গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
নরেন্দ্র মোদীর সরকার প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাওয়ের জন্য মরণোত্তর ‘ভারতরত্ন’ সম্মাননা ঘোষণার পরেই নতুন বিতর্কের আঁচ তেলুগু রাজনীতিতে। নরসিংহের নাতি এনভি সুভাষ শুক্রবার সরাসরি নিশানা করেছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব তথা গান্ধী-নেহরু পরিবারকে। সুভাষের অভিযোগ, কংগ্রেসের ব্যর্থতার জন্য গান্ধী পরিবার ‘বলির পাঁঠা’ করতে চেয়েছে তাঁর ঠাকুরদাকে।
তেলঙ্গানার বাসিন্দা সুভাষ কয়েক বছর আগেই বিজেপিতে নাম লিখিয়েছিলেন। তেলঙ্গানায় দলের মুখপাত্রও হয়েছিলেন। যদিও তাঁর বাবা ছিলেন অবিভক্ত অন্ধ্রের প্রথম সারির কংগ্রেস নেতা। শুক্রবার নরসিংহের ‘ভারতরত্ন’ প্রাপ্তির কথা শুনে সুভাষ বলেন, ‘‘মোদী সরকার নরসিংহ রাওকে ভারতরত্ন সম্মান দিচ্ছে। যদিও তিনি কংগ্রেসের সদস্য। ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত কেন্দ্রে ইউপিএ সরকার ছিল। তারা নরসিংহকে ভারতরত্ন দূর অস্ত্, কোনও সম্মানও দেননি, বরং বলির পাঁঠা করতে ব্যস্ত ছিল।’’
১৯৯১ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন নরসিংহ। গান্ধী পরিবারের বাইরে তিনিই প্রথম, যিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুরো কার্যকালের মেয়াদ পূরণ করতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরেও নরসিংহের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল সনিয়া গান্ধীর। কিন্তু ১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী পদে বসার পর থেকে ১০ নম্বর জনপথে নরসিংহের যাতায়াত ক্রমশ কমতে শুরু করে। আগে খুঁটিনাটি ব্যাপারে সনিয়ার পরামর্শ নিলেও, ধীরে ধীরে তা কমিয়ে ফেলেন। এতে দু’পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাসের দেওয়াল উঠতে শুরু করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, নরসিংহ তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছেন বলে মনে হতে থাকে সনিয়া ও তাঁর সমর্থকদের। যে কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সনিয়া ১৯৯৮ সালে কংগ্রেসের রাশ নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি।
দু’পক্ষের মধ্যে তিক্ততা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, রাজনৈতিক কানাঘুষো পেরিয়ে তা প্রথম সর্বসমক্ষে প্রকট হয়ে ধরা দেয় ২০০৪ সালে। হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ১৪ দিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সে বছর ২১ ডিসেম্বর প্রয়াত হয়েছিলেন নরসিংহ। সেই সময় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্য প্রথা মেনে দিল্লিতে হয়নি। হয়েছিল তাঁর রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে। কংগ্রেসের কোনও শীর্ষস্থানীয় নেতা সেখানে হাজির ছিলেন না। পরে দিল্লিতে কংগ্রেসের সদর দফতরে নরসিংহের দেহাবশেষ রাখা হয়েছিল। সেখান থেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা জানান সনিয়া, মনমোহন, রাহুলেরা।
প্রয়াণের পরেও দীর্ঘ দিন নরসিংহের জন্মবার্ষিকী পালন করতে দেখা যায়নি কংগ্রেসকে। ২০২০ সালে প্রথম বার জন্মশতবার্ষিকীতে রাওয়ের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে দেখা গিয়েছিল সনিয়া-রাহুলকে। যদিও এ ব্যাপারে বরাবরই ব্যতিক্রম মনমোহন সিংহ। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীনও নিয়মিত দিল্লির অন্ধ্রভবনে গিয়ে নরসিংহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এসেছেন তিনি। এমনকি, নরসিংহকে তাঁর ‘পথপ্রদর্শক’ এবং ‘ভারতের উদার অর্থনীতির জনক’ বলেও একাধিক বার উল্লেখ করেছেন তাঁর জমানার অর্থমন্ত্রী মনমোহন।
নরসিংহের ‘সমালোচক’ হিসাবে পরিচিত কংগ্রেস নেতাদের যুক্তি, ১৯৯২ সালে উন্মত্ত করসেবকদের হাত থেকে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ রক্ষায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাওয়ের ‘ব্যর্থতা’। প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড, ‘দ্য টারবুল্যান্ট ইয়ার্স— ১৯৮০-৯৬’-এ বাবরি ধ্বংসের সময় নরসিংহের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর মতে, সেই সময় উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা কল্যাণ সিংহের সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা রেখে ভুল করেছিলেন নরসিংহ। ঘটনাচক্রে, দু’বছর আগে মোদী সরকারই প্রয়াত কল্যাণকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসমারিক সম্মান ‘পদ্মবিভূষণ’ দিয়েছিল।