Advertisement
E-Paper

ঘট আর ঘটার লড়াই দেখে মা মুচকি হাসলেন!

প্রবাসে ‘পুজো করিয়ে’ চুল পাকিয়ে ফেলা ঘোষালদা এ বার মিছিমিছি নিভৃতাবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

শুভঙ্কর মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২০ ০২:০০
Share
Save

ক্রমে পূজা আসিতেছে।

আর যতই সে কাছাকাছি আসছে, ‘হুম না হুম না’ আওয়াজ ততই জোরালো হচ্ছে। মা তো এ বার পাল্কি চেপে আসছেন। ছয় বেয়ারার কাঁধে ভর দিয়ে। করোনার করুণা রসটুকু না থাকলে, এ বছর নির্ঘাৎ কলকাতায় কোনও থিম পুজোর বিষয় হতো ‘পরিযায়ী শ্রমিক’! পাল্কিবাহকেরা শ্রমিক তো বটেই। তাঁদের যাতায়াতের রাস্তাটাও সন্দেহজনক। মা আসছেন কৈলাস থেকে। কাছেই চিন! ওই শ্রমিকভাইরা কি তবে ‘মেড ইন চায়না’?

এই চিনা-অচেনা যোগটার জন্যই নাকি এ বার মার্কিন মুলুকে পুজো আসি আসি করেও আসছে না! চিন শুনলেই তো এখন আমেরিকানদের গলায় চিনচিনে ব্যথা। একদম করোনা কেস! মাকেই না শেষ পর্যন্ত ডিপোর্টেড হতে হয়! এ সব আমাদের আটলান্টার ঘোষালদার ধারণা!

প্রবাসে ‘পুজো করিয়ে’ চুল পাকিয়ে ফেলা ঘোষালদা এ বার মিছিমিছি নিভৃতাবাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিকাগোর সান্যালদা আবার অন্য রকম। এই তো সে দিন সে ফোন করে তার শহরতুতো ভাই সুরজিৎকে বলল, ‘কী ভায়া, চার দিকে তো পুজো পুজো গন্ধ’! সুরজিৎ বার কয়েক প্রাণায়মের স্টাইলে নিশ্বাস নিয়ে সরল মনে বলল, ‘গন্ধ? কই না তো’! এমন আজব কথা শুনে, রীতিমতো হাতুড়ে ডাক্তারের মেজাজে সান্যালদা বললো, ‘শোনো, স্মেল গন। মানে, তুমি কোভিড পজিটিভ। সেলফোনটা মুখ থেকে ছয় ফিট দূরে ধরো’! তার মানে, করোনা ভাইরাস কি ফোনবাহিত! সুরজিৎ কোনও তর্কে না গিয়ে, ‘আমার হাত ছয় ফিট লম্বা নয় দাদা,’ বলে সে যাত্রা কোনও মতে রেহাই পেল।

আরও পড়ুন : সন্ধিকাল

ঘোষালদা জনে জনে ফোন করে বলছে, ‘দেবীর দোলায় আগমন।মড়ক মহামারী তো হবেই’!

টেক্সাসের তরফদারের আবার আঁতেল হিসেবে বেশ নামডাক। আমেরিকায় এসেও কাঁধে ঝোলাব্যাগ আর ফরাসি দাড়িটা ছাড়েনি। তো, সে দিন বাড়িতে বসে বোর হচ্ছিল সুমন। হঠাৎ তার খেয়াল হল, তরফদারকে একটু উস্কে দিতে পারলে হু হু করে সময় কেটে যাবে। ফোন করে সবে বলেছে যে, ‘দাদা, পুজো...’! তাকে থামিয়ে, দেবদুলালের গলায় তরফদার শুরু করল, ‘বুঝলে কি না, পুজোটা আসলে পুঁজির খেলা। মাকে শিখণ্ডী করে মার্কেটিং! তবে হ্যাঁ, এই নাগরিক কনসেপ্টটা থেকে বেরিয়ে এসে যদি তুমি গ্রামীণ জীবনের দিকে তাকাও, দেখবে পুজোটা আসলে একটা জীবিকা!’ শেষ দিকে তরফদারের গলা আবেগে বুজে এল। দুই চোখ ধ্যানমগ্ন। ফোনের ব্যাটারি ফুরিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সুমন একটু ঝাঁকালো, ‘তা হলে পুজো হবে কি হবে না!’ ওমা, এতে আরও ‘পাগলা সাঁকো নাড়াস নে’ অবস্থা! তরফদার বলল, ‘সব কিছুর তো এক কথায় উত্তর হয় না। এ বারের পুজোটা একটা এক্সপেরিমেন্ট। কী ভাবে সেটা হবে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিইনি এখনও!’ এটুকু বলে তরফদার একটু পজ নিয়েছে যেই, সুমন ‘বেশ, সিদ্ধান্ত নিলে জানিও।’ বলে ফোন কেটে দিল। তাতে একটুও দমে না গিয়ে, পুজো নিয়ে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় কি না দেখতে, তরফদার এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা খুলে বসল। সাধে কি আর শাস্ত্রে বলে, বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যু নেই!

তবে এই করোনাকালে পোয়া বারো পুরোহিতদের। মার্কিন মুলুকে তারা সবাই এখন ‘পুরোহিত দর্পণ’ বাগিয়ে বিকল্প পুজো পদ্ধতির ওপর নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা শুরু করেছে। কিন্তু তাদের মূল সমস্যাটা হল, উগ্র বামদের মতোই তাদেরও বহু দল ও উপদল। ওরা অবশ্য ‘দল’ বলে না, বলে, ‘জনরা’! কেউ ‘বেণীমাধব’, তো কেউ ‘মদন গুপ্ত’। কেউ ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’, তো কেউ ‘গুপ্ত প্রেস’! কেউ ‘বিকল্প পুজো’, তো কেউ ‘নির্বিকল্প পুজো’! বেণীরা বলছে, ‘যেমন বেণী তেমনি রবে’। মদন বলছে, ‘ওটা বেণী না, জটা’! গুপ্ত বলছে, ‘ওদের সব অশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’! বিশুদ্ধ বলছে, ‘ওরা হল লুপ্ত প্রেস’! সব মিলিয়ে বিতর্ক এমন পর্যায়ে যে, তার বিষয় আর ‘পুজো হবে কি হবে না’-তে আটকে নেই। বরং ডেমোক্র্যাট বনাম রিপাবলিকান বিতর্কে দাঁড়িয়ে গেছে।

এই সুযোগে বস্টনের রামকৃষ্ণদা আজন্ম নাস্তিক সনাতন মল্লিকের সাথে জোট বেঁধে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছে। প্রকৃত রামকৃষ্ণের স্টাইলেই বুকের কাছে ডান হাত ঘুরিয়ে সে বাণী দিয়েছে, ‘যত মত তত পথ’! কিন্তু বাঙালি তো আবার এত সহজে ছাড়বে না! সমবেত প্রশ্ন উঠেছে, ‘তাহলে খাড়াইলটা কী? পুজো হবে, না হবে না’? সনাতন সনাতনী কায়দায় জবাব দিয়েছে, ‘এই প্রশ্নের উত্তর দেবে ভাবিকাল’!

এ ভাবেই পুরোহিতদের হাত থেকে পুজো ফস্কে গেল। উত্থান হল আমলাতন্ত্রের। সবই করোনার কেরামতি। হাঁকে-ডাকে ডাকাবুকো অলীকবাবু নিজের পিঠ নিজে চাপড়ে বললেন, ‘পুজো হোগা’! বাঙালি সাধারণত রেগে গেলে ইংরেজি বলে, কিন্তু অলীকবাবু রেগে গেলে হিন্দি বলেন। তা বেশ, পুজো তো হবে। কিন্তু কী ভাবে হবে? ভার্চুয়াল, না রিয়েলিটি শো! বোঝো ঠ্যালা! ‘ভাগের মা’ যেমন, তেমনই কি ‘ভাগের পুজো’? সপ্তমী-অষ্টমী ভার্চুয়াল, নবমী দশমী রিয়েলিটি! আবার ‘আমরা ওরা’! ‘ওরা’ বলল, ‘ভার্চুয়াল আবার কী কথা, মানসপুজো বলতে হবে’। ‘আমরা’ বলল, ‘রিয়েলিটি নয়, রিলায়েবিলিটি বলতে হবে’! তর্কের মাঝপথে বাঙালির শাশ্বত ধারাকে অটুট রেখে প্রবাসীরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। মার্কিন বাঙালিদের এই দু’টি ‘সেকট’ এখন থেকে ‘ঘট’ ও ‘ঘটা’ বলে জনপ্রিয়তা পাবে।

আরও পড়ুন : পুজোর প্রাপ্তি ছিল ঠাকুরমার তৈরি পাউরুটির মিষ্টি আর নিমকি

ঘটরা হল ব্রাহ্ম গোছের, ঘটপুজোর পক্ষে। ঘটারা হল পৌত্তলিক, ঘটা করে পুজোর পক্ষে। ঘটরা ঘোরতর বাস্তববাদী। তাদের কথা হল, করোনার এত শত নিয়মকানুন মেনে চলতে হলে ঘটপুজো ছাড়া গতি নেই। পুরুতমশাই হাতে গোনা কয়েক জনকে নিয়ে ঘটপুজো করুক। ভার্চুয়াল পুজো ‘জুম’-এ সম্প্রচারিত হোক, লোকে বাড়িতে বসে দেখুক, অঞ্জলি দিক। ঘটারা বলছে, ওমা, প্রতিমা ছাড়া আবার পুজো হয় নাকি! ‘নিউ নরমাল’ বলে তো একটা কথা আছে! পুজোর সুযোগে করোনার সাথে কোলাকুলি হোক। মা হলেন সাক্ষাৎ ‘করোনা-নাশিনী’। এই করোনা ক্যাচালের মধ্যেই আবার ‘থার্ড থিয়েটার’-এর মতো একটা বিকল্প ধারা গজিয়ে উঠল। তাদের বক্তব্য- ঘট বা ঘটা, কোনওটাই ‘পুজো পারফেক্ট’ নয়। মাস্ক-স্যানিটাইজার দিয়ে কি আর পুজো হয়! তা ছাড়া পুজো কি শুধু প্রতিমা নাকি? পুজো মানে আড্ডা-খাওয়াদাওয়া-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সাজুগুজু করা মেয়েরা যদি মণ্ডপে না আসে, তা হলে তো পুজোর এস্থেটিকটাই ভোগে চলে যাবে! পুজো নিয়ে এই ত্রিমুখী লড়াই দেখে বাক্সবন্দিনী মা মুচকি হাসলেন! আরে বাপু, আমি কি আর মা মনসা, না তোরা চাঁদ সদাগর! পুজোর নামে ও সব পুতুলখেলায় আমি নেই। এ বার আমার ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং’!

পুজো মানে আড্ডা-খাওয়াদাওয়া-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

অবশেষে সিনে এল সুশীল সমাজ। তারা নিদান দিল, সভা হোক, ভোট হোক। ‘থার্ড থিয়েটার’ বেঁকে বসল। তাদের মতে, গণতন্ত্র তো প্রহসন। তা হোক, তবু সভা হল। হুজুগে আমজনতার ঝোঁক ঘটার দিকেই বেশি। ম্যাচ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে এক ঘটকর্তা ‘করোনা কৌশল’ নিল। সে প্রাণপণে কাশতে কাশতে বলল, ‘শরীরটা ভাল যাচ্ছে না’! সমবেত আর্তনাদ উঠলো, ‘করোনা পজিটিভ’। চোখের পলকে পুরো সভাটাই নিভৃতাবাস হয়ে গেল। ফাঁকা মাঠে গোল দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘটপুজো।

ঘোষালদা তবু মনমরা। সে জনে জনে ফোন করে বলছে, ‘দেবীর দোলায় আগমন। মড়ক মহামারী তো হবেই’! সান্যালদার সুর যথারীতি অন্য রকম। সে যাকে পাচ্ছে, তাকেই ডেকে বলছে, ‘মা তো এ বার হাতি মেরে সাথী! দেবীর গজগমন। সবুজ বিপ্লব একেবারে বাঁধা’! তাদের কথাবার্তার ধরনে সুমন-সুরজিৎরা হেসে কুটোপাটি। বেশি হাসলে আবার চোখে জল চলে আসে। কেন কে জানে, তরফদারের চোখেও জল। সতত তার মুখে একটা সবজান্তা হাসি ঝুলে থাকে। একদিন হঠাৎ তার মনে হল, যাই, এক বার স্টোরেজে গিয়ে মায়ের বাক্সটা দেখে আসি। সেখানে গিয়ে বাক্সটা স্পর্শ করা মাত্র হু হু করে কান্না পেল তরফদারের। ‘কে জানিত আসবে তুমি গো অনাহুতের মত’!

পরবাসে পুজো এ বার এমনই। চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমার মতো। ‘হাসি কান্না হীরাপান্না দোলে ভালে’।

Durga Puja 2020 Durga Puja Celebrations Durga Puja Nostalgia Subhankar Mukhopadhyay

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।