প্রাণ ঢেলে লেখা গান, মঞ্চ কাঁপিয়ে গিটারের সুরে বাঁধা গান কিংবা শ্রোতাদের চোখের কোণে বাষ্পের আনাগোনায় মোড়া গান। এক দিকে বাংলা ভাষায় র্যাপ আর কাওয়ালি, সঙ্গত দিচ্ছে পশ্চিমি ধাঁচের পপ কিংবা জ্যাজ, অন্য দিকে বিদ্রোহী সুর— প্রাক্ পুজো শহর কলকাতা এক অভূতপুর্ব সন্ধ্যাকে সামনে থেকে দেখতে পেল। নব্বইয়ের দশক থেকে কলকাতার গানের জগতে একচ্ছত্র রাজত্ব ছিল যে তিন মুর্তির সেই নচিকেতা, শিলাজিৎ ও অঞ্জন দত্ত এক সঙ্গে, এক ছাদের তলায়!
২ সেপ্টেম্বরের কলকাতার সন্ধ্যেটা একটু অন্য রকম ছিল। গানের বৃত্তে যে কোনও বিবাদ নেই, কোনও দূরত্ব নেই তা আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল 'ত্রিমূর্তি চ্যাপ্টার ১'। ছক ভাঙা গানের সুবাদে এক ডাকে এঁদের চেনে বাংলার শিল্পী মহল, তাঁদের হাত ধরেই বাংলা পেয়েছিল ‘জীবনমুখী বাংলা গান’, ‘ভূমিকা’ এবং ‘শুনতে কি চাও?’ এ সবের মতো তাক লাগানো সব গানের সংকলন। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন একচেটিয়া হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কী কিশোর কুমারের মতো কিংবদন্তিদের ভিড়, তখনই তাঁদের টেক্কা দিয়ে পশ্চিমের বব ডিলান বা এলভিস প্রেসলিদের গানের ধারাকে বাংলা গানের সুরে মিলিয়েছিলেন অঞ্জন দত্ত। এই কয়েক দিন আগেই পেরিয়ে গিয়েছে নচিকেতার ষাটতম জন্মদিন, তার জের টেনেই যখন মঞ্চে কাটা হল কেক, অঞ্জন দত্ত গাইলেন ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’!
তিনজন হাসি ঠাট্টায় মেতে গাইলেন একের পর এক নব্বইয়ের দশকের শ্রোতাদের মধ্যে বিপ্লব ঘটানো সব গান। একজন আরেকজনের গান গাইলেন, কেউ বা অন্য একজনকে অনুরোধ করলেন বিশেষ কোনও গান গাইতে।
অঞ্জন দত্তের ‘বেলা বোস’, নচিকেতার ‘নীলাঞ্জনা’— প্রেমের গান থেকে দিন ভালর গান, সবই ছিল তাঁদের ঝুলিতে। মঞ্চে শিলাজিৎ সব সময়ই দাপুটে, তবে নজর কাড়ল তিন জনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ অঞ্জন দত্তের মনের জোরে এবং খোলা গানের গলায়!
একটা সময় সংবাদমাধ্যমের পাতা জুড়ে খবর হয়েছিল শিলাজিৎ এবং নচিকেতার মধ্যে বিবাদ নিয়ে। সেই কবেকার কথা সব, নব্বইয়ের দশকের শুরু দিকে। কত যুগ পরে আজ সে সব দূরে সরিয়ে দু’জন আজ একসঙ্গে, এক মঞ্চে, আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্কে সুদিন এনেছে গানের ছন্দে বাঁধা সাম্য।
কলকাতা শহরের যত শ্রোতা এবং দর্শক এই দিন দেখার জন্য মুখিয়ে ছিলেন, তাঁদের ভিড় সাগরের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল নজরুল মঞ্চের চার দেওয়ালে। সঙ্গে করে তাঁরা নিয়ে ফিরেছেন আরও তাজা হয়ে বেঁচে থাকার রসদ।
শিল্পীদের অবাক করে দিয়ে কলকাতার মানুষ দেখিয়ে দিয়েছেন যে শহরের যান্ত্রিক জীবন আজও শিল্পীদের কদর বোঝে, যেমন পশ্চিমি সঙ্গীতের জগতে আজও পপ, জ্যাজ গানের উচ্ছ্বাস বজায় আছে, তেমনই আপামর বাঙালির মন জুড়ে এখনও বাস করে ‘লালমাটির সরানে’, ‘মাঝি রে’ এবং ‘যা পাখি সর্বনাশ’। উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম কিঞ্জল জানিয়েছেন যে তাঁরা ভবিষ্যতে এই রকম আরও অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চান।
সন্ধ্যার ইতি টানতে মন চায় না শিল্পীদের, শ্রোতারাও নাছোড়বান্দা, তাঁরা এই হাসি-কান্না ভেজা সন্ধ্যার আবেশ কাটিয়ে উঠতে নারাজ। তা’ও সময় তো সীমিত। শেষে কোথাও যেন ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি রয়েই গেল নচিকেতার ‘তুমি আসবে বলে তাই’। সময় থেমে গেল গানের কলিতে, গানের ঘোরে কাটল এই অনবদ্য সন্ধ্যা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy