Madhya Pradesh Assembly Election 2023

হাওয়া কি বদলাতে পারবেন জ্যোতিরাদিত্য

মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ভিন্দ, মোরেনা— চম্বল নির্বাচনী অঞ্চলের এই এলাকায় ৩৪টি বিধানসভা আসন। পাঁচ বছর আগের বিধানসভায় ওই এলাকায় ২৪টি আসনে জিতেছিলেন জ্যোতিরাদিত্য সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীরা।

Advertisement
অনমিত্র সেনগুপ্ত
গোয়ালিয়র শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:২৬
Jyotiraditya Scindia

জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া। —ফাইল চিত্র।

পাঁচ বছর আগে মধ্যপ্রদেশে সরকার গড়েছিল কংগ্রেস। ‘কিংমেকার’ ছিলেন তিনি।

Advertisement

দেড় বছরের মাথায় সেই মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের সরকার ফেলে দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিজেপি। সে যাত্রাতেও সরকার গড়ার কারিগর তিনিই।

তবে মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক আগে সেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পথের ধুলোয় আমজনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে ভোট চাইতে হচ্ছে। স্রেফ নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব বাঁচাতে।

গোয়ালিয়রের প্রবাদই হল, ভোপালে ক্ষমতায় বিজেপি থাকুক বা কংগ্রেস, সিন্ধিয়া রাজভবনের কোনও একটি মহল থেকে মন্ত্রীর নীল বাতি লাগানো গাড়ি বেরোবেই বেরোবে। এ যাবৎ সেই গাড়ি বার হত পিসি যশোধরা রাজে সিন্ধিয়ার মহল থেকে। বর্তমান সরকারে মন্ত্রী তিনি। কিন্তু এ বার আগেই নির্বাচনী লড়াই থেকে সরে যাওয়ার কথা ঘোষণা করে দেন তিনি। অন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মধ্যপ্রদেশে নির্বাচনে দাঁড়ালেও, বাদ গিয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য। যার ফলে বেশ কয়েক দশক পরে নির্বাচনী যুদ্ধে অনুপস্থিত সিন্ধিয়া রাজপরিবারের সরাসরি প্রতিনিধিত্ব। তবে ভোটে না দাঁড়ালেও, প্রবল ভাবে নির্বাচনী লড়াইয়ে রয়েছেন জ্যোতিরাদিত্য।

মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র, ভিন্দ, মোরেনা— চম্বল নির্বাচনী অঞ্চলের এই এলাকায় ৩৪টি বিধানসভা আসন। পাঁচ বছর আগের বিধানসভায় ওই এলাকায় ২৪টি আসনে জিতেছিলেন জ্যোতিরাদিত্য সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীরা। ফলে কংগ্রেসের সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব, বিশেষ করে কমল নাথের সঙ্গে বিবাদের জেরে নিজের অনুগামী বিধায়কদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন জ্যোতিরাদিত্য। সরকার গড়ে বিজেপি। কংগ্রেসের জেতা বিধায়কদের ভাঙিয়ে নেওয়ার খেলায় তখন জিতলেও, সময় বলছে, তার মূল্য এখন দিতে হচ্ছে সিন্ধিয়া রাজপরিবারের ‘মুখিয়া’কে।

যে গোয়ালিয়র ও সংলগ্ন এলাকার মানুষ এক সময়ে সিন্ধিয়া পরিবারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখিয়ে এসেছেন, আজ তাঁরাই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। গোয়ালিয়র স্টেশনের পাশেই বইয়ের দোকান সমরবীর চৌহানের। আজীবন কংগ্রেসের ভোটার চৌহানের কথায়, ‘‘নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা একেবারে শেষ করে ফেলেছেন জ্যোতিরাদিত্য। এই অঞ্চলের প্রথাই কংগ্রেসের পক্ষে থাকা। মানুষ এ বার তাই প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে রয়েছে।’’

প্রতিশোধের ভূত ঘুরছে স্থানীয় অটোওয়ালা দীনেশ থেকে মিষ্টি দোকানের মালিক মুন্না বাঘেলের মাথায়। প্রায় দু’দশক বিজেপি শাসনের ফলে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার হাওয়া প্রবল গোটা মধ্যপ্রদেশে। উপরি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছে জ্যোতিরাদিত্যের বিশ্বাসঘাতকতা। দীনেশ বা মুন্না তাই এক বার রাজপরিবারকে বুঝিয়ে দিতে চান, আমজনতার ক্ষমতা। সরকারি কর্মচারি বাবলু চৌধরি আবার নতুন পেনশন প্রকল্প নিয়ে ক্ষুব্ধ। তিনিও চান, জ্যোতিরাদিত্যের অনুরাগী বিজেপি প্রার্থীদের হারিয়ে কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত করা। যাতেপুরনো পেনশন প্রকল্প নতুন করে চালু হতে পারে।

গোয়ালিয়রের শিণ্ডে কি ছাউনি এলাকায় এমআইবি রোডে শ্রীমন্ত মাধবরাও সিন্ধিয়া কংগ্রেস ভবন। এক সময়ে দলের কাজকর্ম এখান থেকেই সামলাতেন জ্যোতিরাদিত্য। ভোটের মুখে ভিড় আছে ঠিকই, কিন্তু জ্যোতিরাদিত্যের ব্যক্তিত্বের কারণে যে চনমনে ভাব দলীয় কার্যালয়ে থাকত, তার ঘাটতি স্পষ্ট। উপস্থিত কংগ্রেস কর্মী রমেশ সাহুর আক্ষেপ, দল বদলের সময়ে যে ধাক্কা কংগ্রেসে পড়েছিল, তার পুরোটা এখনও সামলানো যায়নি। চার-পাঁচ জন বিধায়ক কংগ্রেসে ফিরে এসেছেন বটে। কিন্তু তাতেও ক্ষত পুরো মেরামত হয়নি। তবু কংগ্রেস বিচার চাইছে গোয়ালিয়র-চম্বল এলাকার মানুষের কাছে। কারণ, নিজের ‘রাজত্বে’ই এখন প্রবল বিরোধিতার মুখে জ্যোতিরাদিত্য।

গোয়ালিয়র শহর ছেড়ে ঘণ্টা খানেক যেতেই মেহগাঁও বিধানসভা। জাতীয় সড়কের দু’পাশে আদিগন্ত ক্ষেত। অতীতের রুখা-শুখা জমির মন ভিজেছে চম্বলের জলে। শীতের শুরুতে তাই গম চাষে ব্যস্ত কৃষকেরা। কিন্তু ফসলের দাম না পাওয়া, বীজধান ও সারের ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধি, ফসল বিমা প্রকল্পে দুর্নীতি— বিজেপি সরকারের উপর ক্ষেপে রয়েছেন কৃষকেরা। ওই ক্ষোভ যাতে বিজেপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটবাক্সে উগরে দেন ভোটারেরা, তার জন্য প্রচারে খামতি রাখছে না কংগ্রেসও। কারণ, কংগ্রেসও বুঝতে পারছে, তারা যদি চম্বল এলাকায় ভাল ফল করে, ক্ষমতায় ফেরা যেমন অনেকটাই নিশ্চিতহবে, তেমনই জ্যোতিরাদিত্যের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনিশ্চিত করে দেওয়া যেতে পারে।

হাওয়ায় যেমন ইঙ্গিত, তাতে বিজেপির পক্ষে রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন বলে এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, গোয়ালিয়র-চম্বল এলাকায় ভাল ফলের জন্য জ্যোতিরাদিত্যের উপরেই বাজি ধরেছেন বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। জ্যোতিরাদিত্যের লক্ষ্য, গত বারের মতোই অন্তত কুড়িটি আসন ওই এলাকা থেকে জিতে মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিতে কর্তৃত্ব বজায় রাখা। তার জন্য মাঠে নেমে প্রচারে খামতি রাখছেন না তিনি। কিন্তু তাঁরই ঘনিষ্ঠ শিবির মনে করছে, বিজেপির পক্ষে প্রচারে নেমে গত বারের মতো ভাল ফল হওয়া কঠিন। আর তা বুঝেই নিজের উপরে ভরসা না করে নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহকে বার বার প্রচারে নিয়ে এসেছেন জ্যোতিরাদিত্য। কারণ, তিনি জানেন ব্যর্থ হলে রাজ্য-রাজনীতিতে তাঁর কার্যত অস্তিত্বহীন হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে প্রতিটি জনসভায় জ্যোতিরাদিত্যকে বলতে শোনা যাচ্ছে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নন। পূর্ব গোয়ালিয়র কেন্দ্রে কংগ্রেস প্রার্থীর নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা বিজয়বাহাদুর সিংহের মতে, ‘‘বার বার ওই কথা বলে, জ্যোতিরাদিত্য বোঝাতে চাইছেন, তিনিও মুখ্যমন্ত্রিত্বের দৌড়ে রয়েছেন। যদি চম্বল এলাকায় বিজেপি ভাল ফল করে, তা হলে তাঁর কুর্সির দাবি পাকা হবে। সেই কারণেই প্রতিটি ভাষণে মুখ্যমন্ত্রিত্বের বিষয়টি উল্লেখ করতে ছাড়ছেন না তিনি।’’

মধ্যপ্রদেশের জনশ্রুতি, পাঁচ বছর আগে কংগ্রেস ক্ষমতায় যখন এসেছিল, তখন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কমলনাথের কাছে ভোপালে একটি বাংলোর দাবি করেছিলেন জ্যোতিরাদিত্য। হেরে যাওয়া বিজেপি মন্ত্রীদের বাংলোয় থাকার মেয়াদ বাড়লেও, তাঁর আবেদন গ্রাহ্য হয়নি। সেই ক্ষোভই না কি সরকার ফেলার অন্যতম প্রধান উৎস!

এখন দেখার, বাংলোর সেই লড়াই জ্যোতিরাদিত্যকে ভোপালের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে নিয়ে যাবে না কি তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব আটকে থাকবে গোয়ালিয়র দুর্গের চৌহদ্দিতেই?

আরও পড়ুন
Advertisement