গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
সুরতহাল হয়ে গিয়েছে। ময়না তদন্তের জন্য চলে গিয়েছে মৃতদেহ। তৈরি হচ্ছে ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা নমুনার (সিজার) তালিকা। কিন্তু আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক পড়ুয়াকে ধর্ষণ, খুনের ঘটনায় তখনও লেখাই হয়নি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা বা ‘ইউডি কেস’। সিজার তালিকা তৈরির দায়িত্ব পাওয়া টালা থানার সাব-ইনস্পেক্টর সুব্রত চট্টোপাধ্যায়কে থানা থেকে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর দেবীপ্রসাদ দাস জানিয়ে দেন, ‘৮৬১’ নম্বরটা ব্যবহার করা যেতে পারে। এই নম্বরটা কেস ডায়েরিতে লেখা রয়েছে এবং তার পাশে জায়গা ফাঁকাও রয়েছে! অতঃপর এই নম্বর লিখেই তখনকার মতো তৈরি হয়েছে সিজার তালিকা! পরে এই নম্বরেই তৈরি হয়েছে দেশ জুড়ে শোরগোল ফেলা এই ধর্ষণ-খুনের মামলার এফআইআর!
এখানেই শেষ নয়। থানায় গিয়ে ফিরে আসার প্রমাণ হিসাবে সুব্রত লিখেছেন ৫৭৬ নম্বর জেনারেল ডায়েরি (জিডি)। ধর্ষণ, খুনের মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনার বিবরণ দিয়ে লিখেছেন ৫৭৭ নম্বর জিডি। পূরণ করেছেন ৮৬১ নম্বর ইউডি কেসের পাশের ফাঁকা জায়গা। কিন্তু এই মৃতদেহ উদ্ধারের ঘটনার খবর থানা জানতে পেরেছিল কখন? কার থেকে? জিডি-তে ঘটনার উল্লেখ করে কি পুলিশ গিয়েছিল তদন্ত করতে? এ ক্ষেত্রে উত্তর, না।
রাতে থানায় ফিরে সাড়ে ১১টা নাগাদ সুব্রতই লেখেন সকালের ৫৪২ নম্বর জিডি। সময় হিসাবে লেখা হয় সকাল ১০টা ১০ মিনিট। যার অর্থ হল, সুব্রতই থানায় বসে মৃতদেহ উদ্ধারের খবর পেয়েছেন এবং আর জি কর হাসপাতালে গিয়েছেন তদন্ত করতে! কিন্তু সকাল ১০টা ১০ মিনিটে যখন টালা থানায় প্রথম খবর আসে, সুব্রত তখন থানায় ছিলেনই না। তিনি সে দিন ডিউটিতে যান বেলা ৩টেয়! আদালত কক্ষে সুব্রতের এই বয়ানে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছেন, রায়ের প্রতিলিপিতে লিখেছেন বিচারক।
দেখা যাচ্ছে, মৃতার পরিবারকেই শুধু মেয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছিল তা নয়, টালা থানাতেও ফোনে প্রথম জানানো হয় এক ডাক্তার আত্মহত্যা করেছেন। এই তথ্য যায় হাসপাতালের ফাঁড়ি থেকেই। ফোন পেয়ে সুব্রত নন, হাসপাতালে গিয়েছিলেন টালা থানার সাব-ইনস্পেক্টর সৌরভকুমার ঝা। রায়ের প্রতিলিপি থেকে দেখা যাচ্ছে, ঘটনাস্থলে শুরু থেকে উপস্থিত ছিলেন এই ঘটনায় তথ্যপ্রমাণ লোপাট এবং বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অন্য মামলায় ধৃত হাসপাতালের তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। আগাগোড়া ছিলেন পুলিশের নমুনা সংগ্রহের সময়েও।
রায়ের প্রতিলিপি অনুযায়ী, লালবাজারের সায়েন্টিফিক শাখার অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-ইনস্পেক্টর শেখর রায় সুরতহাল ও ময়না তদন্তের ভিডিয়ো তোলেন। কিন্তু তিনি যে সেটা করছেন, তার কোনও জিডি নথিভুক্ত করেননি। কোর্টে তাঁর দাবি, পুরোটাই করেছেন মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে। ক্যামেরার কার্ড তিনি দিয়েছিলেন মর্গ কর্মীর জিম্মায়। ৯ অগস্ট ও ১১ অগস্ট ঘটনাস্থলে পুলিশের চিত্রগ্রাহক বীরেন রায়চৌধুরীর গতিবিধিরও কোনও জিডি রেকর্ড নেই।
সামনে এসেছে, হাসপাতালের সিসি ক্যামেরা সংযোগ ছিল অধ্যক্ষ ও সুপারের ঘরে এবং হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়িতে। সিসি ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত সংস্থার কর্মী কোর্টে দাবি করেন, ৯ অগস্ট মৃতদেহ উদ্ধারের দিন তিনি হাসপাতালে গিয়েছিলেন এমবিবিএস পরীক্ষার ফুটেজ সংক্রান্ত কাজে। সন্দীপ একটি পেনড্রাইভ দিয়ে তাঁকে সুপারের ঘরে গিয়ে আগের রাত থেকে সমস্ত ফুটেজ তাতে ভরে দিতে বলেন। ফুটেজের তথ্য ভরে দেওয়া হলেও, সেই পেনড্রাইভ পুলিশ বা সিবিআইয়ের কেউই সংগ্রহ করেনি। পুলিশ সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংক্রান্ত সিজ়ার করে ১২ অগস্ট, সিবিআই তার পরে।
রায়ের প্রতিলিপিতে রয়েছে, ১৩ অগস্ট থেকে ১৭ অগস্ট পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবে ডিএনএ পরীক্ষা এবং অন্যান্য নানা পরীক্ষার নমুনা পাঠানো হয়েছিল। ১৪ তারিখ থেকে সেই পরীক্ষা শুরু হয়। শেষ হয়েছিল ২০ তারিখ। ২১ অগস্ট রিপোর্ট তৈরি হয়। পরীক্ষাকারী বিশেষজ্ঞের দাবি, মৃতার পোশাক দু’টি ভিন্ন মুখবন্ধ প্যাকেটে দুই ভিন্ন দিনে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠানো হয়েছিল। একটি প্যাকেটে ছিল মৃতার উর্ধ্বাঙ্গের পোশাক। অন্য প্যাকেটে তাঁর নিম্নাঙ্গের পোশাক। আর একটি ভিন্ন প্যাকেটে পাঠানো হয়েছিল দোষী সাব্যস্ত হওয়া সঞ্জয় রায়ের পোশাক এবং জুতো।
রায়ে উল্লেখ, ৯ অগস্ট পোশাক বা অন্য কোনও নমুনা পাঠানো হয়নি পরীক্ষার জন্য। ১০ তারিখও পুলিশ নমুনা পাঠাতে চায়নি। যুক্তি হিসেবে পুলিশ জানিয়েছিল, পোশাক এবং ‘পিউবিক হেয়ার’-এর খামের লেবেলে মিলছে না। কিছু সংশোধন রয়েছে। পরের দিন ১১ অগস্ট, রবিবার, ছুটির দিন হওয়ায় সে দিনও পুলিশ নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠায়নি। ১৩ অগস্ট ‘পিউবিক হেয়ার’-এর খামের লেবেল সংশোধন করিয়ে পরীক্ষায় পাঠানোর জন্য নেয় পুলিশ। সেই সময়েই পুলিশ মৃতার পোশাক সংগ্রহ করে। শুনানিতে উঠে এসেছে, ৯ তারিখ রাতেই সঞ্জয়কে হেফাজতে নিলেও পুলিশ তার শারীরিক পরীক্ষা করায়নি। দেখা যাচ্ছে, এসএসকেএম হাসপাতালে সঞ্জয়ের শারীরিক পরীক্ষা করানোর টিকিট তৈরি হয়েছে ১০ অগস্ট বেলা ১০টা ৩৯ মিনিটে। পরীক্ষা হয়েছে বেলা ১২টার পরে। দেখা যাচ্ছে, ১৩ অগস্ট রক্তের নমুনা সংগ্রহের জন্য সঞ্জয়কে নিয়ে মানিকতলা ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু সেই রক্তের নমুনা কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাব গ্রহণ করেনি। কারণ, নমুনা রাখা বক্সে সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানের (মানিকতলা ব্লাডব্যাঙ্ক) সিল ছিল না।
রায়ের প্রতিলিপিতে দেখা যাচ্ছে, আর জি কর পুলিশ মর্গের রেজিস্টার খাতার লেখাতেও বদল করা হয়েছিল। আদালতে পুলিশ দাবি করেছে, সিল করা প্যাকেটেই ময়না তদন্তের রিপোর্ট, মেডিক্যাল শংসাপত্র এবং মৃত্যুর শংসাপত্র রাখা ছিল। সে সব বার করতে গিয়েই লেখায় কাটাকুটি করাতে হয়েছে মর্গের ডোমকে দিয়ে।