শরতের বেলা পড়ে আসছে। শেষ বিকেলের মেঘ নীল-সাদা আঁকিবুঁকি কাটছে আকাশে। এখনই ডুব দেবে দিগন্তে। গঙ্গার পাড় ধরে এগিয়ে আসছে মাঝারি মাপের একটা জাহাজ। ইংল্যান্ড থেকে দুই-চার জন সাহেবের একটা দল এই জাহাজেই আসার কথা। তাঁদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা লোকজন নেমে এসেছেন ঘাটের কাছে। এঁরা সবাই রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লোক। আগে রামচন্দ্রবাবু নিজেই আসতেন এ সব কাজে। কিন্তু এখন তিনি কলকাতার অন্যতম বড় বেনিয়া। কিছু লোক তাঁর হয়ে এই কাজগুলি করে দেয়। যে ইংরেজ কোম্পানিতে রামচন্দ্র কাজ করেন, দুই সাহেব সেখানকারই বড়কর্তা হয়ে আসছেন। এদেশে ‘জেন্টু’-দের দুর্গাপুজো নাকি দেখার মতো উৎসব। এ বছর তাঁর বাসভবনের পুজো দেখতে আসবেন বাবুরা। এ বড় কম সম্মান নয়।
অথচ রামচন্দ্রের উত্থান কিন্তু খুব মসৃণ ছিল না। অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে কাঁকনাড়ার কেউটে নারায়ণপুরে জন্ম তাঁর। জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই রামচন্দ্রের পরিবার চলে আসেন চোরবাগানে, তাঁর মামার বাড়িতে। নিতান্তই অল্প বয়সে নর্মান ব্রাদার্সের অফিসে চিনি ও সোরা ওজনের কাজে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকে স্কিলিজি বলে আরও একটি সংস্থায় সামান্য বেশি মাইনেতে শুরু করেন খরিদ বিক্রির কাজ। এখান থেকেই আস্তে আস্তে অর্থ উপার্জনের পথ সুগম হয় তাঁর। পরপর আরও দু’টি কোম্পানিতে চাকরি শুরু করেন তিনি। ঘটনাচক্রে তাঁর উত্থানের সময়েই চলছিল বেনিয়াদের সামগ্রিক পতনের পালা। তখন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা চালু হচ্ছে আস্তে আস্তে। এ দেশে আরও জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজরা। প্রয়োজন কমে যাচ্ছে বেনিয়াদের। কিন্তু সেই পাল্টে যাওয়া সময়কেও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের কাজে লাগিয়ে অর্থোপার্জন করেছেন রামচন্দ্র। তত দিনে চোরবাগানে মামাবাড়ির পাশে ১২ বিঘা জমির উপরে প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছেন তিনি। বাড়ির কাজ যখন শেষের দিকে, তখন জিলেস্টো অ্যান্ড অ্যান্ডারসন কোম্পানির বড় বাবুকে নিয়ে একদিন গিয়েছেন শ্যামবাজারের কীর্তি মিত্রের বাড়িতে পুজো দেখতে। সে বড় জমজমাট পুজো। বাড়ির উঠোনে তখন বসেছে বিরাট আসর। চলছে কবির লড়াই। ঠাকুরদালান আলো করে আছেন মা দুর্গা। দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন সাহেব। আর রামচন্দ্র হলেন খানিকটা ঈর্ষান্বিত, মনমরাও। তাঁর অবস্থা কোনও অংশে খারাপ নয়, তবে তাঁর বাড়ি কেন এমন দিনে অন্ধকার ? আর তা ছাড়া দুর্গাপুজো মানে তো শুধুই দেবী আরাধনা নয়। সামাজিক সম্মান, প্রতিপত্তি মাপার নিক্তিও বটে। পুজো শুরু করলে দশের কাছে গ্রহণযোগ্যতা যে বাড়বে, সে বিষয়ে তো সন্দেহ নেই। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়েই বোধহয় ঠিক এই চিন্তার প্রতিধ্বনি করলেন অ্যান্ডারসন। রামচন্দ্রকে নিজের বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করতে অনুরোধ করলেন তিনি। রামচন্দ্র সেই দিন প্রতিমার সামনে দাঁড়িয়ে স্থির করলেন পরের বছর থেকে তিনিও দেবীকে নিয়ে আসবেন নিজের বাসভবনে। পরের বছর শরতে রামচন্দ্রভবন ঝলমলিয়ে উঠল দেবী দুর্গার প্রভায়। একচালার প্রতিমার টানা জ্যোতির্ময়ী চোখ। দেবীর অঙ্গে ডাকের সাজ শোভা পেল। তাঁর বর্ণ হল অতসী ফুলের মতো। এই পরিবারে মহিষাসুরের একটি রুপোর কোমরবন্ধ আছে। তার উপরে লেখা দেখে অনুমান করা হয় ১৮৬০ সালে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল।
রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর দিন কাঠামো পুজো হয়। আগে ঠাকুর তৈরি হত বাড়িতেই। এখন কুমোরটুলি থেকে প্রতিমা আসে। আগে প্রতিমা ছিল ডাকের সাজের। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের সময় বিলিতি জিনিস বর্জনের ঢেউ উঠল যখন, তখন ডাকের সাজ ছাড়েন বাড়ির স্বদেশী মনোভাবাপন্ন সদস্যরা। দেবীকে সাজানো হয় বেনারসীতে। সেই সঙ্গে তাঁকে দেওয়া হয় রুপোর অস্ত্র আর সোনার গয়না। ষষ্ঠীর দিন হয় দেবীর বেলবরণ। পুরনো নিয়ম মতোই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ রেখে বাড়ির মহিলারা অলঙ্কার আর বেনারসী শাড়ি পরে দেবীকে বরণ করেন। দেবী বরণের এই প্রথম পর্বে ঢাকিদেরও বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ থাকে। বেলবরণের পরে তাঁরা বাড়িতে ঢুকতে পারেন। এই সময়টায় তাই ঢাক বাজান বাড়ির পুরুষরা। রামচন্দ্রনিবাসে দেবীর ভোগও রান্না করেন বাড়ির ছেলেরা। পুজোর যাবতীয় কাজও করেন তাঁরা। মেয়েদের কাজ আলাদা। তাঁরা অষ্টমীতে প্রদীপ সাজান। পদ্মফুল ফোটানো, দুর্বা বাছা এগুলিও তাঁদের কাজ। সপ্তমী থেকে নবমী খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, ভাত, ডাল, শুক্তো, শাকের ঘণ্ট আর আলু-পটলের তরকারি দেওয়া হয়। এ ছাড়াও দেবীকে দেওয়া হয় নানা রকমের মাছ- সপ্তমীতে পোনামাছের ঝোল, লাউ-চিংড়ি, অষ্টমীতে পোনামাছ, নবমীতে ভেটকিমাছের ঘণ্ট, চিংড়ি মাছের মালাইকারি দেওয়া হয়। আগে এই বাড়িতে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী তিন দিন তিনটি পাঁঠা বলি হত। এখন পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তার বদলে আখ, কুমড়ো বলি দেওয়া হয়। দশমীর দিন অরন্ধন পালন হয় পরিবারে। নবমীর দিন রাতে দেবীর জন্য রান্না করে রাখা হয় পান্তাভাত, মুসুর ডাল, চালতার অম্বল, ইলিশ মাছ ভাজা, ইলিশ মাছের অম্বল। পরদিন এ সবই ভোগ দেওয়া হয়। বিসর্জনের দিন বরণের পর দেবীকে পরের বছর আবার আসতে বলেন বাড়ির সদস্যরা। "ভজিতে তোমারে শিখি নাই কভু, ডাকি শুধু তোমায় মা বলে"- বিসর্জনের ঠিক আগে দেবীকে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতি বছর বাড়ির সদস্যরা এই গানটির মাধ্যমে প্রণাম জানান দুর্গাকে। আগামী বছর দেবীর আগমনের প্রতীক্ষায় নিস্তব্ধ পড়ে থাকা শূন্য ঠাকুরদালানের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় সেই সুর।
চলতি বছরে করোনা পরিস্থিতির কারণে এ বাড়িতে ঠাকুর দেখতে আসতে পারবেন না দর্শনার্থীরা। এই প্রথম এই বাড়ির দরজা বন্ধ থাকছে তাঁদের জন্য। বাড়ির সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে পুজো।
আরও পড়ুন: মা লক্ষ্মী ঘরের মেয়ে, তাই বিদায় দেয় না বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার
ছবি সৌজন্যে - অমিতাভ গুপ্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy