গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লোকসভা নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রদেশ কি দুশ্চিন্তা বাড়াবে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের? না কি ‘সেমিফাইনালে’ পিছিয়ে পড়বেন রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়্গেরা? ‘কাঁটে কা টক্কর’-এর পূর্বাভাস সঙ্গে নিয়েই শুক্রবার সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে মধ্যপ্রদেশ। ফল জানা যাবে আগামী ৩ ডিসেম্বর। বৈদ্যুতিন ভোটযন্ত্রের ‘সিল’ ভাঙার পরে।
বাস্তবের সঙ্গে জনমত সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষা মেলে না অনেক সময়েই। তবে সমীক্ষার ফলাফল মিলে যাওয়ার উদাহরণও কম নয়। ২৩০ আসনের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ১১৬। কয়েকটি জনমত সমীক্ষা বলছে, মধ্যপ্রদেশে গত বারের মতোই এ বারও কোনও দল তা ছুঁতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে ‘নির্ণায়ক’ হয়ে উঠতে পারে নির্দল ছোট দলগুলির বিধায়কদের ভূমিকা। যদিও এবিপি-সি ভোটার জনমত সমীক্ষার পূর্বাভাস, কংগ্রেস ১১৮-১৩০ আসনে জিতে সরকার গড়তে পারে। বিজেপি পেতে পারে ৯৯-১১১টি আসন।
এ বারের ভোটে যুযুধান প্রধান দুই দল শাসক বিজেপি এবং প্রাক্তন শাসক কংগ্রেস সব আসনেই প্রার্থী দিয়েছে। মায়াবতীর বিএসপি লড়ছে ২৩০টিতে। আসন সমঝোতা না হওয়ায় ‘ইন্ডিয়া’র শরিক সমাজবাদী পার্টি ৮০, আম আদমি পার্টি ৬৯, জেডিইউ ৫, সিপিআই ৯টি এবং সিপিএম ৪টি আসনে আলাদা আলাদা ভাবে লড়ছে। সব মিলিয়ে ২,৫৩৪ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন রাজ্যের ৫ কোটি ৬০ লক্ষের বেশি ভোটদাতা।
বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান (বুধনি), দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের পাশাপাশি রয়েছেন তিন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী— নরেন্দ্র সিংহ তোমর (মোরেনা), প্রহ্লাদ পটেল (নরসিংহপুর) এবং একদা সাংসদ-ঘুষকাণ্ডে অভিযুক্ত ফগ্গন সিংহ কুলস্তে। কংগ্রেসের ‘মুখ্যমন্ত্রী মুখ’ কমল নাথ তাঁর ‘গড়’ ছিন্দওয়াড়ায় প্রার্থী হয়েছেন। বিরোধী দলনেতা তথা সাত বারের বিধায়ক গোবিন্দ সিংহ (লহর), প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দিগ্বিজয় সিংহের ছেলে জয়বর্ধন (রাঘোগড়) এবং প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহের ছেলে অজয় (চুরাহাট)-ও রয়েছেন প্রার্থী তালিকায়।
২০১৩ সালে মধ্যপ্রদেশের ২৩০টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ১৬৫টি, কংগ্রেস ৫৮টি। দু’দলের ভোট শতাংশের ফারাক ছিল প্রায় ৯ শতাংশ (বিজেপি প্রায় ৪৫ শতাংশ। কংগ্রেস ৩৬ শতাংশের সামান্য বেশি)। কিন্তু ২০১৮-র বিধানসভা ভোটে ৪১ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে টেক্কা দেয় কংগ্রেস। বিজেপির ঝুলিতে যায় ৪০.৮ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস ১১৪, বিজেপি ১০৯, বিএসপি ২ এবং নির্দল ও অন্যেরা ৫টি আসনে জেতে। শেষ পর্যন্ত বিএসপি এবং নির্দলদের সমর্থনে সরকার গড়ে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন কমল নাথ। কিন্তু জ্যোতিরাদিত্য শিন্ডের নেতৃত্বে ২০২০-র মার্চে ২২ জন কংগ্রেস বিধায়কের বিদ্রোহের জেরে গদি হারান কমল। চতুর্থ বারের জন্য ভোপালের কুর্সি যায় শিবরাজ সিংহ চৌহানের হাতে।
২০১৮-র ভোটের ফল বলছে, মধ্যপ্রদেশের আটটি অঞ্চলের মধ্যে বিজেপি এবং কংগ্রেস এগিয়ে ছিল চারটি করে অঞ্চলে। বাঘেলখণ্ড, ভোপাল (মধ্য ভারত), বুন্দেলখণ্ড, গির্দ (চম্বল-গোয়ালিয়র), মহাকোশল, মালওয়া, নর্মদাপুরম, এবং বিন্ধ্য (নিমার)— এই আট ভাগে ভাগ করা হয় মধ্যপ্রদেশকে। তার মধ্যে বাঘেলখণ্ড, ভোপাল (মধ্য ভারত), বুন্দেলখণ্ড এবং নর্মদাপুরমে এগিয়ে ছিল বিজেপি। বাকিগুলিতে কংগ্রেস।
২০১৮ সালে চম্বল-গোয়ালিয়র অঞ্চলে ৩৪টি আসনের মধ্যে ২৬টিতে জিতলেও দেড় বছর পেরোনোর আগেই হয় ‘উলটপুরাণ’। গোয়ালিয়র রাজপরিবারের সন্তান জ্যোতিরাদিত্যের হাত ধরে ২২ জন কংগ্রেস বিধায়ক যোগ দেন বিজেপিতে। কমলকে সরিয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন শিবরাজ। পরে উপনির্বাচনে ওই দলছুট বিধায়কদের অধিকাংশই বিজেপির টিকিটে জিতে আসেন। কিন্তু এ বার কয়েকটি জনমত সমীক্ষার ফল বলছে, কংগ্রেস আবার ভাল ফল করতে পারে ওই অঞ্চলে। পাশাপাশি, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমলের মহাকোশল এবং মালওয়া অঞ্চলেও কংগ্রেসের এগিয়ে থাকার সম্ভাবনা। অন্য দিকে, গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ-ঘেঁষা জেলাগুলিতে কংগ্রেসের আদিবাসী ভোটব্যাঙ্কে বিজেপি এ বার ফাটল ধরাতে পারে বলে ইঙ্গিত মিলেছে। বিন্ধ্যে সেয়ানে-সেয়ানে লড়াইয়ের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে সমীক্ষায়।
বস্তুত, পঞ্চম বারের জন্য বিজেপির ‘মামা’ (অনুগামী মহলে এই নামেই পরিচিত শিবরাজ) মুখ্যমন্ত্রী হতে পারবেন কি না, গোয়ালিয়রের ‘মহারাজ’ জ্যোতিরাদিত্যের উপরেই অনেকাংশে তা নির্ভর করছে বলে ভোট পণ্ডিতদের একাংশের ধারণা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, গত বারের বিধানসভা ভোটের আগে ঠারেঠোরে নিজেকে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবিদার হিসেবে তুলে ধরলেও এ বার গোড়াতেই সেই দৌড় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য। বিজেপির প্রতিটি জনসভায় নিয়ম করে তিনি বলছেন, ‘‘আমি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নই!’’ যা দেখে অনেকে বলছেন, শুধু শিবরাজ নন, এ বারের বিধানসভা ভোট যে তাঁরও রাজনৈতিক কেরিয়ারের ‘অগ্নিপরীক্ষা’, তা স্পষ্ট করে দিচ্ছেন মহারাজ।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০১৮-র বিধানসভা ভোটে গোয়ালিয়র অঞ্চলে কংগ্রেস বিপুল জয় পেলেও তার ছ’মাসের মাথাতেই ‘রাজপরিবারের গড়’ গুনা লোকসভা কেন্দ্রে সওয়া এক লক্ষেরও বেশি ভোটে বিজেপি প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। এই পরিস্থিতিতে ওই অঞ্চলের ভোটের ভার যে পুরোপুরি তাঁর হাতে ছেড়ে দিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না, বার বার মোদী-শাহের নির্বাচনী সফরেই তার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। পাশাপাশি, সাড়ে তিন দফায় প্রায় ১৮ বছর ক্ষমতার থাকার সুবাদে বুথ স্তরে গড়ে তোলা শক্তপোক্ত সংগঠনও বিজেপির বড় ভরসা। তবে ভোটের আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তোমরের ছেলের বেআইনি টাকা লেনদেন সংক্রান্ত একটি ভিডিয়ো (যার সত্য়তা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি) সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অস্বস্তিতে পড়েছে বিজেপি।
অন্য দিকে, বিজেপির মোকাবিলায় কংগ্রেসের বাজি দুই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমল নাথ এবং দিগ্বিজয় সিংহের জুড়ি। ‘শোলে’ ছবির অনুকরণে যাঁরা ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে ‘বীরু-জয় জোড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। অতীতে মধ্যপ্রদেশ কংগ্রেস যাঁদের গোষ্ঠীলড়াইয়ের সাক্ষী হলেও জ্যোতিরাদিত্য দল ছাড়ার পরে দু’জনের সমীকরণ অনেকটাই মসৃণ হয়েছে। প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহের ছেলে অজয় এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুরেশ পচৌরির অনুগামীরাও মোটের উপর ‘মূলস্রোতে’ রয়েছেন। যদিও বিজেপির মতোই বেশ কিছু আসনে কংগ্রেসের বিক্ষুব্ধ নেতারা গোঁজ প্রার্থী হয়েছেন।
গোয়ালিয়রের ‘মহারাজ’ জ্যোতিরাদিত্যের মতোই ‘রাঘোগড়ের রাজা’ দিগ্বিজয়ও প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন, কংগ্রেস ভোটে জিতলে কমলই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। দলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ১৯৯৩ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত দু’দফায় এক দশক মুখ্যমন্ত্রী পদে থাকা দিগ্বিজয় এ বার তাঁর ছেলে তথা প্রাক্তন মন্ত্রী জয়বর্ধনকে উপমুখ্যমন্ত্রী করতে চান। তাই কমলকে ‘পথ’ ছেড়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই।
রাহুলের পিতামহী ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ছিন্দওয়াড়ার সাংসদ হয়েছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী কমল। ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় একটানা সাংসদ (মাঝে ১৯৯৬-’৯৮ পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন না) কমল কেন্দ্রে মন্ত্রী হয়েছেন একাধিক বার। একদা ‘সঞ্জয় গান্ধীর অনুগামী’ বলে পরিচিত হলেও পরবর্তী সময়েও গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ বৃত্তে ঠাঁই পেয়েছেন। ২০১৮ সালে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে দেড় দশক পরে ভোপালে ক্ষমতায় দলকে ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন কমল। একাধিক জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে ‘পছন্দের মুখ্যমন্ত্রী’ হিসেবে শিবরাজের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন তিনি।
তুল্যমূল্য এই লড়াইয়ে শেষ বেলায় তাই দু’পক্ষের ভরসা হয়ে উঠেছে দেদার খয়রাতির প্রতিশ্রুতি। আর সেখানে কংগ্রেসকে কিছুটা পিছনে ফেলেছে বিজেপি। অতীতে প্রধানমন্ত্রী মোদী বার বার জনমুখী আর্থিক সাহায্যকে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু ভোটের মুখে তাঁরই দলের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ ‘লাডলি বহেন যোজনা’য় মহিলাদের আর্থিক সাহায্যের অঙ্ক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে তিন হাজার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
শুধু তা-ই নয়, বিজেপির ইস্তাহারে কন্যাসন্তানকে দু’লক্ষ টাকা আর্থিক সাহায্য, উজ্জ্বলা ও লাডলি বহেন যোজনার আওতায় থাকা পরিবারকে ৪৫০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, গরিব পরিবারকে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন, কৃষিপণ্যে সহায়ক-মূল্য বৃদ্ধি ছাড়াও কৃষক সম্মাননিধি প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে ১২ হাজার টাকা সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। তারাও ৫০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, মহিলাদের ১৫০০ টাকা আর্থিক সাহায্য, বিনামূল্যে শিক্ষা, বেকারভাতা দেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু সরকারে থাকার সুবাদে গত কয়েক মাস ধরে মহিলা ভোটারদের হাতে নগদ টাকা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন শিবরাজ। ভোটের দৌড়ে পিছিয়ে থেকে শুরু করে শেষবেলায় কি ‘ফোটো ফিনিশে’ বাজিমাত করবেন ‘মামা’?