(বাঁ দিকে) সাদ্দাম লস্কর। সাদ্দামের বাড়ির বেডরুম থেকে শুরু হওয়া সুড়ঙ্গ (ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।
কুলতলিতে প্রতারণার মামলায় অভিযুক্ত সাদ্দাম লস্করের ডেরায় অভিযান চালাতেই সোমবার এক সুড়ঙ্গের সন্ধান পায় পুলিশ। বাড়ির বেডরুম থেকে শুরু হয় সুড়ঙ্গ। প্রায় ৪০ ফুট লম্বা সেই সুড়ঙ্গ গিয়ে মিশেছে বাড়ির পাশেই এক খালে। এই সুড়ঙ্গ ঘিরেই ক্রমে রহস্য জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। বাড়ির মধ্যে কেন এই সুড়ঙ্গ? কী এর কাজ? কেন এই সুড়ঙ্গের প্রয়োজন হল বাড়ির মধ্যে? এমন বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে আসতে শুরু করেছে।
কেন এত গুরুত্ব সুড়ঙ্গের?
এই বাড়ি, খাল, সুড়ঙ্গ… সব মিলিয়ে অবস্থানগত সুবিধা রয়েছে যথেষ্ট। কিছু দূর এগিয়েই এই খাল গিয়ে মিশেছে মাতলা নদীতে। ফলে কোনও রকম বেগতিক বুঝলে প্রতারণার কারবারে অভিযুক্তদের পক্ষে এই সুড়ঙ্গপথে পালানো অনেকটাই সহজ। সুড়ঙ্গ থেকে এক বার খালে নেমে এলেই, ডিঙি নৌকায় চেপে সবার অলক্ষে মাতলা নদী হয়ে পালিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
পরিকল্পিত প্রতারণার চক্র, অনুমান পুলিশের
সোমবার কুলতলিতে সাদ্দামের বাড়িতে অভিযানে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা। ঘটনায় সাদ্দামের স্ত্রী রাবেয়া-সহ দু’জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিন্তু সাদ্দাম এখনও অধরা। তবে পুলিশ সূত্রে খবর, শুধু সাদ্দামই নয়, কুলতলির এই প্রতারণার কারবারে যুক্ত ছিলেন আরও বেশ কয়েক জন। বোটো, সাকাত, হাফিজুল-সহ এমন বেশ কয়েক জনের নাম ইতিমধ্যেই তদন্তে উঠে এসেছে বলে জানা গিয়েছে। পুলিশ সূত্রে খবর, গ্রামের একটি গোষ্ঠীকে নিয়ে পরিকল্পিত ভাবে এই প্রতারণার চক্র গড়ে উঠেছিল। তদন্তকারীদের অনুমান, টাকার টোপ দিয়েই গ্রামবাসীদের একাংশকে নিজেদের চক্রে টেনেছিলেন সাদ্দামেরা।
এর আগেও এই গ্রাম থেকে এমন একাধিক প্রতারণার অভিযোগ উঠে এসেছিল। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই গ্রামের দুই-এক জনকে এগিয়ে দেওয়া হত। সূত্রের খবর, তাঁরা পুলিশের কাছে অপরাধের দায় স্বীকার করে নিতেন। আত্মসমর্পণ করতেন। ফলে তখনকার মতো বিষয়টি চাপা পড়ে যেত। যাঁরা এই প্রতারণাচক্রের মূল মাথা, তাঁরা নিজেদের মতো কাজ চালিয়ে যেতেন। এ দিকে আবার ধৃতেরা পরবর্তী সময়ে জামিন পেয়ে আবার যোগ দিতেন দলে। শুধু তাই নয়, যখনই গ্রামে পুলিশি অভিযান শুরু হত, তখনই মহিলাদের সামনে এগিয়ে দেওয়া হত বলে খবর। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সোমবারও।
কী ভাবে চলত প্রতারণার কারবার?
পুলিশ সূত্রে খবর, কোনও ধাতব মূর্তি বা বিভিন্ন প্রাচীন জিনিসপত্র দেখিয়ে এই প্রতারক দল ক্রেতা জোগাড় করত। এর জন্য প্রতারকেরা ব্যবহার করতেন গ্রামের সাধারণ মানুষদের। তাঁদের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলা হত, নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে ওই মূর্তিগুলি তাঁরা কুড়িয়ে পেয়েছেন।
এই মূর্তিগুলি বানানো হত এক বিশেষ কায়দায়। মূর্তির একটি নির্দিষ্ট অংশ, যেমন নাকের একটি অংশ, বা কানের একটি অংশে রাখা হত খাঁটি সোনা। বাকি অংশ পুরোটাই ভুয়ো। যখন ক্রেতাদের সঙ্গে দরদাম চলত, তখন ওই খাঁটি সোনার অংশটুকুই যাচাই করে দেখানো হত। ফলে সেটি আসল সোনার মূর্তি ভেবে অনেক ক্রেতাই তা কিনতে রাজি হয়ে যেতেন।
এর পর সেই মূর্তি কেনার জন্য তাঁদের ডাকা হত কুলতলির পয়তার হাট এলাকায়। বলে দেওয়া হত, নগদ টাকা নিয়ে আসতে হবে। এর পর ক্রেতারা খাঁটি সোনার মূর্তি লাভের আশায় টাকার বান্ডিল নিয়ে সেখানে গেলেই টাকাপয়সা হাতিয়ে চম্পট দিত দুষ্কৃতীরা।
পুলিশ সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, যে ক্রেতারা এ ভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই বিষয়টি থানা পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাইতেন না। কারণ, চোরাচালানে ফেঁসে যাওয়ার ভয় থাকত অনেকের মনে। তবে অনেকেই আবার অভিযোগ জানাতেনও। পুলিশ সূত্রে খবর, বিগত বছরখানেকের মধ্যে এমন তিনটি অভিযোগ জমা হয়েছিল পুলিশের কাছে। শেষ অভিযোগটি জমা পড়েছিল গত মাসেই। নদিয়ার এক বাসিন্দার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে নামেন পুলিশকর্মীরা।