গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
নওয়াজ শরিফ-বিলাবল ভুট্টোর জোটেও কি আস্থা রাখতে পারছে না পাক সেনা? ভোটগণনা পর্বের মধ্যেই শনিবার দুপুরে পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের বক্তৃতায় এমনই আঁচ পাচ্ছেন সে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
পাক সেনার ‘ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস’ (আইসিপিআর)-এর তরফে শনিবার জেনারেল মুনিরের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, ‘‘নির্বাচন এবং গণতন্ত্রের অর্থ হল, পাকিস্তানের জনগণের সেবা করা, তাঁদের ব্যবহার করা নয়। ২৫ কোটি জনসংখ্যার উন্নয়নশীল দেশে বিশৃঙ্খলা এবং মেরুকরণের রাজনীতি মানায় না। এগুলিকে দূরে সরিয়ে রাখতে দেশে সুস্থির নেতৃত্ব প্রয়োজন। যে নেতৃত্বের ছোঁয়ায় পরিস্থিতি সুস্থির হবে।’’
২০২২ সালের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর প্রধান ইমরান খানের বিদায়ের সময় আলোচনায় এসেছিল ‘পাক ফৌজের নেপথ্য ভূমিকা’। একদা প্রবল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)-কে এক মঞ্চে এনে জোট সরকার গড়ার ক্ষেত্রেও তৎকালীন পাক সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার ‘তৎপরতা’ চোখ এড়ায়নি। এ বারের ভোটে পাক পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ‘ত্রিশঙ্কু’ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতেই তাই বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ জেনারেল মুনিম ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠেছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
জেনারেল মুনির তার বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘নির্বাচন শুধুমাত্র জয়-পরাজয় নির্ধারণের প্রতিযোগিতা নয়, বরং জনমত যাচাইয়ের পরীক্ষা। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাঁদের কর্মীদের অবশ্যই ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে এবং যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমে শাসনক্ষমতা পরিচালনা এবং জনগণের সেবা করতে হবে। কার্যকরী ও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্ভবত এটাই একমাত্র পথ।’’
এ ক্ষেত্রে ‘যৌথ প্রচেষ্টা’র উল্লেখ করে পাক সেনাপ্রধান পিএমএলএন প্রধান নওয়াজ শরিফ এবং পিপিপি নেতা বিলাবল ভুট্টোর জোটের ক্ষমতাসীন হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বলেই জল্পনা। বিবৃতির শেষে জেনারেল মুনির ‘গণতন্ত্রের পথে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরবে’ বলে যে বার্তা দিয়েছেন, তাতে সেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে। গত সাড়ে সাত দশকে বিভিন্ন দফার চার বার সেনাশাসন দেখেছে পাকিস্তান। দেখেছে তিনটি সেনা অভ্যুত্থান। ভোটগণনা চলাকালীন সে দেশের সেনাপ্রধানের বিবৃতিতে এমন ‘গণতান্ত্রিক’ বার্তা তাৎপর্যপূর্ণ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের ধারণা।
প্রসঙ্গত, শনিবার দুপুরেই আনুষ্ঠানিক ভাবে পিএমএলএন এবং পিপিপি ভোট-পরবর্তী জোটের ঘোষণা করেছে। পাক ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে এখন মোট আসন ৩৩৬। কিন্তু তার মধ্যে সরাসরি ভোট হওয়ার কথা ছিল ২৬৬টি আসনে। কিন্তু এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ২৬৫টি আসনে ভোট হয়েছে। বাকি ৭০টি আসন মহিলা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। এর মধ্যে মহিলাদের জন্য ৬০ এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ১০টি আসন। পাক সংবিধান অনুযায়ী সরাসরি ভোটে যে দল যে সংখ্যক আসনে জয় পাবে, সেই অনুপাতে ওই সংরক্ষিত আসনগুলিতে প্রতিনিধি ঠিক করে দলগুলি।
যদিও এই সংরক্ষিত আসনগুলির উপর সরকার গঠন নির্ভর করে না। সেই হিসাব হবে সংরক্ষিত বাদ দিয়ে ২৬৫টি আসনের মধ্যে। সেই অর্থে বর্তমান পরিস্থিতিতে ১৩৩ জন জয়ীর সমর্থন পেলেই পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ‘জাদুসংখ্যা’ ছোঁয়া সম্ভব হবে। এখনও পর্যন্ত পিএমএলএন ৭১ এবং পিপিপি ৫৪টিতে জিতেছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত নির্দলেরা ৯২ এবং নির্দল এবং অন্যেরা এখনও পর্যন্ত ৩৬টি আসনে জয়ী হয়েছে।
অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে জোট। এ ছাড়া নির্দল এবং জমিয়ত উলেমা-ই-ইসলামের মতো কট্টরপন্থী কয়েকটি দলের সমর্থনও তারা পেতে পারে। পাক নির্বাচন কমিশন ‘রাজনৈতিক দল’ হিসাবে পিটিআই-এর স্বীকৃতি বাতিল করায় তারা সরাসরি ভোটের ময়দানে নেই। কিন্তু ইমরানের দলের অনেক নেতাই ‘নির্দল’ হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফল বলছে, এখনও পর্যন্ত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে জয়ী প্রার্থীদের মধ্যে নির্দলেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তা ছাড়া, খাইবার-পাখতুনখোয়ার আওয়ানি ন্যাশনাল পার্টি, সিন্ধের মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট এবং কয়েকটি বালুচ সংগঠনের সমর্থনও বিশ্বকাপজয়ী প্রাক্তন পাক ক্রিকেট অধিনায়কের অনুগামীদের দিকে থাকতে পারে। সূত্রের খবর, ১০০ জনের বেশি ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যের সমর্থন রয়েছে জেলবন্দি ইমরানের দিকে। তাই কি তাঁকে ঠেকাতে হঠাৎ সক্রিয় পাক সেনাপ্রধান?