মাথায় কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন নিয়ে ফেরি করতে বেরিয়েছিলেন অমৃতলাল দাঁ। কলকাতার গলি তস্য গলি ঘুরে বড় রাস্তা ধরে অক্লান্ত হাঁটা। কাজটা খুব সোজা নয়। কুড়ি তিরিশ লিটার ওজনের জিনিস প্রতি দিন এমন নিয়ে নিয়ে ঘোরা বড় পরিশ্রমের। কত দূরে দূরে যেতে হয়! দিঘির ধারে বিরাট পুলিশ সাহেবের বাংলো বাড়ি থেকে বড়লাটের বাড়ি, কখনও কখনও ছোটলাটের বাড়িও। আরও সাহেবসুবো তো আছেই। জলা-জঙ্গলময় রাস্তা, কাঁচা পাকা সড়ক— সবই পেরিয়ে যেতে হয়। বড়লাট আর ছোটলাটের বাড়িতে তেল পৌঁছে দেওয়ার কাজটা পেয়েছেন সদ্য। বেশ দু’পয়সা লাভ করতে শুরু করেছেন এই কাজের দৌলতে। সবই ইষ্ট দেবী জগদ্ধাত্রীর কৃপায়। এর আগে দাঁ পরিবার থাকত বাঁকুড়ার কোতুলপুরে। সেখানে জমিজমা ছিল খানিকটা। চাষবাস করে চলে যাচ্ছিল দিব্যি। নবান্নে নতুন ধানের গন্ধে ম ম করত ঘর। পাড়ার আটচালায় ছোট করে হলেও প্রতি বছর দেবী জগদ্ধাত্রীর পুজো করতেন নিষ্ঠা ভরে। হঠাৎ কী যে হল। কোনও কিছুই আর রইল না আগের মতো। নষ্ট হয়ে গেল সব।
গ্রামের শান্ত পরিবেশ, পুকুরের ধার বাড়ি জমি জায়গা সব ছেড়ে স্ত্রী হেমাঙ্গিনী আর সন্তানদের নিয়ে কোতুলপুর ছাড়লেন অমৃতলাল। সেখান থেকে এসে উঠলেন হাওড়ার ডোমজুড়ে গুরুগৃহে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর উত্তর কলকাতায় ছোট্ট একটু জমি কিনে চলে এলেন তিনি। কম মনঃকষ্টে ভোগেননি সেই সময়। আস্তে আস্তে সেই তেলের ব্যবসাই যত্ন করে দাঁড় করালেন। আর এখন তো রীতিমতো ভালই আয় হচ্ছে তা থেকে। তবে এত কিছুর পরও এ বছর মন ভাল নেই তাঁর। বড় আদরের মেয়ে মুক্তকেশী মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিধবা হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়ি। সকালেও দেখেছেন মলিন মুখে মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জানলার গরাদ ধরে।
সামনেই পুজো, ঘন নীল আকাশের ছায়া পড়েছে বাড়ির সামনের দিঘির বুকে। অথচ মেয়ের মুখ কী অন্ধকার। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সেদিন অনেক বাড়ি ফিরে দেখেন মুক্তকেশী বসে আছে বাবার অপেক্ষায় খাবার সাজিয়ে। মেয়ের মুখ দেখে সব বুঝতে পারলেন বাবা। প্রতি বছর এই সময়ে মুক্তকেশীর শ্বশুরবাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। বিরাট বড় করে দুর্গাপুজো হয় সেখানে। পুজোর যাবতীয় আয়োজনে থাকত সে। এবার আর সেখানে জায়গা নেই মুক্তকেশীর। এই শূন্যতা কম নয়। সেদিন রাতেই ছেলেদের ডেকে অমৃতলাল দাঁ বললেন, এবার থেকে এই বাড়িতে তাঁর কন্যার ইচ্ছায় দুর্গাপুজো হবে। পরের দিন থেকেই জোরকদমে শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। মুক্তকেশীর বৈধব্য যতটা অন্ধকার নিয়ে এসেছিল, দেবীর আগমনী ঠিক ততটাই আলো নিয়ে এল বাড়িতে। সেই শুরু। দীন রক্ষিত লেনের অমৃতলাল দাঁ বাড়ির পুজো এবার ১৫৪ বছরে পা দিল।
