কিছু দিন আগে কণ্ঠস্বর আর কণ্ঠচর্চা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন পেয়েছি ব্লগের ই-মেলে। সেই সব প্রশ্ন দিয়ে শুরু করছি আজকের ক্লাসরুমের কাজ। ভয়েস টাইপ নিয়ে প্রশ্ন ছিল একটি। প্রশ্নটি এ রকম। দু’জনে একই স্কেলে কথা বললেও দু’রকম শুনতে লাগে। এটা কি ভয়েস টাইপের জন্য? উত্তরে যাবার আগে বলে নিই, ভয়েস টাইপ ব্যাপারটা ঠিক কী? ভয়েস টাইপ অনেকটা কাপড়ের বুননের মতো। এটা গলার ‘টেক্সচার’। এক এক রকমের কাপড়ের দেখবেন এক এক রকম বুনন। তাঁতের কাপড়ই ধরুন। কত রকমারি—ঢাকাই, টাঙ্গাইল, ধনেখালি, পশ্চিমি তাঁত, ওড়িশার তাঁত, মণিপুরের তাঁত, আরও কত কী! সিল্কের শাড়িতেও তাই। তসর, মুগা, গরদ, মুর্শিদাবাদি সিল্ক, দক্ষিণী সিল্ক, এই সব। হাত দিলে তফাতটা বোঝা যায়। গলার বুননও তাই। শুনলে তফাত বোঝা যায়। এটা ঠিক, ভয়েস টাইপ আলাদা হওয়ার জন্যই দু’জন মানুষ একই স্কেলে কথা বললেও দু’রকম শুনতে লাগে।
আর একবার মনে করিয়ে দিই, ভয়েস টাইপটা দরাজ, গমগমে বা মিষ্টি হওয়াটা আবৃত্তির ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা। কিন্তু সেটাই সব নয়। যে কোনও ভয়েস টাইপেই আপনি আবৃত্তি করতে পারেন। তার উৎকর্ষও বাড়াতে পারেন অনুশীলন করে। গলার জোর বা ভলিউমও বাড়াতে পারেন। ভলিউম বাড়াতে গেলে রেজোন্যান্স বাড়াতে হবে। রেজোন্যান্সের বাংলা নাম অনুরণন। সেটা কী? কাঁসা বা পিতলের বাসন, কিংবা স্টিলের বাসন মেঝেতে পড়তে শুনেছেন? শব্দটা কেমন থেমেও থামে না। চলতেই থাকে, তার পর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। এটাই অনুরণন। গলার ভলিউম বাড়াতে গেলে এমন ভাবে বলতে হবে, যাতে অনুরণন বাড়ে। এগুলো সবই কণ্ঠস্বর চর্চার অঙ্গ।
আর একটি প্রশ্ন ছিল, ভলিউম বাড়ালে কি ভয়েস টাইপ বদলে যায়? এককথায়, না। ভয়েস টাইপ আমাদের জন্মগত ভাবে মোটামুটি নির্দিষ্ট। তাকে বদল করতে গেলে কণ্ঠস্বর শুধুমাত্র কৃত্রিমই শোনায় না, কণ্ঠস্বরের ক্ষতিও হতে পারে। এ বার আজকের কথায় আসি। বাকি যা যা প্রশ্ন ছিল, তার উত্তর হয়তো আজকের আলোচনা থেকেই বেরিয়ে আসবে।
একটু গানের কথায় আসি। আমরা সবাই জানি গানে সাতটা সুর আছে—‘সা’ থেকে ‘নি’। বাংলায় আমরা বলি স্বরগ্রাম বা সরগম। আর একটু শুদ্ধ ভাবে বললে স্বরসপ্তক।। ইংরেজিতে বলে ‘অক্টেভ’—পরের ‘সা’টাকে ধরে নিয়ে। যে-সপ্তকটা আমার স্বাভাবিক সপ্তক, তাকে আমরা বলি উদারা। তার নীচেরটাকে মুদারা, আর তার উপরেরটাকে তারা। ‘তারস্বর’ কথাটা মনে করুন। আমরা যখন স্বাভাবিকের থেকে উপরের স্বরে গিয়ে, মানে তারা-য় কথা বলি, সেটাই তারস্বর। আবৃত্তিতেও ব্যাপারটা অনেকটা একই রকম। এখানে স্বাভাবিক স্বরকে আমরা বলি অনুদাত্ত, তার উপরেরটি উদাত্ত, আর নীচেরটি মন্দ্র। নাটকের ভাষায় কিংবা পশ্চিমি নাট্যশাস্ত্রের পরিভাষায়—স্বাভাবিক স্বরের নাম থ্রোট রেজিস্টার। তার নীচের স্তরের নাম চেস্ট রেজিস্টার, আর উপরের স্তরের নাম হেড রেজিস্টার। অনেক সময় গায়কেরা গলাটাকে এক স্বর থেকে অন্য স্বরে গড়িয়ে নিয়ে যায়। গানের ভাষায় একে বলে মীড়। আবার কোনও স্বরকে দুলিয়ে দুলিয়ে সামান্য কাঁপিয়েও গাওয়া হয়। এর নাম গমক। মীড় বা গমকের প্রয়োগ আবৃত্তিতেও করা যায়। তবে প্রয়োগটা যেন জায়গামতো এবং প্রয়োজনমতো হয়। আবৃত্তি শুনে যেন মনে না হয়, গলার কসরতটাই দেখানো হল, আবেগটা এল না।
গলার কিছু ত্রুটি, ফাঁকফোকর খানিকটা ঢেকে দেওয়া যায় মাইক্রোফোনে। অনেক আবৃত্তিকারই বলেন রিভার্বটা একটু বাড়িয়ে দিতে। যখন শব্দতরঙ্গ ছোট ছোট ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে, তখন তৈরি হয় রিভার্ব। প্রতিধ্বনির মতো, কিন্তু ঠিক প্রতিধ্বনি নয়। রিভার্ব বাড়ালে যেহেতু ধ্বনিটা ফিরে ফিরে আসে, তাই গলাটা একটু ভরাট শোনায়। আবার ‘গেন’ বাড়ালে কণ্ঠস্বরটা একটু জোরালো হয়।
তবে মাইক্রোফোন যন্ত্রটি বড় গোলমেলে। ঠিকমতো ব্যবহারে খুব ভাল বন্ধুর কাজ করে। ভুল ব্যবহারে যন্ত্রটি বড় পীড়াদায়ক হয়। বেশির ভাগ রাজনৈতিক বক্তৃতায় দেখবেন, বক্তারা ভুলেই যান যে তাঁদের মুখের সামনে একটা মাইক্রোফোন আছে! খুব জোরে কথা বলতে থাকেন, তখন গলাটা ধাতব যন্ত্রের মতো বাজতে থাকে। অনেক বাচিক শিল্পীও এটা করেন। মাইক্রোফোনে জোরে কথা বলা মানে কারও কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার করা। অনেকে আবার এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে উল্টোটাও করেন। হয় তাঁরা মাইক্রোফোন থেকে দূরে চলে যান, নয়তো গলাটা নামিয়ে দেন, ফলে মাইক্রোফোনের কাজটা কিছুই হয় না। আসলে, মাইক্রোফোনে চেঁচাতে নেই, কিন্তু গলাটাকে ঠিকঠাক প্রজেক্ট করতে হয়।
মাইক্রোফোন ব্যবহারের সময় লক্ষ রাখতে হয় অবাঞ্ছিত শব্দ যাতে না আসে। বিশেষ করে শ্বাসের শব্দ। ওষ্ঠবর্ণ, মানে ‘প ফ ব ভ ম’ উচ্চারণে শ্বাসের শব্দ বা ফ্লপ আসার আশঙ্কা খুব বেশি থাকে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা দরকার।
মাইক্রোফোন ব্যবহারের প্রাথমিক পাঠ আমি পেয়েছি জগন্নাথ বসুর কাছে। আকাশবাণীর নাট্যবিভাগে কাজ করার সময় তিনি বড় যত্নে আমাকে শিখিয়েছিলেন মাইক্রোফোনে কণ্ঠস্বরের ব্যবহার। প্রেক্ষাগৃহে গেছি, এক শিক্ষার্থী হয়েই গেছি। দেখেছি প্রদীপ ঘোষ, পার্থ ঘোষ কিংবা গৌরী ঘোষকে— কী ভাবে কতটা যত্ন নিয়ে প্রতিটি শব্দ তাঁরা উচ্চারণ করছেন। প্রতিটি শব্দই উঠে আসছে নিখুঁত উচ্চারণে, তার মাপমতো ওজন নিয়ে। কোনও অবাঞ্ছিত শব্দ নেই কোথাও।
মাইক্রোফোন কেউ সোজাসুজি নেন, কেউ কোনাকুনি, কেউ দূর থেকে, কেউ বা একদম মুখের কাছ থেকে। যে কোনও ভাবেই নেওয়া যায়। শুধু বুঝে নিতে হবে আপনি কোনটায় স্বচ্ছন্দ। এ বার মাইক্রোফোনের চরিত্রগুলো একটু জেনে নিই। মাইক্রোফোন সাধারণত তিন রকম। ইউনিডিরেকশনাল—যেখানে শুধু সামনের দিকটা কার্যকর। বাইডিরেকশনাল—যেখানে সামনের দিক, এবং পিছনের দিক, দু’দিক দিয়েই শব্দতরঙ্গ ঢুকতে পারে, আর ওমনিডিরেকশনাল—যেখানে সব দিক থেকেই শব্দতরঙ্গ ঢোকে। ইউনিডিরেকশনাল মাইক সাধারণত বক্তৃতার জন্য ব্যবহার করা হয়। আবৃত্তির জন্য সবচেয়ে ভাল ওমনিডিরেকশনাল।
সঠিক ব্যবহার জানলে মাইক্রোফোন নিয়ে অনেক খেলা করা যায়। খুব উঁচু স্বরে কথা বলতে হলে মুখটা সামান্য সরিয়ে নিলে ভাল হয়। কণ্ঠস্বর দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে—সেটা বোঝানোর জন্য মুখটা সরিয়ে নেওয়া যায় ধীরে ধীরে। আবার ফিসফিস কথা মাইক্রোফোনের খুব কাছে মুখ এনে বললে শ্রোতার কাছে পৌঁছে যায়। এ সবই ব্যবহারিক কাজ। শুধু আলোচনা শুনে বা পড়ে ধারণা পাওয়া যায় মাত্র।
মাইক্রোফোনের সঠিক ব্যবহার জানা থাক বা না থাক, মাইক্রোফোনের প্রতি মোহ কম-বেশি সকলের আছে। যন্ত্রটি হাতে পেলে কেউ সহজে ছাড়তে চায় না। আমার যখন সাত-আট বছর বয়স, সেই সময় পাড়ায় বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠানে প্রথম মাইক্রোফোন হাতে পাই। আমাকে স্টেজ থেকে নামানো যাচ্ছিল না। আমার যতগুলো কবিতা মুখস্থ, সবগুলোই আমি মাইক্রোফোনে বলতে চেয়েছিলাম। সে এক হুলস্থূল কাণ্ড!
বললাম না, মাইক্রোফোন যন্ত্রটাই গোলমেলে।
আবৃত্তির ক্লাস নিয়ে কোনও প্রশ্ন আছে আপনার? সরাসরি জেনে নিন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। bratatiblog@gmail.com-এ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy