গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করলে যে আখেরে উন্নয়নের পথই প্রশস্ত হবে, সে কথা অবুঝমাঢ়ের জঙ্গলের জনজাতিদের বোঝাতে পারেননি ‘নিউটন’ ছবির ভোট-অফিসার নিউটন কুমার। কিন্তু মাওবাদী-উপদ্রুত বস্তার ডিভিশনের একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব নিয়ে ‘নিউটন’ ছবিটির নামভূমিকার অভিনেতা সরকারি অফিসার রাজকুমার রাও বুঝতে পেরেছিলেন ‘রেড করিডর’ (মাওবাদীদের ভাষায় কমপ্যাক্ট রেভলিউশনারি জ়োন)-এ গণতন্ত্রের আসল চেহারা।
সেই মাওবাদী আতঙ্ক সঙ্গে নিয়েই মঙ্গলবার আবার গণতন্ত্রের পরীক্ষায় ছত্তীসগঢ়। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে এই দফায় ভোটগ্রহণ হবে মাওবাদী-উপদ্রুত ২০টি কেন্দ্রে। এর মধ্যে রয়েছে বস্তার ডিভিশনের সাতটি জেলার (বস্তার, দন্তেওয়াড়া, বিজাপুর, নারায়ণপুর, সুকমা, কোন্ডাগাঁও এবং কাঁকের) ১২টি বিধানসভার সবক’টি। বাকি ৮টি লাগোয়া দুর্গ ডিভিশনের। শাসক কংগ্রেস এবং প্রধান বিরোধীদল বিজেপি সবক’টিতেই লড়ছে। এ ছাড়া রয়েছে বিএসপি-সহ কয়েকটি সর্বভারতীয় এবং আঞ্চলিক দল। এই দফায় মোট ২২৩ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করবেন প্রায় ৪০ লক্ষ ৭৯ হাজার ভোটদাতা। গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা রমন সিংহ (রাজনন্দগাঁও), প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি দীপক বৈজ (চিত্রকোট) এবং প্রবীণ আদিবাসী নেতা তথা প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মোহন মরকম।
প্রতি বারের মতোই এ বারও ‘নিয়ম মেনেই’ ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে নিষিদ্ধ সংগঠন সিপিআই (মাওবাদী)। ভোটপর্ব শুরুর ৭২ ঘণ্টা আগে ছত্তীসগঢ়ের নারায়ণপুর জেলার প্রভাবশালী বিজেপি নেতা রতন দুবেকে খুন করে ইতিমধ্যেই নিজেদের শক্তি নতুন করে জানান দিয়েছে তারা। কাঁকেরে কেন্দ্রীয় বাহিনী বিএসএফের অভিযানে নিহত হয়েছেন মাওবাদী গেরিলা বাহিনী পিএলজিএ-র দুই সদস্য। এই পরিস্থিতিতে ‘নিউটনদের’ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন। কারণ, অতীতে বহু বারই ভোটের দিন হামলার শিকার হয়েছেন ভোটকর্মীরা। এ বার রাজ্য পুলিশের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয়েছে ৭০০ কোম্পানিরও বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী (প্রতি কোম্পানিতে ১০০ জনেরও বেশি জওয়ান এবং অফিসার থাকেন)।
এর পাশাপাশিই মাওবাদী হামলার সবচেয়ে বেশি আশঙ্কা রয়েছে, এমন ‘অতি স্পর্শকাতর’ ১০টি বিধানসভায় ভোটগ্রহণ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। অন্য ১০টি আসনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোটগ্রহণ হবে। রুপোলি পর্দার নিউটনের মতোই সব মিলিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের কোনও অঙ্গরাজ্যের নির্বাচন, না কি ইউক্রেন বা গাজ়ার যুদ্ধ পরিস্থিতি, ভোটের ‘রেড করিডরে’ তা নিয়েই এখন প্রশ্ন বস্তারবাসীর। এ বারের বিধানসভা ভোটে রাজ্যের অন্যত্র ‘মহাদেব বেটিং অ্যাপ দুর্নীতি’, ‘ইডির পক্ষপাতদুষ্ট হানাদারির’ মতো বিষয় নিয়ে রাজনীতির শোরগোল চললেও প্রথম দফার ভোটে সেগুলি প্রচারে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারেনি।
এমনকি কৃষিঋণ মকুব, ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যুৎ, ধানের দাম কুইন্টাল প্রতি ৩২০০ টাকা করা, একর প্রতি ২০ কুইন্টাল ধান কেনা, গ্যাসের সিলিন্ডারে ৫০০ টাকা ভর্তুকির মতো কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘জনমুখী’ প্রস্তাবও মাওবাদী এলাকায় খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না বলে কয়েকটি জনমত সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে। তবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কলেজ স্তর পর্যন্ত বিনাখরচায় পড়াশোনা এবং কেন্দুপাতার বস্তা-প্রতি সরকারি মূল্য ৬০০০ টাকা করার প্রতিশ্রুতির সুফল জনজাতি ভোটে ভূপেশ বঘেল পেতে পারেন বলে মনে করছেন ভোট পণ্ডিতদের একাংশ।
২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটে দেড় দশকের বিজেপি শাসনের ইতি ঘটিয়ে প্রথম বার বিধানসভা ভোটে জিতে ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতা দখল করেছিল কংগ্রেস। রাজ্যের ৯০টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ৬৮টি জিতেছিল তারা। বিজেপি মাত্র ১৫টি। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীর দল ‘জনতা কংগ্রেস ছত্তীসগঢ়’ (জেসিসি) পাঁচটি এবং তার সহযোগী বিএসপি দু’টি বিধানসভা আসনে জয়ী হয়েছিল। মঙ্গলবার প্রথম দফায় যে ২০টি আসনে ভোট হতে চলেছে, গত বার তার মধ্যে ১৭টিতেই জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস। বিজেপি দুই এবং জেসিসি একটিতে জেতে। পরে বিজেপি এবং জেসিসি বিধায়কের মৃত্যুতে হওয়া উপনির্বাচনে দন্তেওয়াড়া ও খয়িয়ারগড় আসন দু’টি ছিনিয়ে নিয়েছিল কংগ্রেস। অর্থাৎ ২০টির মধ্যে ১৯টিই এখন কংগ্রেসের দখলে।
বস্তার অঞ্চলের রাজনীতির খোঁজ রাখা সংবাদকর্মী মুকেশ চন্দ্রাকরের মতে, এ বার পরিস্থিতির কিছুটা বদল ঘটবে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রভাবশালী আদিবাসী নেতা অরবিন্দ নেতম কংগ্রেস ছেড়ে নতুন দল ‘হামার রাজ পার্টি’ গড়ে জনজাতি প্রভাবিত অধিকাংশ আসনে প্রার্থী দেওয়ায় সুবিধা পেতে পারে বিজেপি। তা ছাড়া, মূলত আদিবাসী খ্রিস্টানদের সংগঠন সর্ব আদি দল এই প্রথম বার ভোটে লড়তে নামায় বস্তার অঞ্চলের সাতটি জেলায় বিড়ম্বনা বাড়তে পারে মুখ্যমন্ত্রী বঘেলের দলের।
এমন সম্ভাবনার কথা স্বীকার করছেন সাকিল রিজভিও। বস্তার জেলার সদর জগদলপুরের এই বাসিন্দা গত দু’দশক ধরে অরণ্যবাসী জনজাতিদের উন্নয়ন এবং বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত। সোমবার আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘‘অনুন্নয়নের সঙ্গে যে মাওবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধির প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে, তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। দীর্ঘ দিন ধরে খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদে পূর্ণ বস্তারের মানুষ বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাঁদের অঞ্চল থেকে পাওয়া রাজস্বের টাকা খরচ করে রমন সিংহের সরকার রায়পুরে স্মার্ট সিটি বানিয়েছে। কিন্তু আদিবাসী গ্রামগুলি থেকে রোগীদের আনার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স ঢোকার মতো সড়ক তৈরি করেনি। তবে এ কথাও বলতে হবে যে, গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও বদলেছে। ভূপেশের জমানায় উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে মাওবাদী প্রভাবিত কিছু এলাকায়।’’
অনুন্ননের পাশাপাশি আদিবাসীদের কর্মসংস্থানের অভাবকেও মাওবাদী তৎপরতার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন সাকিল। তিনি বলেন, ‘‘দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লৌহ আকরিক ছত্তীসগঢ় থেকে পাওয়া যায়। মেলে অন্য নানা খনিজও। গত কয়েক দশকে এখানে একাধিক খনি তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএমডিসি (ন্যাশনাল মিনারাল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন)। কিন্তু সেই সংস্থার সদর দফতর হায়দরাবাদে। উচ্চপদগুলিতে তো বটেই, নিচুতলাতেও তেলঙ্গানা আর অন্ধ্রপ্রদেশের লোকেরা কাজ করেন। বস্তারের আদিবাসীদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলে তাঁরাও নিজেদের এলাকার খনিশিল্পে চাকরির সুযোগ পেতেন।’’
তবে অনুন্ননের এই ‘ফাঁক’ গলে ঢুকে পড়া মাওবাদীরা শেষ পর্যন্ত ভোট বয়কটের অবস্থানের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ থাকবেন, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে সাকিলের। তিনি বলেন, ‘‘নব্বইয়ে দশকে যাঁরা নকশাল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে এখনকার নেতাদের ফারাক রয়েছে। এখন ওঁদের একটি অংশের মধ্যে তোলাবাজি, রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা রয়েছে। তবে অতীতে মাওবাদীরা ভোট বয়কটের ফরমানের আড়ালে কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের প্রার্থীদের হারানোর উপর জোর দিলেও এ বার মাওবাদীরা সর্বতো ভাবে ভোট বানচালের উপরেই জোর দিচ্ছে।’’ সাকিলের মতো মুকেশেরও তা-ই অভিমত।
‘নিউটনদের’ নিরাপত্তা নিয়ে তাই এ বার কি বাড়তি শঙ্কা কমিশনের?