‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে এক মঞ্চে মমতা এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় যে পদ্ধতিতে জনসংযোগ শুরু করেছেন, তাকে সিলমোহর দিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়ে দিলেন, অভিষেকের এই কর্মসূচিকে সমর্থন করছেন এবং গুরুত্ব দিচ্ছেন মানুষ। তাঁর কথায়, ‘‘এটা গণচেতনা, গণজাগরণের পদ্ধতি।’’ তবে তৃণমূলের নতুন প্রজন্মের জনসংযোগকে সমর্থন করার পাশাপাশিই দলের সর্বোচ্চ নেত্রী বলেছেন, নতুন যাঁরা দলে এসেছেন, তাঁরা যেন দলের লড়াইয়ের ইতিহাসটাও জেনে নেন।
তবে প্রত্যাশিত ভাবেই দলের নবীন-প্রবীণের মেলবন্ধনও ঘটাতে চেয়েছেন মমতা। মালদহ সফরে তিনি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে। মালদহের ইংরেজবাজারে অভিষেকের কর্মসূচির মঞ্চে মমতার সঙ্গেই ছিলেন ফিরহাদও। বক্তৃতার শেষ দিকে মমতা বলেন, ‘‘পরবর্তী প্রজন্মকে তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছি। আমার মৃত্যুর পর ববি-অভিষেকরা ওদের (বিরোধীদের) গেঁথে দিয়ে যাবে।’’ অভিষেক এবং ফিরহাদকে একই বন্ধনীতে নিয়ে এসে মমতার ওই বক্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। কারণ, সম্প্রতি কলকাতার রাস্তায় ‘পার্কিং ফি’ বৃদ্ধি নিয়ে দলের অন্দরে যে একটা সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা অনেকেরই মনে রয়েছে। সেই কারণেই একই মঞ্চে মমতা-ফিরহাদ-অভিষেকের উপস্থিতিও আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে টানা ৬০ দিনের বাংলা সফরে বেরিয়েছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক। বৃহস্পতিবার ছিল সেই কর্মসূচির দশম দিন। সেই দিনে মালদহের ইংরেজবাজারে অভিষেকের অধিবেশন মঞ্চে গিয়েছিলেন মমতা। মালদহে প্রশাসনিক সভা সেরে মুখ্যমন্ত্রী যান ওই মঞ্চে। সেখানেই তিনি বলেন, ‘‘অভিষেকদের এই কর্মসূচিকে আমি গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ, মানুষ এই কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। সমর্থন করছেন।’’ মমতার কথায়, ‘‘অনেকে নবজোয়ার আন্দোলন নিয়ে কুৎসা করেছে। কুকথা-অকথা বলেছে। কিন্তু এই যে জোয়ার এসেছে, এই জোয়ার সবকিছুকে ভাসিয়ে দেবে। নবজোয়ার নয়, এটা প্লাবন। এটা আগামিদিনে বিজেপিকে রোখার স্পন্দন।’’
মমতা জানিয়েছেন, অভিষেকের এই কর্মসূচি শেষের সভাতেও তিনি উপস্থিত থাকবেন। মমতা বলেন, ‘‘ওরা এই জনসংযোগ শেষ করবে গঙ্গাসাগরে। সে দিন আবার ওদের সঙ্গে আমার দেখা হবে।’’
তবে অভিষেক এবং তাঁর নেতৃত্বে দলের এই কর্মসূচিকে পূর্ণ সমর্থন করার পাশাপাশিই মমতা এটা বলতে ভোলেননি যে, অভিষেক এবং তাঁর টিমের অভিজ্ঞতা এখনও ততটা হয়নি। মমতার কথায়,‘‘অভিষেকরা এখনও বয়সে অনেক ছোট। ও দু’বারের এমপি (সাংসদ)।’’ অভিষেক যে তাঁর ‘স্নেহাস্পদ’, তা-ও বুঝিয়ে মমতা বলেছেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, একটানা দু’মাসের কর্মসূচি না করতে। মাঝে মাঝে যাওয়া-আসা করে করতে। কিন্তু এখনকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশি জেদি। তারা মনে করে, একটানা রাস্তায় থেকে জীবনটাকে একটু দেখে নিই। আমার নিষেধ অগ্রাহ্য করেই দুর্যোগ মাথায় নিয়ে অভিষেক বেরিয়েছে। আজকাল খুব বাজ-টাজ পড়ছে। আজ (বৃহস্পতিবার) ওদের দশম দিন। ১০ দিন পথে থাকা সহজ কথা নয়।’’
বৃহস্পতিবার মালদহে মমতার বক্তব্যের পরে তৃণমূলের অন্দরে অনেকের অভিমত, তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলনেত্রী হিসেবে তিনি তো বটেই, মানুষও অভিষেকের পাশে রয়েছেন। জনতাও অভিষেকের কর্মসূচিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের নেপথ্যে অভিষেকেরও ‘বড় ভূমিকা’ ছিল। ওই ভোটের পরেই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করা হয় অভিষেককে। তার পরেই ‘নতুন তৃণমূল’ গড়ার বার্তা দিয়েছিলেন তিনি। যা ঘিরে সরগরম হয়েছিল রাজ্য রাজনীতি। সেই সময়ে এ নিয়ে তৃণমূলের অন্দরে খানিকটা জল্পনাও তৈরি হয়েছিল। তবে দ্রুতই সকলে বুঝতে পারেন, তৃণমূলে নতুন (মতান্তরে, দ্বিতীয়) প্রজন্মের নেতা অভিষেকই। বৃহস্পতিবার মমতাও তেমনই বোঝালেন। তবে একইসঙ্গে এ-ও বুঝিয়ে দিলেন যে, নতুন প্রজন্মের পথচলা এখনও অনেক বাকি রয়েছে।
প্রসঙ্গত, অতীতে তৃণমূল যতগুলি জনসংযোগ কর্মসূচি নিয়েছে, তার সবই ছিল মমতার নামে। ‘দিদিকে বলো’, ‘দিদির সুরক্ষাকবচ’, ‘দিদির দূত’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গত বিধানসভা নির্বাচনে দলের স্লোগানই ছিল ‘বাংলা নিজের মেয়েকে চায়’। কিন্তু এই প্রথম তৃণমূল একটি কর্মসূচি নিয়েছে, যাতে মমতার নাম নেই। বরং আছে নতুন জোয়ারের কথা। সেই ‘নবজোয়ার’-কেই স্বীকৃতি এবং গুরুত্ব দিয়েছেন মমতা। পাশাপাশিই অভিষেকের এই কর্মসূচি নিয়ে বিরোধীদের কটাক্ষেরও মোকাবিলা করেছেন। পঞ্চায়েতের প্রার্থী বাছাইয়ে গোপন ভোট পর্বে ‘ব্যালট বিশৃঙ্খলা’ নিয়ে অনেকে সমালোচনা করছেন। পাল্টা আক্রমণে তারও মোকাবিলা করেছেন মমতা। সেই সূত্রেই বলেছেন, ‘‘নবজোয়ার আন্দোলন নিয়ে কেউ কেউ অকথা, কুকথা বলছে। কিন্তু আমি মনে করি, এই যে জোয়ার এসেছে, এই জোয়ারে সে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।’’
তবে বরাবরের মতোই দলের অন্দরে ‘ভারসাম্য’ও রক্ষা করেছেন দলের সর্বময় নেত্রী। ইংরেজবাজারের সভায় নতুন প্রজন্মের কাছে তৃণমূলের অতীত সংগ্রামের কাহিনি তুলে ধরে বলেছেন, ‘‘আমি ২৩,০০০ কিলোমিটার জনসংযোগ করেছিলাম। সম্ভবত ১৯৯৩ সালে বেলপাহাড়ি থেকে শুরু করেছিলাম।’’ সেই সময় আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে অনাহার দেখেছিলেন বলে জানান মমতা। পাশাপাশি, বাম আমলে কী ভাবে তিনি অত্যাচারিত হয়েছেন, সেই বিবরণও তুলে ধরেন। বলেন, ‘‘আমি একটা জীবন্ত লাশ।’’ একই সঙ্গে মমতার বক্তৃতায় আসে সিঙ্গুরে অনশনের প্রসঙ্গ থেকে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে নন্দীগ্রামে তাঁর পায়ে চোট পাওয়ার ঘটনাও। দলের ইতিহাস যাতে নতুন দিনের নেতা-কর্মীরা জেনে নেন, তা জানিয়ে মমতা বলেন, ‘‘তৃণমূলের ইতিহাস জানতে হবে। যে লড়াই করে তৃণমূল তৈরি হয়েছে, তেমন লড়াই এই পৃথিবীতে আর কেউ করেনি। অনেক লড়াই করে তৃণমূল তৈরি করেছি। আজ যাঁরা এসেছেন, তাঁরা হয়তো জানেনও না পুরোটা। আমার লেখা বইগুলো পড়ে নেবেন।’’