকপি করে রাখুন
• যাঁর কাছ থেকে চেক বা ব্যাঙ্ক ড্রাফ্ট পেলেন, তাঁর ব্যাঙ্কের পাসবই বা অ্যাকাউন্টে লেনদেনের বিস্তারিত হিসাবের কপিও পারলে নিজের কাছে রাখুন। সব সময়ে অবশ্য তা পাওয়া কঠিন
• অনেক গয়না উপহার পেলে দাতার কাছ থেকে হলফনামার পাশাপাশি ওই অলঙ্কার মূল্যায়নের নথিও (ভ্যালুয়েশন রিপোর্ট) নিন
মাথায় রাখুন
• বদলে কিছু না-দিয়ে যা পাওয়া যায়, তা-ই দান বা উপহার
• গিফ্ট ট্যাক্স আইন অবলুপ্ত। এই সংক্রান্ত বিষয় আয়কর আইনের ৫৬ ধারার অধীন
• ৫০ হাজার টাকা বা তার সমমূল্যের জিনিস করমুক্ত। তার বেশি হলে কর বসতে পারে
• তবে কোনও আত্মীয়ের কাছ থেকে দান বা উপহার পেলে, দাম যা-ই হোক না কেন, সাধারণত তা পুরোপুরি করমুক্ত
• কর ধার্য হয় না বিয়েতে পাওয়া উপহার, কারও উইল মোতাবেক প্রাপ্তি, দাতার মৃত্যুকালীন ইচ্ছে অনুযায়ী প্রাপ্তি, কোনও বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রাস্ট থেকে প্রাপ্তি ইত্যাদিতে
• আয়কর আইনের ৮০জি ধারা অনুযায়ী, অনুমোদিত কিছু সংস্থা, ফান্ড বা ট্রাস্টে দান করে সেই দানের ৫০ থেকে ১০০ শতাংশের উপর করছাড় মেলে
• দানের অঙ্ক ২,০০০ টাকার বেশি হলে তা নগদে দেওয়া যায় না
• প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানকে থোক টাকা দান করে করের বোঝা কমানো যায়
• যে কোনও দান গ্রহণের আগে সব সময়ে করের দিকটি যাচাই করে নেওয়া ভাল
স্থাবর সম্পত্তি দান
স্বীকৃত কোনও আত্মীয় স্থাবর সম্পত্তি লিখিত ভাবে দান করলে প্রাপককে কর দিতে হয় না। দলিলের উপর স্ট্যাম্প ডিউটি পড়বে সরকারি মূল্যায়নের ০.৫%। রেজিস্ট্রেশন ফি গুনতে হবে ১.১%। তবে ‘আত্মীয়’ নয় এমন কোনও ব্যক্তিকে ওই সম্পত্তি দিলে কিন্তু প্রাপকের ঘাড়ে মোট করের বোঝা চাপতে পারে। স্ট্যাম্প ডিউটি হিসেবে দিতে হতে পারে ৬-৭ শতাংশ। সঙ্গে রেজিস্ট্রেশনের জন্য আরও ১.১%। তাই অনাত্মীয়কে উইলে সম্পত্তি হস্তান্তর সুবিধার
আত্মীয় কারা
সব আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে দান বা উপহার পেলে, তা প্রাপকের কর রেহাইয়ের জন্য আইনের চোখে যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। ৫৬ ধারা অনুযায়ী আত্মীয়ের তালিকায় যাঁরা পড়েন, তাঁরা হলেন—
• উপহার প্রাপকের স্বামী বা স্ত্রী
• ভাই অথবা বোন
• স্বামী/স্ত্রীর ভাই অথবা বোন
• বাবা/মায়ের ভাই অথবা বোন
• সরাসরি পূর্বসূরি বা বংশধর
• স্বামী/স্ত্রীর সরাসরি পূর্বসূরি বা বংশধর
• সব থেকে উপরেরটি ছাড়া বাকিগুলিতে উল্লিখিত আত্মীয়ের স্বামী বা স্ত্রী
সম্পত্তির সংজ্ঞা
যে সমস্ত সম্পত্তি দান বা উপহার হিসেবে পাওয়া গেলে করের প্রশ্ন ওঠে, তার তালিকা দেওয়া রয়েছে আয়কর আইনের ৫৬ নম্বর ধারায়। এগুলি হল—
• স্থাবর সম্পত্তি, যেমন, বাড়ি জমি ইত্যাদি
• নগদ টাকা
• শেয়ার, বন্ড
• সোনা, রুপো, হিরের মূল্যবান গয়না
• প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রহ
• ড্রয়িং
• পেইন্টিং
• আর্ট ওয়ার্ক বা মূর্তি ইত্যাদি
• সোনার কয়েন বা বার
পরামর্শদাতা বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ
(মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy