আমার শৈশবের পু়জো দেখার যে অভিজ্ঞতা তা একটু অন্য রকম। সে অনেক দিন আগেকার কথা তো। তখন বারোয়ারি পুজো এত হতও না। তখন বেশির ভাগ সময়েই বড় বড় মানুষ যার টাকাপয়সা আছে, যারা জমিদার তাদের বাড়িতে পুজো হত। এক-আধটা হয়তো বারোয়ারি ছিল তখনও, আমরা ঠিক বুঝতে পারতাম না। আর আমি তো মফসসলে মানুষ, জন্মাই ময়মনসিংহ শহরে। সেখানে চার-পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত আমি পুজো দেখেছি, তবে যে এক সন্ধ্যায় দুই-তিনটের বেশি পুজো দেখে উঠতে পারতাম না তার কারণ তখন তো এত গায়ে গায়ে পুজো হত না। এখানে একটা পুজো হল তো এক মাইল দেড় মাইল দূরে আবার একটা পুজো। এই ঘুরে ঘুরে এখানে সেখানে পুজো দেখতাম বটে, এক এক দিনে হয়তো দুটো-তিনটে-চারটে, ম্যাক্সিমাম দেখতে পারতাম। তারপরে ফিরে আসতে রাত হয়ে যেত।
তারপরে তো আমার বাবার বদলির চাকরি, রেলে চাকরি করতেন, সেই সূত্রে আমরা বাইরে বেরিয়ে গেলাম। আমি, বাবা, মা, আমার দিদি, তখন আমরা দুই ভাই-বোন ছিলাম, পরে এক ভাই এক বোন হয়। প্রথমে বোন তারপরে ছোট ভাই। তো সেটা অনেক দিন পরে। তখন আমরা মফসসল শহরে, অর্থাৎ রেলের যে সমস্ত ছোটখাটো টাউনশিপ ছিল সে সব জায়গায় পুজো হত ওই চাঁদা তুলে তুলে। বারোয়ারিও বলা যায়, আবার সকলের একটা সহযোগিতায় পুজোর আয়োজন। তবে সে সব পুজোয় এত জাঁকজমক ছিল না। আমি ছেলেবেলায় যত পুজো দেখেছি ইলেকট্রিসিটির অভাবে তখন হ্যাজাক জ্বালিয়ে ওই সব পুজোর মণ্ডপে আলোকসজ্জা হত। এত টুনি বাল্বের তখন কনসেপশনই ছিল না। ওই হ্যাজাকের আলোই তখন আমাদের সবচেয়ে বেশি আলো দিত।
আর ওই আমরা, আমার নিজেদের বাড়িতেও কয়েক বছর পুজো হয়েছে পার্টিশনের আগে, তিন-চার বছর পুজো হয়েছে। পার্টিশনের কারণে আমাদের সব দেশভাগ হয়ে গেল। দেশভাগের কারণে আমরা সব বিভিন্ন জায়গায় নিক্ষিপ্ত হয়ে গেলাম আর বাড়ির পুজোটাও বন্ধ হয়ে গেল। আর সেই পুজো ঘিরে আমাদের প্রচন্ড আনন্দ ছিল। ওইটুকু ছোট্ট একটা ঠাকুর আসত, তিন ফুট ম্যাক্সিমাম, তার বেশি নয়। সেই তিন ফুট উঁচু ঠাকুরকে নিয়েই আমাদের মাতামাতির অন্ত ছিল না। আর একটা মজার ব্যাপার ছিল যে বিজয়া দশমীর দিন বিসর্জনের পর এই মণ্ডপেই কিন্তু একটা গানের আসর বসত। আমার বাবা গান গাইতেন, জ্যাঠামশাই ক্ল্যারিওনেট বাজাতেন এবং শহরের যাঁরা ভাল ভাল গায়ক তাঁরা আসতেন। সেখানে খুব সুন্দর গানবাজনা হত। বেশির ভাগই রাগপ্রধান গান মানে রাগাশ্রয়ী বাংলা গান হত আরকি। তো এটা একটা অদ্ভুত আনন্দের ব্যাপার ছিল। শান্তি জল নেওয়া। তারপরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিজয়া দশমী করা। নাড়ু খাওয়া, তক্তি খাওয়া, এ সব ছিল। মোয়া-টোয়া এ সব।
তখনকার দিনে তো দোকান থেকে মিষ্টি কিনে কেউ খুব একটা খাওয়াতো না। বাড়ির তৈরি জিনিসই খাওয়াতো। তারপরে মফসসল শহরে যখন চলে গেলাম, মফসসল শহরে তখন রেলকলোনি, সেই রেলকলোনিতেও পুজো হত এবং সেখানেও একই ব্যাপার ছিল প্রায়। ওই পুজো ঘিরে আবালবৃদ্ধবনিতার উৎসাহ উদ্দীপনা, ওটা পারিবারিক পুজোর মতোই হয়ে যেত। তারপর বাড়ি বাড়ি ঘুরে সেই খাওয়ার দিকে খুব নজর ছিল, তখন খুব পেটুক ছিলাম। খেতে খুব ভালবাসতাম। এ বাড়ি-সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে খেতাম। আর তার পরে এটা হতে হতে তো নির্বাসনে যেতে হল কারণ আমাদের স্কুল-কলেজের অসুবিধা ছিল। আমাকে বোর্ডিং হাউজে পাঠানো হল কোচবিহারে।
আরও পড়ুন: অপরূপ সৌন্দর্য সে মেয়ের মুখে, শুধু ত্রিনয়নটাই নেই!
তারপরে কলকাতায় চলে এলাম। তখন আমার বয়স খুব বেশি না, তখন আমি সদ্য যুবা, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স তখন কলকাতায়। আসলে পুজোর বন্ধের সময় মায়ের কাছে চলে যেতাম। শিলিগুড়িতে তখন আমাদের বাড়ি হয়েছে। সেখানে আমরা স্থিত হয়েছি। মায়ের কাছে চলে যেতাম, মায়ের কাছেই থাকতে ভালবাসতাম। তবে এক-আধটা ছুটিতে হয়তো যাওয়া হয়নি বা হয়তো পুজোর শেষ দিকে গেছি। কলকাতার পুজো দেখেছি তখন। আর সব শহরেই একটা মজার ব্যাপার ছিল, দমকলের পুজো ছিল সবচেয়ে গরজিয়াস। অর্থাৎ বিশাল মূর্তি হত। দমকলের মূর্তি দ্যাখার জন্য বিশাল ভিড় হত। গোটা শহর ভেঙে পড়ত দমকলের প্রতিমা দেখার জন্য। দমকলের প্রতিমা বিশাল বড় ছিল। ওদের বৈশিষ্ট্য ছিল, যেখানেই ওরা পুজো করুক না কেন খুব বড় মূর্তি করত। তার সঙ্গে কেউ টক্কর দিতে পারত না।
তো কলকাতা শহরে আমরা সে রকম দমকলের পুজো দেখতাম বা নামকরা পুজো, যেমন আহিরীটোলা, সব নানা রকম পুজো দেখতাম। তবে একটা কথা বলতে পারি, সে আমলেও কলকাতার পুজোর জাঁকজমক ছিল বটে তবে এখনকার মতো থিম পুজোর আবির্ভাব ঘটেনি। আমার থিমের পুজো ভালই লাগে। এখনকার দুর্গাপুজোর সঙ্গে তো মূর্তির কোনও যোগাযোগ নেই, দুর্গাপুজোর মানেই তামাশা আর কি। লোকে পুজো দেখতে বেরয়, আলো দেখতে বেরয়, ব্যাপারটা তা-ই হয়ে গেছে। এখন মা দুগ্গা বলে যে একটা ভক্তি ভাব সেটা খুব কম লোকের মধ্যেই আছে। তো এই থিম পুজো আমার খুব পছন্দের। আর সেটা তখনও আসেনি। যখন কলকাতায় ঠাকুর দেখতে আসতাম তখনও আসেনি। পরবর্তীকালে, যখন এত ভিড় কলকাতায় বাড়তে লাগল আমি পুজো দেখা বন্ধ করে দিলাম। আর পুজো দেখতে যেতাম না।
আরও পড়ুন: ঠাকুর গড়া দেখতাম, দেখতাম সদ্য শাড়ি পরা কিশোরীটিকেও: জয় গোস্বামী
ছোট ছেলেমেয়ে দু’জনকে নিয়ে মাঝে মাঝে আশপাশের ঠাকুর দেখিয়ে আনতাম। তবে ভিড়ে ওদের নিয়ে যেতাম না, কারণ কোথায় কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে, ভিড়ের চাপে হয়তো কেঁদে ফেলবে। তাই নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে পুজো দেখিয়ে আনতাম। দু’টো কি চারটে ঠাকুর দেখত। ব্যাস, ওরাও ওতে খুশি। তারও পরে যখন আমি দেখলাম, পুজোর চার দিন বেরনো যায় না তখন আমি নিজেদের রাস্তাতেই, যেটা সাধারণত খুব জনবিরল থাকে, সেখানে পুজোর সময় দমবন্ধ হয়ে আসছে। আমি ভিড় খুব ভয় পাই। সে জন্য আমি পুজো দেখতে যাওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বছর দশ-বারো আমি কোনও পুজো-টুজো দেখতে যেতাম না। আমার ছেলেমেয়ে অবশ্য যেত, এ দিক-সে দিক বড় হওয়ার পর। তারপর বিচারক হয়ে যখন আমি যেতে শুরু করলাম বিভিন্ন পুজোতে, দেখলাম যে হ্যাঁ, কলকাতার পুজোর এক বিশাল বিবর্তন হয়ে গেছে। আগের মতো ওই গন্ডগোল, বিশৃঙ্খলা অনেকটা কমেছে। ভিড় বেড়েছে, তবে শৃঙ্খলা খনিকটা রক্ষা করেন ওখানকার কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: মায়ের কোলে শুয়ে মহালয়া শুনতে শুনতে ঘুম নামে চোখে: তিলোত্তমা
আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে থিম পুজো। নতুন ভাবনাচিন্তা, নানা রকম শিল্পী, নানা রকম স়ৃষ্টি, মানে সৃজনমুখী কাজ, নানা রকম আইডিয়ার রূপায়ণ আমার তো খুবই ভাল লাগে। আমি থিম পুজোর খুবই ভক্ত। কেননা বিভিন্ন জায়গায় দেবীকে নিয়ে নানা রকম ভাবনাচিন্তা করা হয়। কয়েক জন শিল্পী আছেন, যেমন ভবতোষ সুতার, তার পরে আমাদের সনাতন দিন্দা, এখন তো আরও অনেক শিল্পীর আবির্ভাব হয়েছে। খুব সুন্দর ভাবে তাঁরা মণ্ডপ সাজান এবং মূর্তি তৈরি করেন। এগুলো দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি এবং মনে হয়েছে যে এই মূর্তিগুলো বিসর্জন না দিয়ে সংরক্ষণ করা দরকার। কেননা ভবিষ্যতে মানুষ দেখবে যে এত ভাল শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়েছিল। সব সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়, যদিও একটা চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা কতটা ফলপ্রসূ হয়েছে তা জানি না।
তবে পুজো সম্পর্কে আমার একটা ছেলেবেলার নস্টালজিয়া আছে। খুব মধুর তা বলব না। কারণ তার সঙ্গে অনেক অম্লমধুর ঘটনা মিশে আছে। ছোট ছিলাম তো, কাজেই তেমন কেউ পাত্তা দিত না। তারপরে বড় হওয়ার পর অবস্থা এখন, পুজো দেখতে এমনি যাই না, বিচারক হয়ে যদি ব্যবস্থা হয় তবে যাই। নয়তো ওই কটা দিন বাড়িতেই থাকি। মানুষ যে সারা রাত জেগে ঠাকুর দেখছে, আনন্দ করছে, উন্মাদনা বেড়েছে, চার দিনের পুজো সাত দিনে গড়িয়েছে। কারণ এখন অনেক আগে থেকে পুজো শুরু হয়ে যায়। এখন তো চতুর্থী পঞ্চমী থেকেই, এ বছর তো মহালয়া থেকেই শুরু হয়ে গেছে। যাই হোক, পুজোয় মানুষ আনন্দ করুক এটাই চাই। কোনও দুর্ঘটনা না ঘটে। মানুষ নিরাপদে ঘরে ফিরে আসুক পুজো দেখার পর। আনন্দ করুক। তবে আনন্দ যেন কোনওক্রমে নিরানন্দে পরিণত না হয়। কেননা পুজোয় যা ভিড় হয় কলকাতায়, এই ভিড়ে অনেক কিছু ঘটতে পারে। অঘটন কিছু না যাতে ঘটে সেটাই আমার প্রার্থনা থাকবে।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy