Advertisement
E-Paper

মা লক্ষ্মী ঘরের মেয়ে, তাই বিদায় দেয় না বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার

বেশ কয়েক ক্রোশ পাড়ি দিয়ে এক পল্লিগ্রামে এসে আশ্রয় পেলেন জগদীশ। অতীতের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সেই গ্রামই আজকের হাওড়ার মাকড়দহ।

অর্পিতা রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২০ ১৪:১৬
Share
Save

মুঘল সাম্রাজ্য তখন ক্ষয়িষ্ণু। ব্রিটিশ শাসন জাঁকিয়ে বসতে দেরি আছে আরও বেশ কিছু বছর। দেশের শাসনব্যবস্থা তখনও সুসংবদ্ধ নয়। বর্গিবাহিনী নিয়ে পূর্ব ভারতে মাঝে মাঝেই হানা দিচ্ছেন মরাঠা দস্যু ভাস্কর পণ্ডিত। গোবিন্দপুর-সুতানটি-কলকাতাকে ঘিরে মরাঠা খাল কাটা হচ্ছে যে বছর, সেই ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে নিজের ভিটেমাটি ছাড়লেন জগদীশ বাচস্পতি। তখন কলকাতার তুলনায় হুগলি অনেক বেশি সমৃদ্ধ। সেই হুগলির চাঁপাডাঙার কাছে বাগাণ্ডা গ্রামে ছিল তাঁর বসতবাড়ি। বর্গি হামলার জের পৌঁছেছিল সেখানেও। বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়লেন জগদীশ। সঙ্গে স্ত্রী, সন্তানসন্ততি এবং অতি যত্নে রাখা শালগ্রাম শিলা।

বেশ কয়েক ক্রোশ পাড়ি দিয়ে এক পল্লিগ্রামে এসে আশ্রয় পেলেন জগদীশ। অতীতের ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় সেই গ্রামই আজকের হাওড়ার মাকড়দহ। মাকড়চণ্ডীর সুপ্রাচীন মন্দির এবং ‘দহ’ অর্থাৎ বড় জলাশয় থেকেই এই নামকরণ। ব্রাহ্মণহীন সেই জনপদে সাদরে স্বাগত জানানো হল বাচস্পতি ও তাঁর পরিবারকে। ‘বাচস্পতি’ উপাধির আড়ালে তাঁদের পারিবারিক পরিচয় ছিল ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে আদিশূরের আমন্ত্রণে উত্তরপ্রদেশের কনৌজ থেকে যে কয়েকটি কুলীন ব্রাহ্মণ পরিবার বাংলায় এসেছিল, তাঁদের মধ্যে তাঁরা অন্যতম।

দুর্গাপুজো মানেই মিলনোৎসব।

প্রাচীন এই পরিবারের কৃতীদের মধ্যে অন্যতম হলেন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়গোপাল বন্দ্যোপাধ্য়ায়, শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্য়ায় । বংশের ঐতিহ্য ও গৌরবের ধারক ও বাহক হয়ে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার বিস্তৃত মাকড়দহ জুড়ে। জগদীশ বাচস্পতি তাঁদের শালগ্রাম শিলা দিয়ে গিয়েছিলেন প্রপৌত্র রামকানাইকে। তাঁর উত্তরসূরীরাই এখনও নারায়ণজ্ঞানে সেবা করে চলেছেন শালগ্রাম শিলার। তাঁদের কাছে এই শিলা ‘অনন্তদেব’। তাঁর নিত্যপুজো বড় বাড়িতে হলেও পারিবারিক যে কোনও শুভকাজে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শরিকদের বাড়িতে।

আরও পড়ুন: গৌরবময় অতীত ফিরে আসে ভাটপাড়ার রাখালদাস ন্যায়রত্নের পুজোয়

পারিবারিক দুর্গোৎসবের অন্যতম অংশ অনন্তদেব। জগদীশ বাচস্পতির বন্দ্যোপাধ্যায় বংশ এবং দৌহিত্র বংশের শাখা-প্রশাথা মিলিয়ে আজ দুর্গাপুজোর সংখ্যা তিনটি। মূল পুজো এখন পরিচিত ‘বড় বাড়ির পুজো’ বলে। পাশাপাশি আছে মেজো বাড়ি এবং ছোট বাড়ির পুজো। প্রতি বছর মেজো বাড়ি থেকে পুজোর ‘শ্রী’ এসে পৌঁছয় বড় বাড়িতে। বাড়ির মেয়ে-বৌরা দলবেঁধে যান ‘শ্রী’ আনতে। এ বার মহাষষ্ঠীর বিকেলে ‘শ্রী’ আনতে যাবেন মাত্র পাঁচ জন মহিলা। অতিমারিতে রাশ পড়েছে আরও অনেক নিয়মে।

প্রতি বছর অষ্টমীতে ধুনোপোড়ানো এই বাড়ির ঐতিহ্যবাহী রীতি। বাড়ির গৃহিণীরা মাথায় জ্বলন্ত মালসা নিয়ে পুজোয় বসেন। এ বছরের জন্য বন্ধ রাখা হচ্ছে এই রীতি। হচ্ছে না কুমারীপুজো, পারিবারিক পুকুর থেকে দণ্ডি কাটা এবং দরিদ্রনারায়ণসেবাও- জানালেন পরিবারের সদস্য সোমেন বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি সব রীতিও পালন করা হবে করোনা-সংক্রান্ত সব বিধি মেনেই। পুজো করবেন বাড়িরই দুই সদস্য। তাঁদের মুখেও থাকবে মাস্ক। কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন এই পরিবারের পুজোর বিশেষ অঙ্গ নৈবেদ্য এবং ভোগের বিশেষত্ব। নবমী তিথিতে উৎসর্গ করা হয় ৫২ রকম ভোগ। মৌরি, সুপুরি, এলাচ, দারচিনি, জয়িত্রী দেওয়া পানপাতা গ্রহণ করা হয় ‘সন্ধিপুজোর মহাপ্রসাদ’ হিসেবে। পাঁঠাবলি বন্ধ হয়ে গেলেও মা দুর্গার অন্নভোগে থাকে মাছ।

প্রতি বছর অষ্টমীতে ধুনোপোড়ানো এই বাড়ির ঐতিহ্যবাহী রীতি।

বিশেষত্ব আছে বিজয়া দশমীর বরণেও। মা দুর্গা এবং তাঁর তিন সন্তানকে সবাহন, এমনকি অসুরকেও বরণ করে বিদায় জানানো হয় প্রথা মেনে। কিন্তু বরণ করা হয় না দেবী লক্ষ্মীকে। কারণ তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’ পরিবারের মেয়ে। মেয়েকে বরণ করে বিদায় জানানো হয় না। মা দুর্গা তাঁর অন্য সন্তানদের নিয়ে কৈলাসযাত্রা করলেও নারায়ণদেবকে নিয়ে এ বাড়িতে যেন চিরতরে রয়ে যান মা লক্ষ্মী। সেই ভাবনা থেকেই এই রীতির সূত্রপাত। বরণের পাশাপাশি রয়েছে সিঁদুরখেলার প্রথাও। তবে এ বাড়িতে দশমীর সঙ্গে সিঁদুরখেলা হয় অষ্টমী তিথিতেও।

আরও পড়ুন: বাঘের উপদ্রব আজ অতীত, আন্দুল রায়বাড়িতে এখনও দশমীতে পূজিত হন দক্ষিণরায়

বরণের পরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তাঁদেরই পারিবারিক পুকুরে। বিসর্জনের পরের দিন অপেক্ষা করে থাকে আর এক রীতি। একাদশীতে পরিবারের তরফে পুজো দেওয়া হয় মাকড়চণ্ডী মন্দিরে। প্রথমে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। তার পর পুজো দেন অন্যান্য দুর্গাপুজোর আয়োজকরা। পারিবারিক বা বারোয়ারি, যে কোনও দুর্গাপুজোর আয়োজকরাই ভাল ভাবে শারদোৎসব মিটে গেলে পুজো দেন মা মাকড়চণ্ডীর কাছে।

বরণের পরে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় তাঁদেরই পারিবারিক পুকুরে।

দুর্গাপুজো মানেই মিলনোৎসব। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সদস্যরা অংশ নেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গাৎসবে। শাখাপ্রশাখা বিস্তৃত হলেও শিকড়ের টান আলগা হয় না। প্রতি বছর সে কথাই প্রমাণ হয়ে যায় আবাহন থেকে বিসর্জনের প্রতি মুহূর্তে। এ বার যদিও কিছুটা হলেও মিলনোৎসবে সুর কেটেছে। আক্ষেপ ঝরে পড়ল বাড়ির নবীন সদস্য পূজা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে। অতিমারির কারণে আসতে পারছেন না অনেকেই। প্রবেশ নিষিদ্ধ দর্শনার্থীদেরও। দুর্গাপুজোর আঙিনায় থাকবেন শুধুই পরিবারের সদস্যরা। সঙ্গে আন্তরিক প্রার্থনা, মায়ের আগমনে পৃথিবীর অসুখ সেরে গিয়ে সর্বাঙ্গীন যেন কুশল হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন: বৌদ্ধতন্ত্রাচারে পুজো পান বলাগড় পাটুলির দ্বিভুজা দুর্গা

Durga Puja 2020 Durga Puja Celebration 2020 Durga Puja Bandyopadhyay Family

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।