‘আসুন আসুন আসুন! অষ্টমীর সন্ধ্যায় বিশেষ আকর্ষণ। রূপমঞ্জরী অপেরার নিবেদন, সুপারস্টার মঞ্জিল ব্যানার্জি ও প্রিয়া দাস অভিনীত সুপার ডুপার হিট পালা 'ঢপবাজ স্বামীর রংবাজ বউ'। আসুন আসুন আসুন!’
একেবারে হবহু এমন প্রচারের ঢংটি নকল করে বলে, স্মৃতির অতলে ডুবে গেলেন প্রায় তিন দশক ধরে যাত্রার সফল অভিনেতা ও পালাকার মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘পালাটা অসম্ভব হিট করেছিল জানেন। এই ২০০৩-০৪ সাল হবে। কত লোক কেবল যাত্রা দেখবে বলে সেই অষ্টমীর সন্ধেয় কলকাতা যায়নি ঠাকুর দেখতে। আর শুধু গ্রামবাংলাই কেন, ২০০৩-০৪ সাল অবধি কলকাতা শহরের কসবা থেকে রাজারহাট, বালিগঞ্জ থেকে সিঁথি, চুটিয়ে পালা করেছি আমরা। তারপর যে কী হল...!’
মাইতি প্রোডাকশনের কর্ণধার রাজু মাইতি বললেন, ‘পুজো আসা মানেই চিৎপুর পাড়ায় ব্যস্ততা শুরু। ষষ্ঠী থেকে শুরু করে সেই জষ্ঠী অবধি, মেদিনীপুর পূর্ব থেকে পশ্চিম, বাঁকুড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া আসানসোল...! দম ফেলার সময় থাকে না আমাদের।’ এই রাজু মাইতির ছত্রছায়ায় তিন তিনটি প্রোডাকশন হাউস প্রভাস অপেরা, নিউ রাজদীপ অপেরা আর রাজেশ্বরী অপেরা দৌড়য়।
পুজো আসছে, আর পুজোর ঠিক আগে আগেই চিৎপুর পাড়ার গ্রিনরুমে ঢুঁ মারল আনন্দবাজার অনলাইন, যাত্রার চড়া দাগের মেকআপের নীচের বাস্তব চিত্রটা অনুভব করতে।
কথা হচ্ছিল আরেক সফল পালাকার তথা অভিনেতা ও নির্দেশক, পল্লব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বলছিলেন, ‘দেখুন, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে যাত্রার আঙ্গিকেও নানা পরিবর্তন হয়েছে। আজকের যাত্রা অনেক বেশি থিয়েট্রিক্যাল, মাইকের ব্যবহারে সেই উঁচু তারে বাঁধা চড়া দাগের অভিনয় নেই বললেই চলে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে দৌড়তে গিয়ে স্থূল রুচির অনুপ্রবেশ ঘটেছে যাত্রায়, ঠিক যেমনটা হয়েছিল দু'হাজারের গোড়ার দিকে। সেদিনের টেলিভিশনের জায়গা নিয়েছে আজ মোবাইল ও ওটিটি। ’৭০-’৮০র দশকের সেই দাপুটে পালাকারেরা ভৈরব গাঙ্গুলী , সুনীল চৌধুরি, জ্যোতির্ময় দে বিশ্বাস, ব্রজেন দে, এঁদের অভাব মেটানোর লোক কই আজ! কিন্তু আজও মানুষ ভালো গল্প খোঁজে, দক্ষ নির্দেশকের শৈলী দেখতে ছুটে আসে দূর দূরান্ত থেকে।’ সখেদে আরও রোগ করেন পল্লব। তবে আশার কথা, করোনা কাল পেরিয়ে বর্তমান সরকারের আনুকূল্যে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলগুলি। তপন কুমার, শান্তিগোপাল পুরস্কারের অর্থমূল্য আজ ১ লাখ টাকা, প্রবীণ শিল্পীরা ভাতা পাচ্ছেন পঁচিশ হাজার টাকা করে। নয় নয় করে অপেরা হাউসগুলো বছরে ১৫০ থেকে ২০০ পাচ্ছে, যা যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক। গ্রাম মফসসল ছেড়ে দিলেও কলকাতা শহরের অলিগলি পেরিয়ে বাঙালির যাত্রার কিন্তু আজ ভুবনজোড়া যশ। বিদেশেও তার কদর যথেষ্ট।’ পল্লব ও মঞ্জিলের কথাগুলোই যেন পুনরাবৃত্তি করলেন নভনীল রায়চৌধুরি। সমতা দাসের সঙ্গে জুটি বেঁধে যিনি দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলার আনাচেকানাচে। এদের অনেকেরই মত, বাম জমানার চেয়ে এখন অনেক ভাল আছে যাত্রাপাড়া!
যাত্রা মঞ্চ মানেই একটা যেন সম্পূর্ণ বিনোদন প্যাকেজ। সেখানেও রমরমা কিন্তু কম নয়। স্বপনকুমার, শান্তিগোপাল, শেখর গঙ্গোপাধ্যায়, মদনকুমার, তারাবিবি, সন্তু মুখোপাধ্যায়... নামগুলো বলতে বলতে যেন সেই উনিশ বছরের বেণীবাঁধা কিশোরী হয়ে যান রুমা দাশগুপ্ত। দেখতে দেখতে যিনি যাত্রার সঙ্গে কাটিয়ে ফেললেন প্রায় বিয়াল্লিশটা বছর। হাজার হাজার দর্শকের ভিড়ে তিনি আজও ভোলেননি সেই ব্যক্তিকে, যিনি তাঁর অভিনয় দেখে রুমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৫টি অমূল্য টাকা, পরের দিনের বাজারের পাথেয়।
স্বপনকুমারের 'মাইকেল', শিবদাস মুখোপাধ্যায়ের 'চেঙ্গিস খাঁ' কিংবা শান্তিগোপালের 'টারজান'-এর মতো প্রোডাকশন আজ না হলেও দর্শকের উন্মাদনা একই আছে। দূরে ঢাক বাজছে মণ্ডপে। চার পাশে গ্রামীণ মেলার টুকিটাকি দোকান, নতুন ধান কাটার পর পয়সা এসেছে চাষির ঘরে, খিলখিলিয়ে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে বাড়ির বউরা— এ এমন এক ক্ষেত্র, যেখানে একটা রাতের জন্য উধাও হয়ে যায় যাবতীয় বাধা। রথের সময়ের বায়না পেরিয়ে ষষ্ঠী থেকে জষ্ঠী, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পায়ে সর্ষে বেঁধে ঘুরে বেড়ান যাত্রার 'যাত্রী'রা, এ এক অনন্য অনুভূতি, বৃত্তটা যেন সম্পূর্ণ হয় ইন্দ্রানী গুপ্তের কথায়।
তাহলে, কী ভাবছেন? এবার পুজোয় যাবেন নাকি মেদিনীপুর কিংবা বর্ধমান? হয়ে যাক 'প্রথম দেখা শেষ স্টেশনে'! আর দেরি কেন, ওই যে স্টেশনে ঢুকছে ন’টা পনেরোর মেদিনীপুর লোকাল, পর্দা উঠবে ঠিক ১০টায়। সুপারস্টার পল্লব মুখোপাধ্যায় অভিনীত, অ্যাকাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সুকুমার রায় রচিত, সুপার ডুপার হিট পালা। আসুন আসুন আসুন..!
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy