প্রত্যেকবার পুজোয় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, তাই আমার শরৎ চেতনায় আস্তে আস্তে প্রবেশ করছে ওষুধের গন্ধ। বাবার কোল ঘেঁষে নরম কম্বলের তলায় শুয়ে মহালয়া শুনতে শুনতে জ্বোরো শরীরে আমি ঘুমিয়ে পড়ি কখন। স্বপ্নের ভিতর সেই বিশাল মাঠ। যার অন্ত নেই যেন। সে বিস্তারিত হতে হতে আমার অন্তরে, অস্তিত্বে জড়িয়ে গেছে। আজও আমার বিশ্রামের কাঙ্খায় সেই সবুজমাঠ শান্তি ও তন্ময় তা হয়ে আসে। বিশ্বে এমন সুন্দর মাঠ আর কোথাও নেই। কেউ তার খবর জানেনা। তাকে এখন মন দিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, চক্ষু দিয়ে নয়। যেন সেই মাঠ একপ্রেম।
আমাদের খেলার মাঠ অমন বড় নয়। আবার ছোটও নয়। সেই মাঠেই আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়, আমাদের পুজা মণ্ডপ। এই মহালয়ার দিন থেকে ঘুরে-ফিরে আমরা মণ্ডপের দুয়ারে গিয়ে দাঁড়াই। দেখতে পাই, দেবী ধীরে ধীরে পূজিত হওয়ার জন্য গড়ে উঠছেন।
এভাবেই ছোটবেলা থেকে পেরিয়ে এলেম বাল্য। এখন আমরা বয়ঃসন্ধিতে। আমাদের সবার চোখ পালটে যাচ্ছে। দৃষ্টি এখন অন্যতর। পৃথিবী বদলে গেছে, যা দেখি নতুন লাগে। আমাদের হৃদয় থেকে উৎসারিত কথা লাউড স্পিকারে গান হয়ে বেজে উঠছে। কিন্তু যে দৃষ্টি এসে পড়ে আমাদেরই উপর, এতকালের চেনা জানা চোখ, সে সবও পালটে গিয়েছে বিল্কুল। কারও চোখে খুশি মেশানো বিস্ময়, কেউ কেবলই অবাক, কেউ কেউ সতর্ক, বিশেষ করে মা-কাকিমারা। আবার অনেক জোড়া চোখে কেমন এক নতুন ভাষা। অনুভব করতে পারছি, বুঝতে পারছিনা। কেমন গা শিরশির করা, বুক হিম করা, এক লজ্জারুণ প্রকাশ আমাদের ছুটিয়ে নেয় দূরে। সন্ধ্যাকাশ আমাদের জন্য ফাঁদ পাতছে , আমরা বুঝি, আবার বুঝিনা যেন। এর মধ্যেই দু-একজন ঋতুমতী হল। আমাদের এত কালের বন্ধুত্বের মধ্যে এসে গেল মেয়েদের নিজস্ব জগৎ।
আরও পড়ুন: পুজোর প্রাপ্তি ছিল ঠাকুরমার তৈরি পাউরুটির মিষ্টি আর নিমকি
স্বপ্নের ভিতর সেই বিশাল মাঠ। যার অন্ত নেই যেন।
মন খারাপ, খুব মন খারাপ। সব আছে, অথচ কী যেন নেই। জ্বরের আমিকে নিয়ে মা বাড়িতে রয়ে গেছেন। বাবা অন্যদের নিয়ে পুজোর বাজার করতে গেলেন। কাগজে আমার ও মায়ের পায়ের ছাপ গেল সঙ্গে, পা ঘরে রইল। বিকেল বেলা রুপাই এল আমায় দেখতে। আমাদের চা বাগানের বড় ট্রাক চেপে গিয়েছে তো সবাই পুজোর বাজারে। রুপাই তুই যাসনি? তোরও কি জ্বর?
নানা, জ্বর হলে কি ঠামু বেরুতে দিত?চেপে ধরে বার্লি গেলাত। অন্য সবাই গেছে। আমার তো ‘শরীরখারাপ, তাই নিয়ে যায়নি। ভালই হয়েছে। হিহি।
শরীর খারাপ কখন ওই ভালনা। জ্বর নয়, তাহলে নিশ্চয় আমাশা। সেদিন অত আচার খেলি। বৃন্দাবন দাদার আচারে কাটা আঙুল পাওয়া গেছিল।
ধুত। আমার ইয়ে হয়েছে। মাসিক মাসিক। তোরও শিগগির হয়ে যাবে। ঠামু বলছিল। আমরা তো সম বয়সি। শোন, অমৃত লামা আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমাকে ভালবাসে। প্রেম করতে চায়, তারপর চাকরি পেলেই বিয়ে করে নেবে। চিনিস তো? নাইনে পড়ে অমৃত।
চিনি, চিনি। এই নিয়ে তো পাঁচ জনের চিঠি পেলি। কাকে ধরে কাকে ছাড়বি?
হিহিহি। অমৃত কী দারুণ গান গায়। আমি তো ভাল নাচি। ও গাইবে, আমি নাচব। কমলহাসান, রতি অগ্নিহোত্রী। রুপাই- অমৃত। যাচ্ছি। আজ ওর সঙ্গে দেখা হবে। তোকে তো সব বলি। তারপর তোর জ্বর। তাই এলাম। অমৃতকে কী সুন্দর দেখতে, বল? কোঁকড়া চুল আমার ভীষণ ভাল লাগে। গায়ের রঙ তো সাহেবদের মতো।
ও তো নেপালি। বাড়িতে রাজি হবে?
নয়তো বাণী পিসির মতো আমিও পালিয়ে যাব। একবার কপালে সিঁদুর উঠে গেলে আর কেউ কিছু করতে পারেনা, ছোট্মাসি বলেছে।
রুপাই হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। বাবা আমার জন্য কেমন জামা আনবেন, ক’খানা আনবেন আমি আর ভাবছিনা। রুপাইয়ের জন্য আমার ভাবনা হচ্ছে। সেকী হৃদয় তোলপাড় করা দুশ্চিন্তা। আজই চিঠি পেয়েছে, আজই প্রথম মুখোমুখি কথা হবে, আর আমরা বিবাহ অবধি পৌঁছে গেছি, কেননা, সেই সদ্য মুকুলিত নির্মল যৌবনোন্মেষে প্রেম মানেই এক আকুল একগামিতা, যার পূর্ণতা বিবাহ। আর বিবাহ এক অপরূপ প্রাপ্তি জীবনের। সরলতা দিয়ে মোড়া রুপাইয়ের প্রেমে আমি মজে গেলাম। পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন পড়তেই আমার জ্বর পালাল। পূজার সম্ভারে বাবা আমার জন্য দু’ সেট পোশাক এনেছেন। আমার ভারী পছন্দ হয়েছে। কিন্তু রুপাইয়ের অনেক গুলো জামার মধ্যে একটা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। হলুদ বার্নিশ রঙের উপর পোল্কাডট প্যান্টস, গ্যালিস দেয়া। সঙ্গে সাদার উপর ছোট্ট ছোট্ট মিকি ছাপ টপ। আঃ, প্রত্যেকবার অলকা পিসি, রুপাইয়ের মা , কোথা থেকে খুঁজে খুঁজে এমন সব পোশাক আনেন রুপাইয়ের জন্য। সবচেয়ে সুন্দর পোশাক, কারণ রুপাই ভারী সুন্দর।
তুই ঠাকুরের কাছে এবার কী চাইবি রুপাই?
আমি চাইব, আমি যেন সিন্ডারেলার মতো সুন্দর থাকি সব সময়। আমার চেয়ে সুন্দর আর কেউ কোথাও থাকবে না। আর তুই? তুই কী চাইবি?
আমাদের এত কালের বন্ধুত্বের মধ্যে এসে গেল মেয়েদের নিজস্ব জগৎ।
মাঠে শুয়ে শেষ বিকেলের শরৎ আলোর মধুর লালিমা মাখানো মেঘ দেখতে দেখতে আমি ভাবছি কী চাওয়া যায়। আমি ক্লাসে প্রথম হতে চাই অবশ্য। সেতো সরস্বতী ঠাকুরের কাছে বলব। মাদুর্গার সঙ্গে তিনিও আছেন, কিন্তু এখন এসব বললে কি মনে থাকবে? বছরের গোড়াতেই সরস্বতী পূজার পরদিন খাগের কলম দুধের দোয়াতে ডুবিয়ে বেল পাতার পেছনে একশোআট বার সরস্বত্যই নম লেখার সময় এই প্রার্থনা জানিয়েছি। বার্ষিক পরীক্ষা এসে গেল। কালীপুজো শেষ হলেই পরীক্ষার তারিখ পেয়ে যাব।
আরও পড়ুন: ঘট আর ঘটার লড়াই দেখে মা মুচকি হাসলেন!
রুপাই আমার বিভ্রান্তি বুঝেছে হয়তো। বলছে, তুইকি আমার চেয়েও সুন্দর হতে চাস? নানা। সবাই বলে আমি আমার মায়ের মতো সুন্দর নই, দিদির মতোও না। এসবে আমার মন খারাপ হয় না। কেউ যদি শৈশব থেকে শোনে, তোমার নাকটা টিকলো নয়, ঠোঁট পাতলা নয়, চুল কালো নয়, চোখের মণি ঈষৎ পিঙ্গল, আর এই সবই সমালোচনার বিষয়, যদিও, চেহারা বা পরিবার নির্বাচনের কোনও উপায়নেই, তবুও এসব কথা হবেই, আর তার ফলে অনেক রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কারও বিষাদ, কারও আত্মকরুণা, কারও ঈর্ষা, বা সুন্দর হয়ে ওঠার উদগ্র চাহিদা, অথবা রূপ বিষয়ে ঔদাসীন্য, যাকিনা আমার, তাই আমি রুপাইকে আশ্বস্ত করতে পারি। তুই সিন্ডারেলা হলে আমার আপত্তি নেই, বাস্তবিক, পাড়ার জলসায় ও সিন্ডারেলা সেজেছিল গতবার, খুব প্রশংসা পেয়েছে।
তুই প্রেম করতে চাসনা? রুপাই বলে। কীযে ভাল লাগে। জানিস ও আমাকে চুমু খেয়েছে। কপালে আর গালে। বলেছে বিয়ের পর সব জায়গায় চুমু খাবে। ওখানেও। হিহিহি।
ওখানে মানে ? হিসু জায়গায়? অ্যা মাহ। গন্ধ লাগবেনা? আমি আর রুপাই যত কল্পনা করি, তত হাসি পায়। হাসতে হাসতে আমরা মাঠের ঘাসে গড়াগড়ি খাই। রুপাই বলে , আচ্ছা, তুই যদি প্রেম করিস তো কার সঙ্গে করবি? আমার চেতনায় একটি মুখ এসে দাঁড়ায়, আমি প্রকাশ করতে পারিনি। বরং সেই মুখ মনে করে লিখে দিই রুপাইয়ের প্রেমপত্র, তরতর করে চলে যাচ্ছে দিন। আনন্দে। অপেক্ষায়। অষ্টমীর রাতে রুপাই সেই সব চেয়ে সুন্দর পোশাক পরে মণ্ডপের পেছনে অমৃতের সঙ্গে দেখা করবে। যত আলো সব সামনে, পেছনে অন্ধকার। তুই পাহারা দিবিতো?
কেন দেবনা? আমরা সব্বাই পাহারা দেব। রুপাইকে সুন্দর করে পনিটেল করে দিয়েছেন অলকা পিসি, ওকে রাজকন্যার মতো লাগছে। আমরা ওসব নতুন জামা পরে বাজি পোড়াচ্ছি। পটকা ফাটাতে আমার মোটেই ভয় নেই। পটাই, গউত্তা, শুভ, নান্তু, ফুলি, রুরু, মিতু, সবার মন পড়ে আছে কখন আসবে সেই সময়, আমরা পাহারা দেব। আসলে দেখব, প্রেম কিকরে করে। রুপাই, তুই কিন্তু চুমু খাস, ।
অবশেষে সেই সময়। মণ্ডপে ঢাক বাজছে। পাড়ার সবাই উপস্থিত। ম্যারাপ ভরে আছে। কুচোদের আরতি শুরু হল। এরপর আমাদের। সব শেষে বড়রা। অমৃত এসে গেছে। অন্ধকারে মণ্ডপের দেওয়াল ঘেঁষে, গায়ে গা লাগিয়ে ওরা। আমরা লুকিয়ে দেখছি। খিকখিক, খ্যাঁকখ্যাঁক চাপা হাসি বন্ধুদের। আমাদের যে পাহারা দেওয়ার কথা, বড় কেউ যেন এসে না পড়ে, এলেই পটাই, নান্তু, রুরু শিস দেবে।
ওই ওই, অমৃত রুপাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরল, আর জোরালো আলোর বৃত্তে ধরা পড়ে গেল ওদের প্রেম। পালা পালা পালা অলকা পিসি।স্পষ্ট দেখলাম, জ্বলন্ত টর্চ দিয়ে রুপাইয়ের মাথায় জোর মারলেন অলকা পিসি। টর্চ নিভে গেল।
সে রাতে রুপাইকে আর দেখিনি। পর দিন সে এল গায়ে প্রহারের চিহ্ন নিয়ে, দেখে শিউরে উঠলাম। রুপাই- অমৃতের প্রেম সেরাতেই শেষ। তাহলে প্রেম শুধু আনন্দ আর পুলক নয়, শুধু শিহরন আর কল্পনার সুখ নয়, প্রেম তাহলে প্রহার। আঘাত। শাসন ও অত্যাচার। এবং বিচ্ছেদ।
সেই যে একজন এসেছিল আমার মনে, তার নাম আর বলা হয়নি, রোজ তার সঙ্গে দেখা হতো, কথা হাসি, গান শোনা, তবু বলা হয়নি। একবার বিজয়া দশমীতে সে হোলি খেলার মতো সিঁদুর মাখিয়ে দিল আমার মুখে, হয়তো তার মধ্যে কোনও বার্তা ছিল, হয়তো ছিলনা। আমি তলিয়ে ভাবতে চাইনি, কারণ তখন আমার আঠারো, আমি সিঁদুর প্রথার বিরুদ্ধে এক বিদ্রোহিণী। যদি একবার সে আমায় বলত, বা আমি তাকে, ভালবাসি। ভালবাসি।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy