সুলতানি আমলে বাংলায় মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠান এবং পুজোপার্বণের ছবি ছিল আজকের তুলনায় অনেকটাই আলাদা।কেউ পাকা ইটের বাড়ি বা দালান-বাড়ি তৈরি করলেও নবাবের দফতর থেকে লিখিত অনুমতি আদায় করতে হত। সে সময় এমনটাই ছিল নিয়ম। পরে অবশ্য ইংরেজ শাসনকালে এই নিয়মের পরিবর্তন ঘটে।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে প্রাচীন হাওড়ার বর্ধিষ্ণু জনপদ আমতার নারিট গ্রামে এক ধর্মপ্রাণ নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস ছিল।কিছুটা আর্থিক সঙ্গতি থাকায় পরিবারের কয়েকজন স্থির করলেন দুর্গাদালান গড়েবাড়িতে দুর্গোৎসবের প্রচলন করবেন।সে যুগে বাড়িতে দুর্গোৎসবের আয়োজন করা আজকের তুলনায় ছিল অনেকটাই কষ্টসাধ্য। আমতার নারিট গ্রামের ভট্টাচার্য পরিবারের কয়েকজন সদস্য নবাবের দফতর থেকে পাকা দালান তৈরির অনুমতি আদায়ের জন্য মুর্শিদাবাদে পৌঁছলেন।বাংলার মসনদে তখন প্রজাবৎসল নবাব আলিবর্দি খান।তাঁর দফতরের কর্মীদের আতিথিয়তায়মুগ্ধ হলেন ব্রাহ্মণরা।
ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ, তাঁরা যে স্বপাক রান্না ছাড়া কিছুই মুখে কিছুই তুলবেন না, সে কথা নবাবের কর্মচারীরা জানতেন।তাই বাসনপত্র এবং আনাজ কেনার জন্য প্রথমে তাঁদের একটি করে মোহর দেওয়া হয়েছিল। শোনা যায় তাঁরা মোট তিনদিন ছিলেন সেখানে। তার পরে লিখিত অনুমতি নিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন।এর পরে ঠাকুরদালান তৈরি করে শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো- অতীতচারণ করছিলেন নারিট ছোটবাড়ির প্রবীণ সদস্য শিশির ভট্টাচার্য।
ঠাকুর দালানের নকশায় দেখা যায় বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের ছাপ।
এই পরিবারের পূর্ব পুরুষরা কণৌজ থেকে বীরভূমে এসে বসবাস শুরু করেন। তাঁরা ছিলেন কণৌজের উপাধ্যায়। বীরভূমের বন্দ্য গ্রামে বসবাস করায় লোকমুখে তাঁরা ‘বন্দ্যের উপাধ্যায়’নামে পরিচিত হন।সেই থেকে বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যায় এই পরিবারের পদবি। পরবর্তী কালে তাঁরা ভট্টাচার্য উপাধি লাভ করেন।পরে শিয়াখালায় বসতি স্থাপন করে এই পরিবার। বর্ধমানের মহারাজা পঞ্চানন বিগ্রহ-সহ নারিটে তাঁদের জমিদারি দেন।
আরও পড়ুন: সখীবেশে রানি রাসমণির পুজোয় আরাধনা করেন শ্রীরামকৃষ্ণ
বেশ কিছুকাল পরে পুজোটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়- বড়বাড়ি ও ছোটবাড়ি। দু’টি শাখারই প্রাচীন ঠাকুরদালান আজও বর্তমান। যা ছোট ছোট টালির মতো ইটের তৈরি। দালানের নির্মাণশৈলীতে রয়েছে বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের ছাপ, যা কলকাতা ও শহরতলির বেশ কিছু পুরনো ঠাকুর দালানের চেয়ে আলাদা।
দেবীর বাহন এখানে পৌরাণিক নরসিংহ।
নারিট ছোটবাড়ির প্রতিমাটি সাবেক বাংলা রীতির।দেবীকে পরানো হয় শোলার ডাকেরসাজ।প্রতিমার বিশেষত্ব কার্তিক-গণেশেরস্থান পরিবর্তন- কার্তিক থাকেন ডানদিকে এবং গণেশ বাঁদিকে।নবপত্রিকা কার্তিকের পাশেই স্থাপন করা হয়। দেবীর বাহন এখানে পৌরাণিক নরসিংহ। আগে পশুবলির প্রথা থাকলেও বর্তমানে ফলবলি দেওয়া হয়।বড়বাড়ির পুজোয় অবশ্য এখনও পশু বলিই চালু রয়েছে। পুজোয় প্রতিদিন অন্নভোগ হয়। থাকে ভাত, খিচুড়ি-সহ পঞ্চব্যাঞ্জন, পায়েস, চাটনি। রাতের শীতল ভোগে থাকে লুচি, হালুয়া, নারকেল সন্দেশ।পুজো হয় বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে।
আরও পড়ুন: বিজয়িনীর হাসি আর আয়ত চোখের স্নিগ্ধতায় অনন্যা মাতৃমূর্তি
এই পরিবারের অন্যতম কৃতীপুরুষ মহেশচন্দ্রন্যায়রত্ন। তাঁরই পুত্র মন্মথনাথ ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতের প্রথম অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেল। তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের বাল্যবন্ধুও।পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে,তাঁরই মেয়েকে প্রথম কুমারীপুজো করেন স্বামী বিবেকানন্দ।১৮৭৭ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অবসর গ্রহণ করার পরে কলেজের অধ্যক্ষ হন মহেশচন্দ্র। মহেশ ন্যায়রত্ন ছাড়াও এই পরিবারের অন্যান্য কৃতীদের মধ্যে ছিলেন হরিনারায়ণ তর্কসিদ্ধান্ত এবং রাজনারায়ণ সিদ্ধান্তবাগীশ।
ছবি পরিবার সূত্রে পাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy