আজ থেকে বছর চল্লিশেক আগে ভবানীপুরের পুরনো পাড়াগুলোয় যখন বিকেল হত, তখন মাঝে মাঝে ধুতি ফতুয়া পরা কিছু ফেরিওয়ালা, নিজের কাঁধে রাখা একখানা লম্বা লাঠির গায়ে, নানা রকম খেলনাপাতি ঝুলিয়ে, ধীর পায়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন। তাঁদের হাতে হয় থাকত একটি ডুগডুগি, আর তা নইলে একটা তারের খেলনা, যাকে গোল করে হাওয়ায় ঘোরালে খর্র্র্ করে একটা অদ্ভুত শব্দ হত। আর সেই আওয়াজ কানে গেলেই ছুটে যেতাম বাইরের বারান্দায়। তবে পুজোর চারটে দিন এঁদের সব সময়ের জন্যে দেখতে পাওয়া যেত আমাদের বাড়ির খুব কাছে, হরিশ পার্কের পুজো প্যান্ডেলের আশপাশে।
এই ফেরিওয়ালা দাদাদের কাঁধের লম্বা লাঠিতে আটকানো থাকত রঙচঙে কাগজের ঘুরনি, কঞ্চি দিয়ে বানানো তির-ধনুক, টুকটুকে লাল হাতলওয়ালা রাংতা জড়ানো চকচকে তরোয়াল। ঝুলত কাগজ ভাঁজ করে বানানো সাপ, প্লাস্টিকের লাল-নীল রোদচশমা, হনুমানের গদা, কাঠের গুলতি-- এমন আরও কত কী! আর হ্যাঁ, আর অবশ্যই নানা রকমের মুখোশ। জীবনে প্রথম মুখোশ দেখা এঁদেরই কাছে। তখন বুঝতাম না, কিন্তু এখন বুঝতে পারি ওই মুখোশগুলো ছিল কাগজের মণ্ড দিয়ে বানানো। কারণ উপরের দিকটা রংচঙ করে দিলেও ভিতরের দিকটায় নানা ধরনের খবরের কাগজের টুকরো চোখে পড়ত। আর দুপাশে ফুটো করে একটা ইলাস্টিকের দড়ি পরিয়ে দেওয়া থাকত। যা একটু টেনে মাথার উপর দিয়ে গলিয়ে নিতে হত। বলা বাহুল্য, বার চারেক এমন টানা-হেঁচড়ার পরে সেই ইলাস্টিক দড়ির একটি পাশ মুখোশের গা থেকে খুলে আসত। তখন আবার সেলোটেপ দিয়ে কায়দা করে সেটাকে জুড়ে দিত হত নির্দিষ্ট জায়গায়। এখন যে ছাঁচে-ঢালা পাতলা প্লাস্টিকের মুখোশ সব জায়গায় বিক্রি হতে দেখা যায়, তারা আগেকার ওই মুখোশগুলোর ধারে কাছেও দাঁড়াতে পারবে না।
মুখোশগুলো বেশির ভাগ হত বাঁদর, সিংহ, কঙ্কাল, রাক্ষস, চিতাবাঘ-- এই সবের। মুখোশের চোখের জায়গায় দুটো ফুটো করা থাকলেও তা দিয়ে বাইরেটা কখনওই ঠিকঠাক দেখা যেত না। আর বাড়ির বড়রা বলতেন, ওই ফুটো দিয়ে জোর করে দেখার চেষ্টা করলে নাকি ছোটদের চোখ ট্যারাও হয়ে যেতে পারে। তাই নতুন মুখোশের চোখের ফুটো দুটোকে তাঁরা পেন বা পেনসিল ঢুকিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আরও বড় করে দিতেন। তবু পুজোর সময় সেই মুখোশ কিনে দেওয়ার জন্যে অ্যায়সা ঝুলোঝুলি করতাম যে, না কিনে দিয়েও পারতেন না। ছোটবেলায় সেই মুখোশ পরে বাড়িতে ঢুকলে যিনি সামনে পড়তেন, তিনিই আঁতকে উঠে-- ‘আরিব্বাস! বাড়িতে একটা সিংহ ঢুকে পড়ল কোথা থেকে!!’ কিংবা ‘ওরে বাবা রে! একটা রাক্ষস ঢুকে পড়েছে রে আমাদের বাড়িতে!!’ -- বলে কপট ভয়ে শিউরে উঠতেন। আর আমি, হয় সিংহের মতো ‘হুমমম’ করে, আর তা নয়তো রাক্ষসের মতো দু’হাত উপরে তুলে, ‘হাঁউ মাউ খাউ!’ বলতে বলতে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতাম। তার পর বেশ কিছুক্ষণ এই মজাদার ব্যাপারটা চলত।
আরও পড়ুন: মা দুগ্গা আসবেন, তাই ঝেড়েপুঁছে সেজে উঠত ঘরদোর
মনে পড়ে, ছোটবেলায় ‘বাটা’ থেকে পুজোর জুতো কেনার সময়ে জুতোর সঙ্গে উপহার পাওয়া যেত দুটো রঙিন বেলুন আর একটা প্যাঁচা বা সিংহের মুখওয়ালা মোটা কাগজের মুখোশ। ইঁদুরের মুখওয়ালা একটা দারুণ মুখোশও ছিল, কিন্তু সেটা প্রায় কোনও দোকানেই পাওয়া যেত না। দোকানি দাদারা কোনও খুদের মুখে, ‘ইঁদুরের মুখোশটা কি আছে?’- এই প্রশ্ন শোনার পর তাকে যথাযথ উত্তর দিয়ে, তার পর তার সঙ্গে থাকা গুরুজনের কাছে জুতো-সংক্রান্ত তথ্যগুলি শুনতে একপ্রকার অভ্যস্তই হয়ে গিয়েছিলেন। মনে
আছে নতুনজ্যাঠা এক বার ওই ইঁদুরের মুখোশের খোঁজে আমায় নিয়ে এলগিন রোড অবধি তিনটি জুতোর দোকান ঘুরে এসেছিলেন।
পুজোর সময় মুখোশ কিনে দেওয়ার জন্যে অ্যায়সা ঝুলোঝুলি করতাম যে, না কিনে দিয়েও পারতেন না।
ছোটবেলায় আমি মুখোশ জমাতাম। বেশির ভাগ মুখোশের গায়েই কিছু দিন পরে কালো-কালো গুঁড়িগুঁড়ি এক ধরনের পোকা ধরে যেত। নইলে ইঁদুর বা আরশোলায় খেয়ে ফেলত মুখোশের উপরকার শক্ত কাগজ। আটা দিয়ে বানানো লেই দিয়েই মুখোশটা তৈরি হত বলেই বোধহয় ওদের ওই পরিণতি হত। বড় হয়ে বাংলার নানা জায়গার মুখোশের উপর আমার একটা টান জন্মে গিয়েছিল। পুরুলিয়ার ছো-এর মুখোশ, গম্ভীরার মুখানাচের মুখোশ, সুন্দরবনের মধু সংগ্রহকারীদের মাথার পিছন দিকে পরা মানুষের মুখের মুখোশ, মেদিনীপুরে কাগজ, কাপড় ও কাদামাটি শুকিয়ে তৈরি করা পশু-পাখি, ভূত-প্রেতের মুখোশ, যা বহুরূপী আর সঙের গানে ব্যবহার করা হত। কাঠের তৈরি মুখোশ পরে লোকউৎসবে অংশ নেওয়াও বাংলায় বিরল নয়। সরার ওপরে মুখ আঁকা ‘কাকতাড়ুয়া’ও তো এক ধরনের মুখোশই। আমি যে কোনও জায়গায় মুখোশ দেখতে পেলেই অবাক হয়ে দেখতাম। বিভিন্ন আত্মীয়বন্ধুর বাড়িতে যেখানে যখন কোনও দেশি-বিদেশি মুখোশ সাজানো থাকতে দেখেছি, মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকেছি। ছোটদের নিয়ে নাটক করতে গিয়ে রবারের তৈরি এক ধরনের মুখোশ জোগাড় করতে হয়েছে, যা মুখে পরে নিলে সত্যিকারের বলে মনে হয়। মনে আছে, পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘মৌচাক’ ছবিটিতে মুখোশ নিয়ে ভারি মজার একটি দৃশ্য ছিল-- যার রূপকার ছিলেন অভিনেতা রঞ্জিত মল্লিক এবং মিঠু মুখোপাধ্যায়। আগাগোড়া মুখোশকে থিম করে তৈরি হওয়া ‘মাস্ক’ ছায়াছবিতে জিম ক্যারির অভিনয় দেখে সত্যিই চমকে উঠেছি। একটা মুখোশ, যা মুখে পরলেই একটা মানুষ আমূল বদলে অন্য একটা মানুষ হয়ে যাচ্ছে। তার হাঁটা, চলা, কথা বলা সব কিছু বদলে যাচ্ছে। সে নিজেকে সেই মুখোশের আকর্ষণ থেকে কিছুতেই বের করে আনতে পারছে না-- এটা যে অভিনয় করে ফুটিয়ে তোলা কত শক্ত, তা এই ছবিটা না-দেখলে বিশ্বাসই হবে না। কতবার যে এ সিনেমাটা দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই।
আরও পড়ুন: পুজোর হাওয়া আর পোড়-খাওয়া চিরকুটের গল্প
কিন্তু স্বপ্নেও কোনও দিন ভাবিনি যে সেই ছোটবেলার আবদারের মুখোশ, আহ্লাদের মুখোশ, এক দিন কিছুটা চেহারা পাল্টে, আমাদের বাংলা তো বটেই, ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবীর মানুষের জীবনের সঙ্গে এমন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাবে। এমন দিনও আসবে, যখন মুখোশ না-পরা অবস্থায় কোনও দোকানে গেলে দোকানদার জিনিস দিতে অস্বীকার করবে। মুখোশ না-পরে রাস্তায় বেরোলে পুলিশ বেধড়ক ডান্ডাপেটা করবে, গাড়িতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে ভরে দেবে ফাটকে!
কার্টুন: দেবাশীষ দেব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy