স্ত্রী মৃদুলা ত্রিপাঠীর সঙ্গে পঙ্কজ ত্রিপাঠী ছবি: সংগৃহীত
কিং নাকি কিং মেকার? কার গুরুত্ব বেশি? উত্তর কঠিন। তবে অন্তত এই জুটির জন্য প্রশ্নটার উত্তর সহজ। দু’জনেরই আসন সমান উচ্চতায়। মৃদুলা ত্রিপাঠী এবং তাঁর স্বামী পঙ্কজ ত্রিপাঠী। দ্বিতীয় নামটি আজ সারা দেশে পরিচিত। যাঁর অভিনয়ের নেশায় মত্ত ৩৩ কোটি দেশের মানুষ। কিন্তু সেই খ্যাতি প্রাপ্তির সমান অধিকার রয়েছে প্রথম জনের। তিনি এই বাংলারই মেয়ে। খাস কলকাতার। আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে আড্ডায় দুর্গাপুজোর স্মৃতি, দাম্পত্যের কথা জানালেন বলিউডের তারকা-পত্নী (এই তকমায় কোনও আপত্তি নেই তাঁর) মৃদুলা ত্রিপাঠী।
প্রশ্ন: এ বছরও কলকাতায় থাকা হল না পুজোর সময়ে, খুবই মন খারাপ নিশ্চয়ই?
মৃদুলা: খুব। আমার যে কত স্মৃতি কলকাতার পুজোর, কী আর বলি! আমার পরিবারের ইতিহাস ঘাঁটলে হয়তো দেখা যাবে, আমি বাঙালি নই। বিহারের মানুষ আমরা। কিন্তু কলকাতাই আমার মাতৃভূমি। আমি জন্মেছি এখানে। বড় হয়েছি। পড়াশোনা করেছি। প্রেমে পড়েছি। বিয়েও করেছি। সবই কলকাতাকে ঘিরে। আর পুজো তো তার সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে।
প্রশ্ন: আপনি তো সত্যিই বঙ্গকন্যা। নয়তো মুম্বইয়ের বাড়ির নাম ‘রূপকথা’ রাখা যায় নাকি?
মৃদুলা: আমার এক বন্ধুর মা এই নামকরণ করেছিলেন। বাংলোটা কেনার পরে তিনি বলেন, ‘‘মৃদুলা, তোর যাত্রাটা তো রূপকথার মতো। তাই নামটা এটাই দে।’’ শুধু কি তা-ই? আমাদের ‘রূপকথা’র পাশেই দুটো শিউলি ফুলের গাছ আছে জানেন? এই সময়ে তো বালতি বালতি ফুল আসে ঘরে।
প্রশ্ন: তার মানে শরৎ উপভোগ করতে খুব বেশি দূরে যেতে হয় না আপনাদের। পুজোর আমেজ ঘরেই পেয়ে যান!
মৃদুলা: (হেসে) হ্যাঁ তো! আরে এই বাংলোটা বেছে নেওয়ার কারণই তো শিউলি ফুলের গাছগুলো। ওইটা দেখেই এই বাড়ি কেনা হয়েছে।
প্রশ্ন: পুজোর আবহ তো মুম্বইতে থেকেও ঘরের ভিতরেই পেয়ে গিয়েছেন। এ বার শুধু খাওয়াদাওয়া…
মৃদুলা: সে ব্যাপারেও বঞ্চিত নই আমরা। গণপতি পুজো করি আমি বাড়িতে। চার দিন মহাভোজ হয়। আমি নিজে হাতে বাঙালি পদ রান্না করি। তা সে ৫০ জন অতিথি আসুন, বা ১০০। রান্নাঘরে আমি আবার নিজেকে ছাড়া কাউকে ভরসা করি না। গণপতির সময়েই ছোটখাটো দুর্গাপুজোর মতো উৎসব পালন করে নিই আমি।
প্রশ্ন: কী কী রান্না করেন নিজের হাতে?
মৃদুলা: সব। কড়াশুঁটির কচুরি থেকে শুরু করে ছোলার ডাল, খিচুরি, লাবড়া, নানা রকমের ভাজা, পাঁচমিশালি তরকারি, আলু পোস্ত, ঘণ্ট, চাটনি, কত কী! তবে একটা খাবারই আমি নিজে করতে পারি না। বলা যেতে পারে, রিক্রিয়েট করতে পারি না।
প্রশ্ন: কী সেটা?
মৃদুলা: (হেসে) ফুচকা। ওই একটা খাবার কলকাতার মতো করে বানাতে পারি না। বাকি সমস্ত কলকাত্তাইয়া রান্নায় আমি বেশ পটু।
প্রশ্ন: পঙ্কজ স্যারের কেমন লাগে বাঙালি ভোজ?
মৃদুলা: ওর তো বাঙালি খাবার খুব ভাল লাগে। আসলে বাঙালি রান্নায় তেমন মশলা বা তেল তো ব্যবহার হয় না। বড়জোর ওই সরষে বাটা, আর কিছু নয়। তাই পঙ্কজ খেয়ে খুব আরাম পায়। আমাদের এখানে (মহারাষ্ট্রে) রান্নায় খুব মশলা দেওয়া হয়। সেটা ওর পছন্দ নয়।
প্রশ্ন: পঙ্কজ স্যার তার মানে কলকাতা আর বাঙালিদের প্রকৃত অনুরাগী বলা যায়?
মৃদুলা: (হেসে) সত্যিই কিন্তু তাই। বাঙালি খাবার হোক, বা সংস্কৃতি, সবই ওর প্রাণের কাছাকাছি। আপনাদের বাংলার জামাইবাবুও প্রায় বাঙালিই হয়ে উঠছে। আর আমাদের মেয়েকেও বাংলা শেখানো হচ্ছে। ওর বর্ণ পরিচয় শুরু হয়েছে। আমি নিজে যতটা পারি দেখিয়ে দিই। নয়তো আমার দিদির বৌমাকে ফোন করে বুঝে নেয় মেয়ে। ও! আরও একটা মজার গল্প আছে।
প্রশ্ন: কী সেটা?
মৃদুলা: বাঙালিরা যে এখনও দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে ঘুম দেয়, এটা ওর খুব মজা লেগেছে। ও বলে, ‘‘পৃথিবীর সম্ভবত এই একটি জায়গায় এখনও মানুষ ভাতঘুম দেয়। এটা যে কী সুন্দর।’’
প্রশ্ন: ভাতঘুম ছাড়া কি বাঙালি হয়!
মৃদুলা: (হেসে) বটেই তো। আমিও তো মাঝেমধ্যেই ভাতঘুম দিই। (হাসি)
প্রশ্ন: এ বার তাহলে দুর্গাপুজোটাও বাড়িতে করে ফেলতে পারেন!
মৃদুলা: ও বাবা! এ বারই পঙ্কজের সব বন্ধুরা আমায় বলছে, ‘‘বৌদি, এ বার এখানে দুর্গাপুজো করে ফেলুন।’’ আমি বললাম, ‘‘রক্ষে করো। সাত দিনের গণপতির পুজোতেই আমি যা কাহিল হয়ে পড়ি, দুর্গাপুজোর জন্য কমপক্ষে ১০ দিনের আয়োজন।’’ (হাসি) তবে যদি সব কিছু ঠিক থাকে, পরের বছর থেকে পুজো করতেও পারি বাড়িতে। দেখা যাক!
প্রশ্ন: এটা তো বড় খবর! বাড়ির পুজোর তো মজাই আলাদা।
মৃদুলা: তবে আমরা কিন্তু বাড়ির পুজো দেখেছি। পঙ্কজও। ভবানীপুরে আমার দিদি নিজের বাড়িতে ৩ বছর টানা পুজো করেছে। তার পরে বিভিন্ন কারণে আর করতে পারেনি।
প্রশ্ন: তার মানে কেবল প্যান্ডেলের পুজো নয়, পঙ্কজ স্যার বাড়ির পুজোও দেখেছেন?
মৃদুলা: হ্যাঁ, খুবই বিস্মিত হয়েছে ও। এত আনন্দ পেয়েছিল যে বলার নয়! বাঙালি নিয়ম মতেই আমরা সব করেছিলাম। আমার দিদির বৌমা বাঙালি। আমরা যে নিয়মের অর্থ বুঝতাম না, ও বলে বলে দিত। কলা বউ কেন হয়, বরণ কী ভাবে করে, সব বুঝিয়ে দিয়েছে। আমার মেয়ের কাছেও খুব আনন্দের ছিল ওই তিনটে বছর। মহালয়া থেকে শুরু করে বিজয়া, সিঁদুর খেলা, ভাসান পর্যন্ত সব কিছু পালন করতাম আমরা। বড় বড় কড়াইতে খিচুড়ি ভোগ রান্না হত। কত লোক আসত। পরিবেশটাই অন্য রকম হয়ে যেত।
প্রশ্ন: ধুনুচি নেচেছেন?
মৃদুলা: অবশ্যই! ধুনুচি নাচ তো হতেই হবে। আমি, দিদি, দিদির বৌমা সবাই নাচতাম। ঢাক, করতাল, শঙ্খ, উলু– কী সুন্দর দেখায় গোটা জায়গায়টা। আমার মেয়েও এখন শঙ্খ বাজাতে শিখে গিয়েছে। তবে পঙ্কজ নাচ-টাচের দিকে পা-ও মাড়ায় না। দূর থেকেই দেখে। সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে পঙ্কজ।
প্রশ্ন: আর বিয়ের আগে পুজোয় প্রেম করেছেন পঙ্কজ স্যারের সঙ্গে?
মৃদুলা: হ্যাঁ, বিয়ের আগে কয়েকটা দুর্গাপুজো আমি আর পঙ্কজ ঘুরেছি কলকাতায়। সঙ্গে যদিও আমার বাবা থাকতেন!
প্রশ্ন: সেকী! পঙ্কজ স্যার কি ভয়ে ভয়ে থাকতেন?
মৃদুলা: না না! আসলে কী বলুন তো, তখনকার দিনে প্রেমটা ও রকম ছিল না। বড় সরল ছিল সবটা। আমরা জানতাম, কোনখানটায় গিয়ে আমার দাঁড়ি টানতে হবে। কোনটা উচিত, কোনটা অনুচিত। আমরা সরল দুই শিশুর মতোই পুজো দেখতে বেরোতাম বাবার সঙ্গে। বলতে পারেন, আমরা খানিক পুরনো দিনের প্রেমিক-প্রেমিকার মতো ছিলাম। এখনও সে রকমই আছি।
প্রশ্ন: কলকাতা এলে নিশ্চয়ই ফুচকা খাওয়া চলতেই থাকে?
মৃদুলা: হ্যাঁ, আমি তো ওটা বানাতে পারি না। তাই কলকাতা গেলে ফুচকা খাওয়া চাই-ই চাই। আমার মেয়ে ওখানে গেলে ফুচকা আর ঝালমুড়ির বায়না করে সব সময়ে। গড়িয়াহাট প্যান্টালুনসের সামনের ঝালমুড়ি ওর খুব পছন্দ।
প্রশ্ন: ভিড়ে যেতে ভয় করে না? যদি কেউ চিনে নেয়, তা হলে তো ছেঁকে ধরবে কত মানুষ। পঙ্কজ স্যার সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই!
মৃদুলা: না, তখন বর থাকে না সঙ্গে। কিন্তু আমি আর মেয়ে এক দু’বার ধরা পড়েছি। এ রকম একটা মজার ঘটনা আছে জানেন? বরদান মার্কেটের উল্টো দিকে খাবারের স্টলে দাঁড়িয়ে বেশ মুখ বড় বড় করে ফুচকা খাচ্ছি আমি আর মেয়ে। হঠাৎ একটি মেয়ে এসে আমাদের এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।’’ আমি হাঁ করা মুখ বন্ধ করে বললাম, ‘‘কেন?’’ সে বলল, ‘‘আপনি তো মিসেস ত্রিপাঠী।’’ আমি বলেছিলাম, ‘‘না না, আপনি ভুল করছেন কোথাও। আমি অন্য কেউ।’’ (হাসি)
প্রশ্ন: আচ্ছা, মৃদুলা ত্রিপাঠীর বদলে ‘মিসেস ত্রিপাঠী’ সম্বোধন করলে আপনার অসুবিধা হয়? পঙ্কজ স্যারও বার বার এ কথা স্বীকার করেন, তাঁর সাফল্যের পিছনে আপনার অনেকটা অবদান, কিন্তু এখন এই সম্বোধন…
মৃদুলা: আমি তো ‘মিসেস ত্রিপাঠী’ই। তা হলে এই নামে ডাকলে অসুবিধা কেন হবে? (হেসে) আমরা দু’জনেই আসলে নিজেদের জীবনে এটা অনুশীলনের মধ্যে রাখি। একে অপরকে সম্মান দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমার কথার গুরুত্ব দেওয়া, পঙ্কজ আর আমার বোঝাপড়া খুব সুন্দর। পরিবারে আমার বলার অধিকার যথেষ্ট আছে কি না, সেটাই আসল। আর সেখান থেকেই বোঝা যায়, আমি কারও দাঁড়া অবদমিত বা কারও ছায়ায় নিজেকে ঢেকে রাখিনি। আর পঙ্কজ মানুষটা এত ভাল, এত সফল, যে আমাকে ওর স্ত্রী হিসেবে চিনলে কোনও অসুবিধা নেই।
প্রশ্ন: মুম্বইতে থাকলে পুজো প্যান্ডেলে যাওয়া হয়? রানি মুখোপাধ্যায়, কাজলদের মুখার্জি বাড়ির পুজোতে?
মৃদুলা: না, আমি মুম্বইতে থাকলে কোনও প্যান্ডেলেই খুব একটা যাই না। প্রথমত, এত ভিড়! দ্বিতীয়ত, কলকাতার আমেজটা পাই না। তাই আরও মন খারাপ হয়ে যায়।
প্রশ্ন: হ্যাঁ, কলকাতার দুর্গাপুজোর স্বাদ কি আর কোথাও পাওয়া যায় নাকি!
মৃদুলা: না, অসম্ভব। ওই ১০টা দিন কলকাতা যে কী স্বর্গীয় হয়ে ওঠে! আর আমার ধারণা, এই উৎসবটাই একমাত্র উৎসব, যা দেবীপক্ষকে উদযাপন করে। গোটা ভারতবর্ষ তো পিতৃতন্ত্রের পূজারী, সেখানে কলকাতার এই উৎসব একেবারে অন্য কথা বলে। এতেই নারীদের ক্ষমতায়নের বীজ লুকিয়ে থাকে। তবে গত কয়েক মাস ধরে যা ঘটছে, দূরে বসে থেকেও লজ্জিত আমি। খুব কষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন: আর জি করের ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে বলছেন নিশ্চয়ই?
মৃদুলা: হ্যাঁ অবশ্যই। এ ছাড়াও আরও কিছু কুৎসিত ঘটনার কথা পড়ছি খবরে। ভাল লাগছে না। আমরা ছোট থেকে কলকাতা শহরে রাত করে বাড়ি ফিরলেও ভয় পেতাম না। মনে আছে, কোনও কোনও দিন রাত হয়ে গেলে পাড়ার দাদারাও আমাদের খেয়াল রাখত।
প্রশ্ন: গর্বের সঙ্গে বলতে পারতেন, কলকাতা শহরে রাতেও মেয়েদের কোনও ভয় নেই।
মৃদুলা: একদমই তাই! যেখানে নারীশক্তির পুজো করা হয়, সেখানে এমন ঘটনা ঘটেছে, ভাবতেই পারছি না। তবে এ বার পুজোয় দেবী হয়তো মানুষের মনকে সুন্দর করে তুলবে। এত যন্ত্রণা, কষ্ট থেকেও হয়তো মুক্তি দেবেন। সব থেকে বড় কথা, দোষীদের শাস্তি দেবেন। আমি আশাবাদী।
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy