আইন-আদালত
• ২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার বিয়ে হয়। তার কয়েক মাস পর থেকেই ছোট-বড় নানা বিষয় নিয়ে স্বামী ও তাঁর বাবা-মা আমার সঙ্গে অশান্তি করতে শুরু করেন। দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি করতে থাকেন। আমাকে মাঝে মাঝেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য চাপও দেন। এক দিন আমার স্বামী মদ্যপ অবস্থায় আমার সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙতে শুরু করেন এবং গালাগালি দেন। ২০১৪-র সেপ্টেম্বরে আমি বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসি এবং স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেদের নামে থানায় জেনারেল ডায়রি করি।
এর মধ্যে আমার স্বামী ক্ষমা চেয়ে শর্ত সাপেক্ষে আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেও, শাশুড়ি বলেন আমি ফিরলে তিনি আত্মহত্যা করবেন। শ্বশুরও চাপ দিতে থাকেন অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য। ইতিমধ্যে স্বামী যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং বলেন তিনি আমার সঙ্গে থাকতে চান না। বলেন, দেড় বছর কেটে গিয়েছে। আমি চাইলে যে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারি। আমার স্বামী এখন শহর ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। আমার কোনও সন্তান নেই। এই অবস্থায় আমি কী আদৌ বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারি? সে ক্ষেত্রে আমার যুক্তিই বা কী হবে? শ্বশুরবাড়িতে আমার যা জিনিসপত্র রয়েছে, তা কী ভাবে ফেরত পাব?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, কলকাতা
চিঠি থেকে এটা পরিষ্কার নয় যে, কোন আইনে আপনার বিয়ে হয়েছে। হিন্দু বিবাহ আইনে নাকি বিশেষ বিবাহ আইনে। তাই আগে সেটা জানুন। এ বার দেখতে হবে আপনি কী চাইছেন। আপনি কি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান নাকি বিবাহ বিচ্ছেদ চান?
আপনি যদি আপনার স্বামীর কাছে ফিরতে চান, তা হলে এ জন্য মামলা করতে পারেন। এই ধরনের মামলাকে ‘রেসটিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’-এর মামলা বলে। যে আইনে বিয়ে হয়েছে, সেই আইন মোতাবেকই স্বামীর কাছে ফিরে যাওয়ার মামলা রুজু করতে হবে। এই মামলার মূল বক্তব্য হবে যে, বিনা কারণে স্বামী আপনাকে তাঁর থেকে আলাদা থাকতে বাধ্য করেছেন এবং বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। অতএব স্বামী যাতে আপনার অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্য পালন করেন, সেই প্রার্থনা জানিয়ে আদালতে দ্বারস্থ হতে হবে।
এ বার ধরা যাক, আপনি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন। সে ক্ষেত্রে যে আইনে আপনার বিবাহ হয়েছে, সেই আইন মোতাবেক বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা রুজু করতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, চাইলেই কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা দায়ের করা যায় না। কেন আপনি বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন সেই সম্পর্কে উপযুক্ত কারণ দর্শাতে হবে।
যেমন, আপনার ক্ষেত্রে বলতে পারেন যে, বিয়ের পর থেকে আপনার উপরে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকজন যে অত্যাচার করেছেন, তার জন্যই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেছেন। মনে হতে পারে যে, এই ‘অত্যাচার’- যা দিনের পর দিন ধরে চলছে, তা আপনি প্রমাণ করবেন কী ভাবে। এর সাক্ষী-সাবুদই বা জোগাড় করবেন কী ভাবে? সাধারণত স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে চিড় ধরলে, স্ত্রীর উপর স্বামীর অত্যাচারের বেশির ভাগ ঘটনা চার দেওয়ালের মধ্যেই ঘটে। অর্থাৎ এই ধরনের ঘটনায় স্ত্রী নিজেই, এ ক্ষেত্রে আপনিই অত্যাচারের মূল সাক্ষী। আপনার সাক্ষ্যের মধ্য দিয়েই সেই বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
এ বারে প্রশ্ন হল মামলাটি কোথাকার আদালতে বা কোথায় দায়ের করতে হবে?
বর্তমানে আপনি যে জেলায় বাস করছেন, সেখানকার জেলা জজের আদালতে এই দুই ধরনের মামলাই রুজু করা যায়। প্রসঙ্গত, বলে রাখি, বিবাহ হয়েছে যে জেলায় বা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দুই পক্ষ ছাড়াছাড়ির আগে শেষ বসবাস করেছে যে জেলাতে সেই জেলাতেও মামলা করা যেতে পারে। এই মামলাকে বলা হয় ‘ম্যাট্রিমোনিয়াল স্যুট’ মামলা।
আপনার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে আমি শুধু জানতে চাইব, ‘কেন এ রকম আচরণ স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকেরা করেন?’—আপনি নিজে একবার খতিয়ে দেখেছে তো? কেন তারা আপনার সঙ্গে এই রকম দুর্ব্যবহার করছেন? তাদের কী বক্তব্য? আপনার তরফ থেকে সংশোধনের কোনও জায়গা আছে কি? ভাববেন না, আমি আপনাকে দোষ দিচ্ছি। আমি শুধু বোঝাবার চেষ্টা করছি যে সমাধানের কোনও রাস্তা আছে কিনা? আমি প্রথমেই আইনের রাস্তাটা বাতলেছি। কিন্তু আদালত বা আইনই সব নয়।
২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আপনি শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে আসেন। সেই থেকে সেখানেই আছেন। এখন আমার প্রশ্ন হবে, ওই তারিখে বেরিয়েই যখন এলেন তখন চুপ করে বসে রইলেন কেন? কেন এতটা সময় নষ্ট করলেন?
আপনার স্বামী ঠিক এই জায়গাটাই ধরছেন। তিনি বলছেন, এত দিন আলাদা থাকায় আপনার প্রতি তার অনুভূতিগুলি শেষ হয়ে গেছে। বা হয়তো বলতে চাইছেন যে আপনার প্রতি তিনি আর কোনও রকম টান অনুভব করেন না। তাই তিনি আর একসঙ্গে থাকতে চান না।
আপনি কিন্তু স্বামীর সঙ্গে থাকার জন্য ‘রেসটিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’-এর মামলাটি আগেই করতে পারতেন। আর যদি মনে করেন যে, ‘ স্বামীর সঙ্গে আর এক সঙ্গে ঘর করা সম্ভব নয়’—তা হলেও আরও আগেই বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করা যেত।
আর একটা রাস্তাও আপনি আগেই নিতে পারতেন বা এখনও নিতে পারেন। আপনি ‘গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন’ বা ‘ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট’-এই বিশেষ আইনটিতে আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে আাদলতের দ্বারস্থ হতে পারতেন। এই আইনটির বলে আপনি ১) রেসিডেন্স অর্ডার অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে থাকবার অধিকার চাইতে পারতেন অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে থেকে মামলাও চালাতে পারতেন। ২) মনিটরি রিলিফ অর্থাৎ খোরপোষও চাইতে পারতেন। ৩) প্রোটেকশন অর্ডারও পেতে পারতেন। অর্থাৎ আপনি একজন প্রোটেকশন অফিসারের নজরেও থাকতে পারতেন। যদি ঘরে কোনও রকম নিরাপত্তাহীনতার ঘটনা ঘটত, তাহলে তৎক্ষণাৎ প্রোটেকশন অফিসার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারতেন।
এখনও আপনি শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গিয়ে নিজের অধিকারে থাকতে পারেন। তবে এত দিন পরে আবার সেখানে থাকার চেষ্টা করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে। তবে এটাও ঠিক যে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আইনত আপনাকে ঘরে ঢুকতে বাধা দিতে পারবেন না।
এ বারে আসা যাক, দ্বিতীয় অংশের উত্তরে। শ্বশুরবাড়িতে আপনার যে সব জিনিসপত্র আছে সেগুলি ফেরত পাওয়া আইনত আপনার অধিকার। যদি আপোষ মীমাংসা হয় অর্থাৎ যদি আপনাদের মধ্যে ‘মিউচুয়াল ডিভোর্স’ হয়, তাহলে অবশ্যই আপনার জিনিসপত্র ফেরত চাইতে পারেন। কিন্তু যদি মিউচুয়াল ডিভোর্স না-ও হয় বা কোনও ধরনের মামলাই আপনি না করেন, তাহলেও জিনিসপত্র ফেরত পেতে পারেন।
মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে বিয়েতে যা পেয়েছেন সেগুলো তো পাবেনই। আপনার শ্বশুরবাড়ি থেকে আপনি যে সব উপহার, গয়না ইত্যাদি পেয়েছেন, সেগুলিকে বলে ‘স্ত্রী ধন সম্পত্তি’— তাও আপনি আইনত ফেরত পাবার হকদার। তবে এটাও ঠিক যে ‘ডিভোর্স’ মামলা হোক না হোক জিনিসপত্র, গয়না আপনি ফেরত চাইতেই পারেন। যদি আপনার স্বামী জিনিসপত্র ফেরত দিতে না-চান, তাহলে আপনি ভারতীয় দণ্ড বিধিতে ৪০৬ ধারায় আপনার স্থানীয় থানায় অভিযোগ জানাতে পারেন।
এই বারে প্রশ্ন হল, আপনি খোরপোষ পাবেন কিনা? সাধারণ ক্ষেত্রে একজন মহিলা স্বামীর ঘর থেকে কোনও কারণে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলে তিনি তার ও তার সন্তানের জীবনধারনের জন্য স্বামীর কাছ থেকে খোরপোষ চাইতে পারেন। শুধু তাই নয়, মামলা চালানোর জন্যও একটা খরচও তিনি স্বামীর কাছ থেকে দাবি করতে পারেন।
আপনার ক্ষেত্রে অবশ্য জানিয়েছেন কোনও সন্তানাদি নেই। আপনি একজন পার্ট-টাইম লেকচারার এবং আপনার স্বামী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। তবে আপনার রোজগার কত সে সম্পর্কে আপনি কিছুই জানাননি।
এটুকু জেনে রাখুন, মহিলারা খোরপোষ পাবার অধিকারী। তবে আপনার ক্ষেত্রে আপনি কত টাকা খোরপোষ পেতে পারেন বা আদৌ পেতে পারেন কিনা সেটা আদালতই নির্ধারণ করবেন। আপনি যেমন পার্ট-টাইম লেকচারার হিসেবে কিছু রোজগার করেন, এ বার দেখতে হবে আপনার স্বামী কত টাকা রোজগার করেন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র বিচার করে তবেই আদালত আপনার খোরপোষ পাবার পরিমাণ নির্ধারণ করবেন।
আবার যদি আপনি ‘রেসটিটিউশন অব কনজুগাল রাইটস’-এর মামলা কিংবা সরাসরি ডিভোর্সের মামলা দায়ের করেন, তাহলেও সেই মামলার প্রেক্ষিতে আপনি ‘অ্যালিমনি’ পেতে পারেন। তবে ‘অ্যালিমনি’ বা খোরপোষ কত হবে, তা আদালত নির্ধারণ করবেন। সে ক্ষেত্রে আপনিও আপনার স্বামীর ‘স্ট্যাটাস’ বা জীবনধারনের মান অনুযায়ী জীবন ধারন করবেন, এটাই আদালতের ইচ্ছে থাকে।
আপনি আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, আপনার স্বামী শহর ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছেন। এটা হলে আপনার জন্য খুবই মুশকিল হবে।
তাই আপনাকে বলব, এক্ষুনি আপনার স্বামীর বিরুদ্ধে আদালতে যেতেই হবে।
পরামর্শদাতা: আইনজীবী
জয়ন্ত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy