Oppenheimer Movie & Pokhran II

‘ওপেনহাইমার’ এবং পঁচিশ বছর আগের এক খর দুপুর

কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যেই ফাঁকা মতো জায়গা দেখে সুড়ুৎ করে ভিতরে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, পিঠে কী একটা ঠেকল। মুখ তুলে দেখলাম, একটা কালান্তক আগ্নেয়াস্ত্রের নল। উল্টো দিকে ভাবলেশহীন ফৌজি।

Advertisement
অনিন্দ্য জানা
অনিন্দ্য জানা
শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৩ ০৮:০০
a still from the film  Oppenheimer

ক্রিস্টোফার নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে দেখতে ঝপ করে সময়টা মনে পড়ে গেল। কাকতালীয় ভাবে, এ বছর সেই পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার ‘রজতজয়ন্তী’। নোলানের ছবির একটি দৃশ্য।

দু’পাশে মাইলের পর মাইল মরুভূমি। ইতিউতি কিছু বাবলা গাছের ঝোপঝাড়। আদিগন্তবিস্তৃত সেই বালির পাহাড় মাঝ বরাবর চিরে ফেলে অজগরের পিঠের মতো কালো পিচ রাস্তা চলে গিয়েছে তেপান্তরের দিকে। বালিয়াড়ি বরাবর দু’পাশে কাঁটাতারের বেড়া। তার ও পার থেকে আগুনের হলকা বয়ে-আনা বাতাস ঝাপট মারছে চোখেমুখে। পিছনের সিট থেকে মুখটা উইন্ডস্ক্রিনের দিকে একটু বাড়ালেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, রাস্তার উপর জলের মতো টলটল করছে মরীচিকা।

সকালে যোধপুর থেকে বেরোনোর সময় হোটেলের তাপমান যন্ত্রে দেখে এসেছি, বাইরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস! এই পোখরানে নিশ্চয়ই সেটা আরও ডিগ্রি দুয়েক বেশিই হবে। মে মাসের খর গ্রীষ্মের দুপুরে কোথাও একটা কাকপক্ষীও নেই। মানুষ তো অনেক দূরের কথা!

Advertisement

থর মরুভূমির মধ্য দিয়ে কে জানে কোথায় যেতে যেতে দিন পাঁচেক আগের এক বিকেলের কথা মনে হচ্ছিল। আনন্দবাজারের দিল্লি দফতরে প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরো থেকে খবর এল, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী তাঁর বাসভবনে জরুরি সাংবাদিক বৈঠক ডেকেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠক? জরুরি? উরেব্বাস! দে দৌড়! দে দৌড়!

Atal Bihari Vajpayee Former Prime Minister of India

১১ মে, ১৯৯৮। অটলবিহারী বাজপেয়ীর সেই সাংবাদিক বৈঠক। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে ঢোকার বিবিধ ঔপচারিকতা মেনে ভিতরে গিয়ে দেখি, ঘটনাটা ঘটবে প্রধানমন্ত্রী আবাসের লনে। রেসকোর্স রোডের ওই বিশেষ বাড়িটায় এক ধরনের পুঁচকে পুঁচকে সিঙাড়া পাওয়া যেত (এখনও যায় কি না জানি না)। যেটা খেলে জাতও যেত, পেটও ভরত না। টেবিলে প্লেটভর্তি করে রাখা থাকত। যে যাঁর মতো তুলে তুলে নিতে পারতেন। সে দিন সে সব দেখা গেল না। চেয়ার-টেয়ারের বিলাসিতাও নেই। পেশাগত সহকর্মীরা দাঁড়িয়ে আছেন হাতে নোটবই-কলম এবং মুখে একটা কী হয়-কী হয় ভাব নিয়ে। বোঝা গেল, সরকারের বিবিধ বিষয়ে আগে থেকে খবর-টবর রাখা মহীরুহেরাও দ’য়ে পড়েছেন। কেউ কিচ্ছু জানেন না। মুচকি হাসি মুখে নিয়ে এবং রবীন্দ্রনাথের মতো পিছনে হাত দুটো জোড়া করে লনে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন প্রমোদ মহাজন। কিন্তু সাংবাদিক কুলের পরিবৃত্তের বাইরে। পরিচিতেরা তাঁকে দেখে একটু উসখুস করছিলেন বটে। কিন্তু বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার সদস্য তো কারও সঙ্গে নজরই মেলাচ্ছেন না!

সংবাদজনতার উদগ্র কৌতূহল আরও বাড়ল, যখন পোডিয়ামের পাশে একটা স্তম্ভে জাতীয় পতাকা এনে লাগানো হল। যুদ্ধ-টুদ্ধ ঘোষণা হবে নাকি! চারদিক টানটান।

দেখা গেল, ঠিক আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ না হলেও অঘোষিত যুদ্ধই ঘোষিত হল বটে।

ধীর পদক্ষেপে পোডিয়ামের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর থেমে থেমে, বাজপেয়ীসুলভ ভঙ্গিতে ঠিক ছ’টি বাক্য পড়লেন। যার মর্মার্থ— সেই দিন, ১১ মে, ১৯৯৮, বেলা ৩টে ৪৫ মিনিটে ভারত রাজস্থানের পোখরানে পরীক্ষামূলক ভাবে তিনটি পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এটা ইনট্রো। এবং ভূমিকাতেই ‘কপি’ শেষ। তার পরে আরও গোটা পাঁচেক লাইন। মনে করে দেখছি, ছ’টি বাক্যের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছিল, আবহাওয়ায় কোনও ‘রেডিয়ো অ্যাক্টিভিটি’ ছড়ায়নি।

Pokhran

বিস্ফোরণের ন’দিন পর পোখরানের সেই এলাকা। মরুভূমির অতলে ফেটেছিল পরমাণু বোমা। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

তখনও সে ভাবে মোবাইল যুগ আসেনি। ২৪ ঘণ্টার খবরের চ্যানেলও নেই। অফিসে খবর দিতে হবে। প্রশ্ন-টশ্ন গোল্লায় যাক! তিন লম্ফে বাইরে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীও কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার অবকাশ দেননি। ঘোষণাটা করেই হাফ টার্নে ঘুরে পোডিয়াম ছেড়ে ঢুকে গিয়েছিলেন ভিতরে। কারণ, ওটা আসলে সাংবাদিক বৈঠক ছিল না। স্রেফ একটা ঘোষণা ছিল। আসলে ঘোষণাও নয়। নির্ঘোষ! জাতীয় পতাকা পাশে নিয়ে পাশের বাড়ির প্রতি বজ্রনির্ঘোষ যে, ভারত এখন পরমাণু শক্তিধর দেশ। বেশি ট্যাঁ-ফুঁ কোরো না বাপু।

অতঃপর যা যা হওয়ার হল। গোটা দুনিয়ায় তোলপাড়। চাঘাইয়ে পাকিস্তানের পাল্টা পরমাণু আস্ফালন। সারা দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের ভারতের উপর নিষেধাজ্ঞা চাপানো ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি। সেই আবহেই আমাকে অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো হল পোখরান। দিল্লি থেকে সারা রাত বাসযাত্রা করে জয়পুর। সেখান থেকে টিনের বাস ঠেঙিয়ে যোধপুর। যোধপুর থেকে একটা লজঝড়ে অ্যাম্বাসেডরে পোখরানের মরুভূমি।

১৯৭৪ সালে যখন ভারত প্রথম পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল, সেটাও ছিল এই পোখরানে। এই মে মাসেই। কেন পোখরান? কেনই বা মে মাস? কারণ, কোথাও কোনও টিলা বা পাহাড়ের আড়াল নেই যে, অত মস্ত একটা কাণ্ড ঢেকে রাখা যাবে। তাই বিকল্প ব্যবস্থা। মে মাসে রাজস্থানের মরুভূমিতে অহরহ বালির ঝড় ওঠে। যা আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহের দৃষ্টি ঝাপসা করে দেবে। দ্বিতীয়ত, মে মাসে পোখরানের তাপমাত্রা থাকে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি। ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে আকাশচারী উপগ্রহের ইনফ্রা রেড সেন্সর কাজ করে না।

Pokhran

বালির ঝড়ে আমেরিকার গুপ্তচর উপগ্রহের নজর ঝাপসা করে দিতেই বাছা হয়েছিল মে মাসের পোখরানকে। — ফাইল চিত্র।

গরমে চোখে ফুলঝুরি দেখছি। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে নামলাম। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যেই একটা ফাঁকা মতো জায়গা দেখে সুড়ুৎ করে গলে ভিতরে ঢুকেছি কি ঢুকিনি, পিঠে কী একটা ঠেকল। মুখ তুলে দেখলাম, একটা কালান্তক আগ্নেয়াস্ত্রের নল। উল্টো দিকে ভাবলেশহীন ফৌজি। কালাশনিকভের ট্রিগারে আঙুল।

—ঠহরিয়ে! থামুন!

কোলকুঁজো অবস্থা থেকে কোনও মতে মাথাটা তুলে বললাম, ‘‘পত্রকার।’’ ওয়ালেট থেকে ভারত সরকারের দেওয়া সাংবাদিকের পরিচয়পত্র বার করে হাতে দিলাম। ক্যামোফ্লেজ উর্দি পরিহিত ফৌজির মুখের একটা রেখাও কাঁপল না। দু’আঙুলের ফাঁকে ল্যামিনেট-করা কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘‘চলে যাইয়ে!’’ মুখ দেখে বুঝলাম, এখানে ডাল গলবে না। থর মরুভূমিতে পরমাণু বিস্ফোরণের অতিকায় গহ্বর একডালিয়ার পুজো নয় যে, নাচতে নাচতে চলে এলেই স্বেচ্ছাসেবকেরা আদর করে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেবেন।

তখনও জানতাম না, ১৯৯৫ সাল থেকে এই মরুভূমিতে পরমাণু বিস্ফোরণের প্রস্তুতি চলেছে। তিন বছর ধরে ভারতীয় সেনার ৫৮ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্টের উপর ভার ছিল আমেরিকার উপগ্রহচক্ষুর নজর বাঁচিয়ে পরমাণু পরীক্ষার এলাকাটা তৈরি করা। বেশির ভাগ কাজ হত রাতের অন্ধকারে। যন্ত্রপাতি বয়ে এনে। ভোরের আলো ফোটার আগে সেগুলো আবার রেখে আসা হত তাদের নির্দিষ্ট জায়গায়। যেন কোথাও কোনও নড়াচড়া হয়নি। পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত সমস্ত বিজ্ঞানীকে (যাঁদের মধ্যে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা তথা ডিআরডিও-র প্রধান এপিজে আব্দুল কালাম। যিনি পরে ভারতের রাষ্ট্রপতি হবেন) ফৌজি উর্দি পরতে হত। যাতে তাঁদের ‘সিভিলিয়ান’ বলে বোঝা না যায়। বিজ্ঞানীরা কেউ সরাসরি পোখরান যেতেন না। দল বেঁধেও নয়। প্রথমে যেতেন অন্যত্র কোথাও। তা-ও ছদ্মনামে। দু’তিন জন করে করে। সেখান থেকে তাঁদের বিশেষ গাড়িতে পোখরানে নিয়ে যেত সেনাবাহিনী।

Atal Bihari Vajpayee, George Fernandes, A. P. J. Abdul Kalam

বোমা পরীক্ষার কয়েক দিন পর পোখরানের সেই বিস্ফোরণস্থলে (বাঁ দিক থেকে) অটলবিহারী বাজপেয়ী, জর্জ ফার্নান্ডেজ় এবং এপিজে আব্দুল কালাম। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

বিস্ফোরণের ক’দিন আগে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার থেকে সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে মুম্বইয়ের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সেই দুনিয়াকাঁপানো মারণাস্ত্র। ১০ মে রাত ৩টের সময় বায়ুসেনার এএন ৩২ বিমানে সেগুলি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জয়সলমের। সেখান থেকে চারটি ফৌজি ট্রাকের কনভয়ে পোখরান।

যে তিনটি পরমাণু বোমা (তাদের থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস এবং ওই ধরনের আরও খটোমটো বৈজ্ঞানিক পরিচয় রয়েছে। কিন্তু সে সব বিজ্ঞানীরা ভাল বোঝেন। আমাদের মতো অর্ধশিক্ষিতেরা হরেদরে ‘বোমা’ই বুঝবে) বিস্ফোরণ হয়েছিল প্রথম (১৩ মে আরও দু’টি বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। দু’দিনে মোট পাঁচটি), তার একটি ছিল থর মরুভূমির ৬৬০ ফুট গভীর গর্তে (সাঙ্কেতিক নাম: হোয়াইট হাউস)। দ্বিতীয়টি ছিল ৪৯০ ফুট গভীর গর্তে (সাঙ্কেতিক নাম: তাজমহল)। তৃতীয়টির সাঙ্কেতিক নাম ‘কুম্ভকর্ণ’।

কিছু দিন পরে মরুভূমির মধ্যে সেই অতিকায় মহাগহ্বরের কিনারায় দাঁড়িয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাত নাড়বেন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ় এবং কালাম।

ক্রিস্টোফার এডওয়ার্ড নোলানের ‘ওপেনহাইমার’ দেখতে দেখতে ঝপ করে সময়টা মনে পড়ে গেল। কাকতালীয় ভাবে, এই ২০২৩ সাল ভারতের সেই পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার ‘রজতজয়ন্তী’। আর জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার এবং তাঁর সহকর্মী পদার্থবিজ্ঞানীরা নিউ মেক্সিকোর জনমানবহীন প্রান্তরে ‘ট্রিনিটি’র যে পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ করিয়েছিলেন, তার বয়স এখন আটাত্তর!

কিন্তু পর্দায় নিউ মেক্সিকোর ধূ-ধূ প্রান্তর দেখামাত্র সময়টা এক ঝটকায় পঁচিশ বছর পিছিয়ে গেল।

a still from the film  Oppenheimer

ফৌজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভসকে (বাঁ দিকে, অভিনয়ে ম্যাট ডেমন) দেখে মনে হল, ইনিই ২৫ বছর আগের কর্নেল উমঙ্গ কপূর। যাঁর তত্ত্বাবধানে পোখরান-২ পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল। (ডান দিকে) ওপেনহাইমারের চরিত্রে কিলিয়ান মার্ফি। নোলানের ছবির একটি দৃশ্যে।

কী আশ্চর্য সব সাদৃশ্য! না কি সমাপতন! লস অ্যালামস রসায়নাগারে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে যাওয়ার সময় আমেরিকান ফৌজের পোশাক পরে চলেছেন চূড়ান্ত গোপনীয় ম্যানহাটান প্রোজেক্টের ‘ডিরেক্টর’ ওপেনহাইমার। আর আমার মনে পড়ছে পোখরানে কর্মরত ভারতীয় বিজ্ঞানীদের কথা। তাঁদেরও তো সেনাবাহিনীর পোশাক পরতে হত! তফাত একটা ছিল যদিও। ওপেনহাইমার সেনার পোশাক পরেছিলেন দেশের প্রতি ভক্তিতে (সম্ভবত ভিতরে খানিকটা বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের জন্যও। যদিও পরে এক সহকর্মীর কটাক্ষ শুনে সেটা ছেড়ে ফেলেন)। আর কালামদের পরতে হত ওপেনহাইমারের দেশের উপগ্রহের চোখে ধুলো দিতে। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে।

ঘাড়ে-গর্দানে মাথার চুল থেকে পায়ের জুতো পর্যন্ত ফৌজি লেফটেন্যান্ট জেনারেল লেসলি গ্রোভসকে (অসামান্য অভিনয় করেছেন ম্যাট ডেমন) দেখে মনে হল, আরে! ইনিই তো ২৫ বছর আগের কর্নেল উমঙ্গ কপূর। যাঁর তত্ত্বাবধানে পোখরান-২ পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল।

জীবনীচিত্র বা সিনেম্যাটিক কাজ হিসেবে ‘ওপেনহাইমার’ কোন জাতের, নোলান কত বড় পরিচালক, তা বিচার করার এলেম আমার নেই। সবিনয়ে এবং সভয়ে বলি, ‘ইন্টারস্টেলার’ দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ‘ইনসেপশন’-এ না ঘুমোলেও ঝিমিয়েছিলাম তো নিশ্চিত। কিন্তু সেই আমিই ১৮২ মিনিটের ‘ওপেনহাইমার’ দেখলাম বিস্ফারিত নয়নে। শিরদাঁড়া টান করে।

চিত্রনাট্য, অভিনয়, সম্পাদনা, পরিচালনা— এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়! বিলেতের ‘দ্য গার্ডিয়ান’ যেমন লিখেছে, ‘‘ওপেনহাইমার ছবিটা দেখা মানে চোখের সামনে এটা দেখতে পাওয়া যে, ইতিহাস নিজেই নিজেকে পরতে পরতে মেলে ধরছে’’। অনেকে বলতে শুরু করেছেন যে, ‘ওপেনহাইমার’ এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি। কিন্তু সে সব তো ফিল্মবোদ্ধাদের বিচার্য। আমি দৃশ্যের পর দৃশ্যে বার বার ফিরে যাচ্ছিলাম ১৯৯৮ সালে।

a still from the film  Oppenheimer

সিনেমার ওপেনহাইমার। পরমাণু পরীক্ষা সফল হওয়ার পর স্বগতোক্তির মতো বলছেন, ‘‘আমরা জানতাম, (এর পরে) পৃথিবীটা আর আগের মতো থাকবে না!’’ নোলানের ছবির একটি দৃশ্যে।

লস অ্যালামসের আকাশে পাকিয়ে উঠছে আগুনের পিণ্ড। চারদিক আলোয় আলো। মনে হচ্ছে হাজার সূর্য একসঙ্গে উঠেছে আকাশ জুড়ে। চারদিক নিবাত। নিষ্কম্প। কিছু পরে মনে হল, পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে। দূর থেকে মেঘগর্জনের ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। যা হাজার হাজার ডেসিবেল হয়ে ফেটে পড়বে চরাচরে। ওপেনহাইমার ইংরেজি অনুবাদে আওড়াচ্ছেন গীতার অমোঘ লাইন— ‘‘নাউ আই অ্যাম বিকাম দ্য ডেথ, দ্য ডেস্ট্রয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস’’! আর আমার মনে পড়ছে পোখরান বিস্ফোরণের পর পাকিস্তানের ভারতকে টেক্কা দেওয়ার পরমাণু বিস্ফোরণ। মনে পড়ছে, তখন মনে হয়েছিল, উপমহাদেশে এই শুরু হয়ে গেল পারমাণবিক অস্ত্রের দৌড়!

হিরোসিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলার পর প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন ওপেনহাইমার। বাইরে অপেক্ষা করতে করতে দেখছেন সেন্টার টেবিলে পড়ে আছে ‘টাইম’ ম্যাগাজ়িন। সেই সংখ্যার ‘কভার স্টোরি’ তিনি। প্রচ্ছদে তাঁর ছবি। সঙ্গে হেডিং: ‘ফাদার অফ নিউক্লিয়ার বম্ব’।

ওভাল অফিসে পৃথিবীর এক নম্বর শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান ‘পরমাণু বোমার জনক’-এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁকে অভিনন্দন জানাতে। হাত মিলিয়ে সোফায় বসেছেন ওপেনহাইমার। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করতে করতে তাঁর বিস্ফারিত দু’চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে। পৃথিবীখ্যাত পদার্থবিদ দমচাপা গলায় বলছেন, ‘‘মিস্টার প্রেসিডেন্ট, আই সি ব্লাড ইন মাই হ্যান্ডস!’’ চোখ কুঁচকে তাঁকে জরিপ করে ট্রুম্যান আকাশনীল রঙের স্যুটের বুকপকেট থেকে সাদা রুমাল বার করে এগিয়ে দিচ্ছেন। হাবেভাবে বলছেন, হাতের রক্তটা মুছে নিন বরং। ওভাল অফিসের কপোতশুভ্র দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে তাঁর কণ্ঠস্বর, ‘‘বোমা কে বানিয়েছে, সে কথা কেউ মনে রাখে না। মনে রাখে, কে বোমাটা ফেলেছে। দ্যাটস মি! সে আমি।’’

a still from the film  Oppenheimer

হিরোসিমা, নাগাসাকিতে পরমাণু বোমা ফেলার পর বিশ্রস্ত ওপেনহাইমার। নোলানের ছবির একটি দৃশ্যে।

ধ্বস্ত, বিশ্রস্ত ওপেনহাইমারকে যখন বাইরে যাওয়ার দরজার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, পিছন থেকে ভেসে আসছে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের বিরক্ত কণ্ঠস্বর, ‘‘এই ছিঁচকাঁদুনেকে যেন আমি আর কখনও আমার আশপাশে না দেখি!’’

দৃশ্যটা দেখতে দেখতে পোখরানের মরুভূমি থেকে ফৌজির কালাশনিকভের তাড়া-খেয়ে খানিক দূরের গ্রামে ঢুকে-পড়া সাংবাদিকের সামনে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে-থাকা মুখগুলোর কথা মনে পড়ছিল। একের পর এক বাড়িতে চওড়া চওড়া ফাটল। মাটির তলায় পরমাণু বিস্ফোরণের অভিঘাতজনিত প্রচণ্ড কম্পনে আড়াআড়ি ফেটে গিয়েছে সমস্ত বসতবাড়ির পাথরের দেওয়াল। অনুসন্ধিৎসু আগন্তুকের হাঁকাহাঁকিতে সেই সব বাড়ির বাসিন্দারা বাইরে এসে দাঁড়াচ্ছিলেন। প্রশ্ন করায় একসুরে বলছিলেন, বাড়ি পুরোপুরি ধসে পড়ে গেলেও কোনও দুঃখ নেই। দেশ তো অমিত শক্তিধর হয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম মাথা খুঁড়েও একটি মুখ থেকেও কোনও বিপন্নতাসূচক শব্দ বার করে আনতে পারিনি। বুক ফাটলেও মুখ ফুটছিল না কারও। কারণ, তাঁরা জানতেন, মুখ ফুটলেই ‘দেশদ্রোহী’ তকমা এঁটে যাবে গায়ে!

পরমাণু পরীক্ষা সফল হওয়ার পর তুমুল হর্ষধ্বনি এবং পদধ্বনির মধ্যে পোডিয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছেন ওপেনহাইমার। হাত তুলে সকলকে শান্ত হতে বলে প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলছেন, ‘‘উই ন্যু দ্য ওয়ার্ল্ড উড নট বি দ্য সেম। আমরা জানতাম, (এর পরে) পৃথিবীটা আর আগের মতো থাকবে না!’’ অনেক পরে তিনি বলবেন, ‘‘সে দিন কথাটা শুনে আমার সহকর্মীদের কেউ কেউ হেসেছিলেন। কেউ কেউ কেঁদেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগই থম মেরে গিয়েছিলেন।’’

শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, দেশ যত শক্তিশালী হতে থাকে, দেশভক্তির পরীক্ষাও তত কঠিন, তত সূচ্যগ্র হতে থাকে। ছুঁচের মুখের মতো সেই বিন্দু মিলিয়ে দেয় বিশ্ববিশ্রুত পদার্থবিদ এবং পঁচিশ বছর আগে পোখরানের বালিয়াড়িতে দেখা কিছু নাচার চেহারাকে। মুখে হাসি, বুকে বিষ!

Advertisement
আরও পড়ুন