Madhya Pradesh Assembly Election 2023

বন্দুক তোলার জন্য হাত নিশপিশ করে, তবু চাষির জন্য ‘হাত’ ধরলেন চম্বলের এক সময়ের ত্রাস মলখান

তবে এখনও বন্দুক ধরতে ইচ্ছে করে মহিলা-শিশুরা অত্যাচারিত হলে। কিন্তু যে হাত এক বার বন্দুক ত্যাগ করেছিল, সেই হাতে আর বন্দুক স্পর্শ না করার শপথ নিয়েছিলেন মলখান সিংহ।

Advertisement
অনমিত্র সেনগুপ্ত
লহার (ভিন্দ) শেষ আপডেট: ১৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:২৬
malkhan singh.

মালখন সিংহ। এখন যেমন। —নিজস্ব চিত্র।

কৃষকদের উপরে অবিচার আর বঞ্চনা দেখে আজও তাঁর হাত নিশপিশ করে বন্দুক তোলার জন্য।

Advertisement

বন্দুক ধরতে ইচ্ছে করে মহিলা-শিশুরা অত্যাচারিত হলে। কিন্তু যে হাত এক বার বন্দুক ত্যাগ করেছিল, সেই হাতে আর বন্দুক স্পর্শ না করার শপথ নিয়েছিলেন। আর তাই আমজনতার উপরে হওয়া যাবতীয় অন্যায়-অবিচার ও দুর্নীতির জবাব দিতে কংগ্রেসের হাত চিহ্নে ভরসা রেখেছেন চম্বলের এক সময়ের ত্রাস, ‘ডাকু’ মলখান সিংহ ওরফে ‘দাদ্দা’। বলছেন, কৃষকদের যাবতীয় সমস্যা দূর করবে কংগ্রেসই।

নিজেকে অবশ্য ডাকাত নয়, ‘বাগী’ বলতে পছন্দ করেন মলখান। পঁচাত্তরের কাছাকাছি বয়স হলেও, এখনও পেটানো, ফিট চেহারা তাঁর। কপালে লাল তিলক। চুল পাতলা হয়ে এলেও, পেল্লায় গোঁফ গাল ছাপিয়ে গিয়েছে। মলখান এ যাত্রায় গোয়ালিয়র-ভিন্দ-মোরেনার প্রায় দু’ডজন আসনে কংগ্রেসের প্রচারের প্রধান মুখ— চম্বলের ক্ষত্রিয় অধ্যুষিত এলাকায় দলের ক্ষত্রিয় তাস। মলখান মাঠে নামায় স্বভাবতই ক্ষত্রিয় ভোটের মেরুকরণ হয়েছে কংগ্রেসের পক্ষে। দল মনে করছে, মানুষ এই এলাকায় বিজেপির উপরে ক্ষুব্ধ। তাঁরা পরিবর্তন চাইছেন। হাওয়া কংগ্রেসের পক্ষে। তার উপরে মলখানকে পাশে পাওয়ায় ক্ষত্রিয়দের পাশাপাশি গরিব, খেটে খাওয়া মানুষও তাদের পাশে থাকবেন বলে কংগ্রেস আশাবাদী।

বেহড়ের অনেক বাগীর মতোই কিশোর বয়সে হাতে অস্ত্র ধরেছিলেন মলখান। গড়ে তুলেছিলেন নিজের দল। সত্তরের দশকের গোড়ায় সেই দলে ছিল প্রায় পঞ্চাশ জন। চম্বল এলাকা তিন রাজ্যের সীমানায় হওয়ায় মধ্যপ্রদেশের ভিন্দ ও দাতিয়া, উত্তরপ্রদেশের আগরা ও ইটাওয়া এবং রাজস্থানের একাধিক এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন মলখান। জমি মাফিয়া, সুদখোর মহাজনদের উপরে ধারাবাহিক আক্রমণ শানিয়ে, সেই টাকায় গরিব লোকেদের সাহায্য করে হয়ে উঠেছিলেন ‘রবিনহুড’।

লহার বিধানসভায় কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী গোবিন্দ সিংহের নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে স্থানীয় আইনজীবী, বছর সত্তরের ব্রজেশ সিংহ চৌহান বললেন, ‘‘কখনও গরিবের উপর মলখান অত্যাচার করেছেন বলে শুনিনি। বরং মেয়ের বিয়ে থেকে ছেলের পড়ার খরচ জোটাতে হলে মলখানের কাছে সাহায্য চাইলেই পেয়ে যেতেন গরিবরা। তাই স্থানীয় পর্যায়ে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল দেখার মতো।’’ সেনা জওয়ান থেকে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিট এবং শেষ পর্যন্ত ‘বাগী’ হয়ে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া এই এলাকার পান সিংহ তোমরের মতোই জমি বিবাদকে কেন্দ্র করে মলখান প্রথম জাতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে এসেছিলেন। ১৯৭৬ সালে বিলাও গ্রামের সরপঞ্চ কৈলাস নারায়ণ একটি মন্দির সংলগ্ন জমি দখল করতে গেলে বাধা দেন মলখান। কৈলাসের উপরে হামলা চালায় মলখানেরদল। কৈলাস ছ’টি গুলি খেয়েও বেঁচে যান। আশির দশকের শুরুতে মধ্যপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংহের আহ্বানে আত্মসমর্পণ করেন মলখান। ১৯৮৯ সালে জেল থেকে ছাড়া পান। তাঁর বিরুদ্ধে এক সময়ে কম-বেশি ৯৪টি মামলা দায়ের ছিল। তার মধ্যে ১৮টি ডাকাতির, ২৮টি অপহরণের, ১৯টি খুনের চেষ্টার ও ১৭টি খুনের। ২০১৩ সালের মধ্যে প্রমাণের অভাবে সব মামলা থেকেই রেহাই পেয়ে যান।

গোয়ালিয়র থেকে গাড়িতে ঘণ্টাতিনেক গেলে খাড়িয়া গ্রাম। কারেরা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী প্রাজিলাল জাটভের হয়ে প্রচারে এসেছিলেন মলখান। বেহড় বা চম্বল বলতেই শুকনো, অনুন্নত, পিছিয়ে পড়া এক এলাকার যে চেহারা মনে ভেসে ওঠে, সেই ছবি পাল্টেছে অনেক দিনই। বেহড় এখনও রয়েছে। কিন্তু এখানকার সড়ক এখন চওড়া, পাকা। চম্বল নদী থেকে সেচের কারণে সড়কের দু’পাশের খেত সজীব। চলছে শীতের ফসল বোনার প্রস্তুতি। গ্রামে যখন পৌঁছলাম, তখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে বিজেপি সরকারকে বিঁধছিলেন মলখান। সরকারি প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ফসল বিক্রির সময়ে সহায়ক মূল্যের সুবিধা কিংবা ন্যায্য দাম না পাওয়া, সারের অভাব, মূল্যবৃদ্ধির মতো বিষয়গুলি নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সরব হচ্ছেন মলখান। বক্তৃতায় বলছেন, ‘‘কংগ্রেস এলে কৃষকদের যাবতীয় সমস্যা দূর করায় প্রথমে নজর দেওয়া হবে।... আমি ক্ষত্রিয়। ক্ষত্রিয় কখনও কথার খেলাপ করে না।’’ এই এলাকাথেকেই ১৯৯৮ ও ২০০৩ সালে নির্বাচনে লড়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন মলখান। ২০১৩ সালে বিজেপির হাওয়ায় নরেন্দ্র মোদীর দলে নাম লেখান। গত বছর দল পাল্টান। মলখানের দাবি, রাজ্য ও কেন্দ্রে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ সত্ত্বেও তীব্র অনুন্নয়ন দেখে তাঁর এই সিদ্ধান্ত। খাড়িয়া গ্রামের নির্বাচনী প্রচারসভায় উপস্থিত রাকেশ কিংবা পঞ্চাশোর্ধ্ব মুন্নি দেবী— সকলেই এসেছিলেন মলখানকে দেখতে। বললেন, ‘‘ডাকু ছিল ঠিকই, কিন্তু এখন যা বলছে, তা সত্যি। কৃষকদের কথা কেউ ভাবে না।’’

পরের গন্তব্য লহার বিধানসভার কংগ্রেস প্রার্থী তথা বিধানসভার বর্তমান বিরোধী দলনেতা গোবিন্দ সিংহের নির্বাচনী কার্যালয়। সন্ধ্যার মুখে সেখানেই দেখা মিলল মলখানের। দিনভর ঠা ঠা রোদ্দুরে প্রচার করেও সত্তরোর্ধ্ব মলখান তখন রীতিমতো তরতাজা। বিজেপি ছেড়ে কেন কংগ্রেসে এলেন, সেই প্রশ্ন উঠতেই টানটান হয়ে বসলেন। বললেন, ‘‘পরিবর্তন প্রয়োজন। কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’জায়গাতেই। দশ বছর আগে ক্ষমতায় আসার আগে কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। একটাও পূরণ হয়নি। রাজ্যে গত দু’দশকে কিছু করেনি শিবরাজ সিংহ চৌহানের সরকার। কৃষকদের হাতে আজও টাকা নেই। মহিলাদের সম্ভ্রম বিপন্ন। খিদের জ্বালায় ছেলেমেয়েকে বিক্রি করে দিচ্ছে গরিবেরা। সরকারের কোনও হেলদোল নেই। তাই বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে এসেছি।’’

বিজেপি আবার মলখানের ‘ডাকু’ পরিচয় তুলে ধরেই পাল্টা প্রচারে নেমেছে। লহার কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী গুড্ডু শর্মা বললেন, ‘‘কংগ্রেস এক জন ডাকুকে প্রচারে নামিয়েছে। মানুষকে ভয় দেখিয়ে তারা ভোট লুট করতে চাইছে।’’ মলকানকে এ কথা বলতেই তাঁর সপাট উত্তর, ‘‘আমি ডাকু নই, বাগী। বিদ্রোহী। আর সংসদে যাঁরা আছেন, তাঁরা কী?’’

মলখান নিজে বিভিন্ন দলের টিকিটে বিধানসভায় লড়ে জিততে না পারলেও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী ললিতা রাজপুত গুনা লোকসভার সিঙ্গাইয়ি পঞ্চায়েতে জিতে সরপঞ্চ হয়েছেন। এ যাত্রায় মলখানকে কংগ্রেস টিকিট দিতে চাইলেও লড়তে চাননি তিনি। উল্টে চম্বল এলাকায় কংগ্রেস প্রার্থীদের জিতিয়ে এনে দলে নিজের প্রভাব প্রতিষ্ঠার কৌশল নিয়েছেন। ঘনিষ্ঠ শিবিরের দাবি, মলখানের আসল লক্ষ্য লোকসভা। তাই আপাতত সেই লক্ষ্যেই মনোনিবেশ করেছেন বৃদ্ধ বাগী।

Advertisement
আরও পড়ুন