মেঘে ঢাকা সবুজ পাহাড়। তিস্তার বিস্তার এবং কালিম্পং শহর। পানবু ভিউপয়েন্ট থেকে তোলা ছবি। —নিজস্ব চিত্র।
ছুটির সময় হয়নি। তবুও সময়ের আগে তাড়াহুড়ো করে বিদায়পর্ব সেরে অফিস থেকে বেরোব। পিছন থেকে হঠাৎ এক সহকর্মীর ডাক, ‘‘শ্রুতি, যা জী লে আপনি জিন্দেগি।’’ আমি শাহরুখ খানের ভক্ত জেনেই হয় তো আরও বেশি করে বলল কথাটা। নাকি ও বুঝতে পেরেছে যে,‘সোলো ট্রিপ’-এ যাব বলে এত দিন ধরে আমার উত্তেজনার পারদ যে ভাবে চড়ছিল, আজ ঠিক একই গতিতে ভয়ের পারদও চড়ছে। হরমোনগুলো এ বার চোখ-মুখে ছাপ ফেলতে শুরু করে দিয়েছে। কান গরম হচ্ছে ধীরে ধীরে, বুঝতে পারছি। এখন এক কাপ চা খাওয়া প্রয়োজন। ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা চায়ের দোকানে। মাথায় চলছে অনেক কিছু।
দুঃসাহস দেখিয়ে ফেললাম না তো? একা একা যাব, বর্ষার পাহাড় দেখব, এই স্বপ্নগুলো এত বছর ধরে নিজের মধ্যে লালন করেছি, এই স্বপ্নযাপন করেছি, তা বাস্তবে ছুঁয়ে দেখব না? গরম চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিতে মাথা ঠান্ডা হল একটু। এখনও গোছগাছ সামান্য বাকি।
আর দেরি করা ঠিক নয়। মেট্রো ধরে বাড়ি ফিরলাম। শেষ মুহূর্তে চেকলিস্ট দেখে সব মিলিয়েও নিলাম। কিচ্ছুটি বাদ যায়নি। বাবা-মায়ের মুখে চিন্তার রেখা লক্ষ করলাম না, কিন্তু তাঁরা যে আকাশ-পাতাল ঘুরে দুশ্চিন্তার সাগরে নিজেদের ভাসিয়ে দিয়েছেন, তা বুঝতে দেরি হল না। খুব ভয় লাগছিল। তবুও ভরসা দিলাম। মাসখানেক আগে বাবা-মাকে না জানিয়েই ট্রেনের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল, সব বুক করে ফেলেছিলাম। বাড়িতে জানানোর সাহস কুলোয়নি।
যাওয়ার সাত দিন আগে বাড়িতে জানাই। দিনে অফিস, রাতে ঘুম। মাঝে যে দু-তিন ঘণ্টা সময় পেতাম,তার মধ্যেই ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘেঁটে সব ব্যবস্থা করেছি। এখন তো আর সব বুকিং ক্যানসেল হবে না! ফলে বাবা-মা বিশেষ আপত্তি করার সুযোগও পেলেন না।
সাবধানে চলাফেরা করার আশ্বাস বাবা-মাকে দিয়ে আমার যাত্রা শুরু হল। জীবনে প্রথম বার একা বেড়াতে যাওয়া। গন্তব্য কালিম্পং। ‘একা একটা মেয়ে এত দূর ঘুরতে যাবি? ভয় লাগবে না? যদি কিছু হয়ে যায়?’ আমার এক সহকর্মীর পাশাপাশি আরও অনেকের প্রশ্ন ছিল এ রকমই। ভয় তো আমারও লাগছিল। কিন্তু ওই যে, ‘ডর কে আগে জিত হ্যায়।’
আগেভাগেই টিকিটের পিডিএফ, হোটেল বুকিংয়ের মেসেজ, গাড়ির নম্বর, ড্রাইভারের ফোন নম্বর— সব কিছু বাবাকে এবং নিজেকেও হোয়াট্সঅ্যাপ করে রাখলাম। ট্রেনে ওঠার পর আর ঘুম এল না। ব্যাগে দামি জিনিস বলতে ক্যামেরা ছাড়া কিছুই নেই। তবুও চিন্তা হচ্ছিল। গাড়ির চালক শেখরদাদার সঙ্গে ট্রেন থেকেই ফোনাফোনি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। স্টেশনে নেমে গাড়ি বুক করার ঝামেলা পোহাতে চাইনি। আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রাখা।
স্টেশনে ড্রপ এবং পিক আপ করা থেকে কোথায় কোথায় ঘুরতে যাব, তাও আগে থেকে জানিয়ে রেখেছিলাম শেখরদাদাকে। নেপালি ভাষার সুর টেনে, আধো হিন্দি, আধো বাংলায় কথা বলেন তিনি। গাড়িও চালান দুর্দান্ত। শিলিগুড়ি পেরিয়ে উঠলাম পাহাড়ি রাস্তায়। একপাশে তিস্তা বয়ে চলেছে, ফুলেফেঁপে উঠে গর্জন করছে যেন। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, মেঘের চাদর দিয়ে সবুজ পাহাড়কে যেন মুড়িয়ে দিয়েছে কেউ। ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। স্টেশন থেকে কালিম্পংয়ের হোটেলে পৌঁছতেই দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা লেগে গেল। হোটেলের ঘরের জানলা থেকে দেখতে পেলাম মেঘে ঢাকা পাহাড়ি শহর।
আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখাও মিলত। কোন হোটেলের ঘর থেকে সবচেয়ে ভাল কালিম্পং শহরের পাশাপাশি পাহাড় দেখা যাবে, তার সন্ধান পেতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি আমাকে। ফেসবুক পোস্ট, হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইট দেখেও শান্তি মেলেনি। ঢুঁ মেরেছিলাম ইউটিউবেও। নেট ঘেঁটে হোমস্টে এবং হোটেল মিলিয়ে মোট পাঁচ-ছ’টা জায়গা আমার মনে ধরেছিল। তার পর দূরত্ব, খরচের হিসাব করে অবশেষে এই হোটেলে থাকার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হল। যাক, এমন অপূর্ব ‘ভিউ’-এর জন্য ইউটিউব এবং ফেসবুক বাবাজিকে ধন্যবাদ।
শুধু হোটেলের খোঁজই নয়, আমার হোটেলের কাছাকাছি কোনও ক্যাফে রয়েছে কি না, সে সবও জেনে নিয়েছিলাম আগে থেকেই। ক্যাফে খোঁজার জন্য আবার ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামই ভরসা। লোকমুখে শোনা, পাহাড়ে ঘুরতে গেলে নাকি বিকেল থেকে সময়ই কাটতে চায় না। তার উপরে আবার একা থাকব। কথা বলার মতো কোনও সঙ্গীও নেই। ফলে সন্ধ্যার পর থেকে কী কী করতে পারি, সে ভাবনা আগে থেকেই ভাবতে হয়েছে।
হোটেলে অত ক্ষণ একা একা বসে না থেকে বরং বিকেলগুলো পাহাড়ি ক্যাফেতেই কাটানো ভাল। তাই বৃষ্টি থামতে বিকেলে রওনা দিলাম আর্ট ক্যাফের খোঁজে। জিপিএস অন করলে দেখাচ্ছে দু-তিন মিনিটের সোজা পথ। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে যে ক্যাফে খুঁজে বার করা এতটাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠবে, তা জিপিএসকে ‘গুরুদেব’ মনে করা মেয়ে কি আর বুঝবে!
ক্যাফের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে বহু স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপ হল, গল্প হল। জীবনযাপন থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া— গল্পের বিষয় থেকে কোনও কিছুই বাদ পড়ল না। ক্যাফেতে পৌঁছেও একটি দলে ভিড়ে গেলাম। গল্পের মাঝে নৈশভোজও সেরে নিলাম ক্যাফেতে। ফেরার পথে কিছুটা সময় বাজারে ঘোরাঘুরিও করলাম। সময়ও দিব্যি কেটে গেল।
পরের দিন কালিম্পঙের চেনা কয়েকটি ট্যুরিস্ট স্পট যেমন মরগ্যান হাউস, গলফ কোর্স, ডেলো পার্ক, হনুমান মন্দির, দুরপিন মনাস্টেরি, পাইন ভিউ নার্সারি, চিত্রভানু, গ্রাহাম হাউস ঘুরলাম। দুপুর নাগাদ গিয়েছিলাম বলে গ্রাহাম হাউস লাগোয়া স্কুলের ভিতর যাওয়ার সুযোগ মিলল।
বিকেলে আবার ঢুঁ মারলাম অন্য একটি ক্যাফেতে। ক্যাফের কর্মীদের সঙ্গে গল্প করতে করতে সময় কেটে গেল। ডিনার সেরে ফিরলাম হোটেলে। পরের দিন বাড়ি ফেরার পালা।হোটেল থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম পানবু ভিউ পয়েন্টের উদ্দেশে।
স্বর্গরাজ্য! তিস্তার বিস্তার, চারদিকে সবুজের ছয়লাপ। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল কি? না কি এ আনন্দাশ্রু?
স্বপ্নপূরণ হল তবে। দশ বছর আগের স্মৃতি ফিরে এল হঠাৎ। ‘ইয়ে জওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’ ছবিটির কথা মনে পড়ছিল। বানির চরিত্রটি কম-বেশি সকলের প্রিয় হলেও আমার আবার বরাবরই নয়নাকে পছন্দ। বুদ্ধিমতী, সাহসী। হিন্দি সিনেমা আমার জীবনে কোনও না কোনও ভাবে ছাপ ফেলে যায়। দশ বছর আগে নয়নাকে দেখেই সোলো ট্রিপে যাওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলাম আমি। স্বর্গরাজ্যের দিকে চেয়ে অজস্র ধন্যবাদ ছুড়ে দিলাম। কার উদ্দেশে, জানি না। তবে দিলাম, আদর-যত্নে মুড়িয়ে। একা একা না এলে এ সব উপলব্ধিও কি হত! হয়তো সঙ্গীদের কলরবেই মন মজে থাকত শুধু।
প্রথম বার একা বেড়াতে গিয়েছি বলে টাকাপয়সার হিসাব একটু কমই করেছিলাম। গোটা একটা গাড়ি বুক করে রেখেছিলাম তিন দিনের জন্য। হোটেলের ভাড়া নিয়েও বিশেষ ভাবিনি।এই ক’দিন হাত খুলে এত খরচ করেছি যে, তা কলকাতায় নামতেই টের পেলাম। পকেটে দুর্দান্ত রকমের টান পড়েছে।
তাই খরচের কথা আর উল্লেখ করছি না। অফিসে ফিরতেই সহকর্মীদের প্রশ্নবাণ। একা কী করে সময় কাটল, ভয় করল কি না, বিপদ হয়নি তো, মনখারাপ হল কি না বাড়ির সকলের জন্য, একা থাকার আনন্দ বেশি কি না— সে কত কী! যাওয়ার আগে আমার মনেও এই প্রশ্নগুলো ছিল। ফিরেছি উত্তর সহযোগে। মনে হচ্ছে, অন্তত এক বার যদি একা বেড়াতে যাওয়া যায়, তবে মন্দ হয় না।
তবে আমার মতো একা পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়ার আগে কয়েকটি জিনিস মনে রাখতে হবে। সেই মতো ব্যবস্থাও করতে হবে। রইল কিছু পরামর্শ—
১) প্রয়োজনীয় জিনিস নিন, কিন্তু অকারণে ব্যাগ ভারী করবে না। ট্রলি ব্যাগ নিলে চলাফেরায় সমস্যা হতে পারে। ডাফল ব্যাগ নিলেও কাঁধ এবং হাতে ব্যথার আশঙ্কা থেকে যায়। সে ক্ষেত্রে রেন কভার যুক্ত পিঠে নেওয়ার বড় রাকস্যাক নেওয়া অনেকটাই সুবিধাজনক।
২) পাহাড়ে প্রথম বার একা ঘুরতে গেলে আগে থেকে হোটেল বুকিংয়ের পাশাপাশি গাড়ি ঠিক করে রাখা ভাল। ফলে অচেনা জায়গায় নতুন করে খোঁজ নিয়ে হোটেল এবং গাড়ির জন্য বাড়তি চিন্তা অথবা অযথা তাড়াহুড়ো থাকে না। শহরের মধ্যে কোনও হোটেলে থাকাই নিরাপদ।
৩) গন্তব্যে পৌঁছনোর পর কোথায় কোথায় ঘুরতে এবং খেতে যাবেন, তা-ও আগে থেকে ঠিক করে রাখা ভাল। এ ক্ষেত্রে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, গুগ্ল খুবই ভাল সাহায্য করতে পারে।
৪) অচেনা জায়গায় একা একা প্রথম যাচ্ছেন, কখন কী প্রয়োজন পড়ে, তাই হাতে সময় নিয়ে স্থানীয় বাজার ঘুরে আসতেই পারেন। এর ফলে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গেও আলাপ হয়। স্থানীয় বিশেষ কোনও খাবার চেখে দেখার সুযোগও হাতছাড়া হয় না।
৫) নেটওয়ার্কের সমস্যা না থাকলে কখন কোথায় যাচ্ছেন, হোটেল এবং গাড়ির নম্বর পরিবারের কোনও সদস্য বা বিশ্বস্ত কোনও বন্ধুকে জানিয়ে রাখুন।
৬) একা ঘুরতে গেলে কি নিজস্বীই ভরসা? একদম নয়। উত্তরবঙ্গের পাহাড়ে ঘুরতে গিয়েছেন অথচ সেখানে বাঙালির দেখা মিলবে না, তা অবিশ্বাস্য। তা ছাড়াও স্থানীয় লোকজন তো রয়েছেনই। ঘোরার ফাঁকে অন্যদের ছবি তুলে দিন। নিজের ফোন বা ক্যামেরা বাড়িয়ে দিলে তাঁরাও আপনার ছবি তুলে দিতে দ্বিধা করবেন না।
৭) শেষে মনে করাচ্ছি, কিন্তু সবচেয়ে জরুরি। নিজের সঙ্গে কিছু ওষুধপত্র রাখুন। বেশির ভাগ পাহাড়ি জায়গায় কিন্তু কলকাতার মতো সারা রাত ওষুধের দোকান খোলা থাকে না। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে নিজেকেই তো ব্যবস্থা করতে হবে।