এই বাড়িতে ঠাকুরের কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর দিন। দেবীর ডান পা তৈরিতে যে গরান কাঠ দেওয়া হয়, প্রথমে বাড়িতে ওই দিন তার পুজো হয়। তারপর তা পাঠিয়ে দেওয়া হয় কুমোরটুলিতে। সেখানেই মূর্তি তৈরি হয়। আগে অবশ্য বাড়িতেই দেবীমূর্তি তৈরি হত। এখন দোমেটে হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে ঠাকুর আনা হয়। মূর্তির তৈরির বাকি কাজ সম্পন্ন হয় বাড়িতেই। পুজো শুরুর সময় অধিবাস এবং বোধন বেশ কয়েক দিন আগে শুরু হলেও এখন ষষ্ঠীর দিন সকালেই অধিবাস হয়ে বোধন শুরু হয় বোধন ঘরে। সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা গঙ্গার ঘাট থেকে স্নান করিয়ে নিয়ে এসে বাড়িতে মহাস্নান করানো হয়। একচালার সাবেক প্রতিমা হয় এখানে। সিংহ হয় অশ্বমুখী। পুজোর সময় কুলদেবতা নারায়ণ শিলা, মঙ্গলচণ্ডী এবং ধান্যলক্ষ্মীকে দালানে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। পুজোর সময়ে প্রতি বছরই ভিয়েন বসে। পুজোর যাবতীয় মিষ্টি বানানো হয় বাড়িতেই। সপ্তমী থেকে দশমী— প্রতিদিনই দু’বেলা দেবীকে ১৬টি লুচি, আলুভাজা, বেগুনভাজা, দই এবং ক্ষীর দেওয়া হয়। নৈবেদ্যে দেওয়া হয় নাড়ু, প্যাঁড়া সহ পাঁচ রকম মিষ্টি। সন্ধিপুজোয় ১০ কেজি চালের নৈবেদ্য দেওয়া হয়। আগে দাঁ বাড়িতে সপ্তমী অষ্টমী এবং নবমী তিনদিনই বলি হত। সপ্তমী এবং অষ্টমীতে ছাগ বলি নবমীর দিন আখ এবং কুমড়ো বলি দেওয়া হত। এখন বলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে আগের মতই নিষ্ঠা ভরে অষ্টমীর দিন কুমারীপুজো হয়। দশমীর দিন বিসর্জনের আগে দেবীর চরণের কাছ থেকে নির্মাল্য নিয়ে বাড়ির সদস্যরা যান যে যাঁর ব্যবসাক্ষেত্রে। সেখানেই গিয়ে সেই নির্মাল্য কর্মস্থানে স্পর্শ করান তাঁরা এই বিশ্বাসে যে, দেবীর কৃপায় ব্যবসায় শ্রীবৃদ্ধি হবে। দশমীর দিনই এই বাড়িতে হয় সুবচনী পুজো। দেবী দুর্গা পতিগৃহে চলে যাচ্ছেন তাই তাঁর মঙ্গলকামনায় এই ব্রত পালন করা হয়। পদ্মফুল,পান-সুপারি, সিঁদুর লাগে পুজোতে। উঠোনের চার কোনায় আলপনা দিয়ে আঁকা হয় খোঁড়া হাঁস। এই পুজোয় হাঁসের ডিমও রাখা হয়। পুজোর পরে এখনও বাড়ির পূর্বপ্রথা মতো হাঁসের ডিম চুরি করে ছেলেরা। দেবী বিদায়ের সময়ে যিনি সংকল্প করেন তিনি কনকাঞ্জলি দেন পুরোহিতকে। ধুনোর আঠা আর জরি দিয়ে তৈরি বুলেনের সাজে আগে সাজতেন এ বাড়ির প্রতিমা। কৃষ্ণনগর থেকে বিশেষ শিল্পী আসতেন তার জন্য। বিসর্জনের সময় সামান্য নড়াচড়াতে ঝকমকে সেই কাজ এমন জীবন্ত হয়ে উঠত দেবীর সাড়া শরীর জুড়ে যে, চমক লাগত সবার। মনে হত, দেবী বিদায়ের দিন তাঁর অভয়হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন ভক্তদের দিকে। এখন আর বুলেনের কাজ হয় না। সাধারণ জরির সাজেই সাজেন দেবী। তবে আজও এই বাড়ির প্রতিমা বড় উজ্জ্বল, মহিমাময়ী।
আরও পড়ুন: সন্তানের আকাঙ্ক্ষায় মানকরের পর্ণকুটিরে, সেখানেই শুরু বিশ্বাসবাড়ির পুজো
এই বাড়িতে এ বার পুজোয় বাইরের লোকের ঢোকা নিষেধ। যদি নিতান্তই কারও যাওয়ার হয় তা হলে তা পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষ।
ঠাকুর এবং ঠাকুরদালানের ছবি - শ্রাবন্তী মিত্র।
ভোগের ছবি পরিবার থেকে পাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy