গার্ডেনরিচে নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে মৃত্যু হয়েছে ১০ জনের। — ফাইল চিত্র।
গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বাড়ির ভগ্নস্তূপ সরিয়ে মঙ্গলবার রাতে আরও এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃতের নাম মহম্মদ জামাল (৪০)। গার্ডেনরিচকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০। অন্য দিকে, ভগ্নস্তূপ সরিয়ে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে পুরসভা এবং রাজ্যের অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মীরা। সক্রিয় কলকাতা পুরসভাও। সমালোচনার মুখে পড়ে একের পর এক পদক্ষেপ করে চলেছে তারা। সেই আবহেই ওই বিপর্যয়ের দায় নিয়ে ‘ভিন্ন’ সুর শোনা গেল মেয়র ফিরহাদ হাকিম এবং ডেপুটি মেয়র অতীন ঘোষের গলায়। তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
গার্ডেনরিচের যে জায়গায় ওই বহুতল ভেঙে পড়েছে, সেই এলাকাতেই আরও কয়েকটি বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ প্রকাশ্যে এসেছে। কোথাও দেখা গিয়েছে, একটি বাড়ির গায়ে হেলে পড়েছে অন্য বাড়ি। এমনকি, দু’টি বাড়ির মধ্যে নিয়ম মেনে প্রয়োজনীয় ফাঁকটুকুও নেই। প্রশ্ন উঠছে, কী ভাবে এ রকম নির্মাণ করা সম্ভব হল? জবাব দিতে গিয়ে খোদ মেয়রের গলাতেই যেন কিছুটা ‘অসহায়ত্ব’ ধরা পড়েছে। তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, বেআইনি নির্মাণ ‘ব্যাধি’তে পরিণত হয়েছে। মেয়র হিসাবে তিনি তা দূর করতে পারছেন না। তবে হাল ছাড়বেন না বলেও জানিয়েছেন ফিরহাদ। তাঁর দাবি, চেষ্টা তিনি চালিয়েই যাবেন। পাশাপাশি, স্থানীয় কাউন্সিলরের পাশেও দাঁড়িয়েছেন ফিরহাদ। সমস্ত দায় তিনি ঠেলে দিয়েছেন পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের দিকেই।
ফিরহাদ যখন এ সব কথা বলছেন, তখন তাঁর ‘ভিন্ন’ সুর শোনা গিয়েছে কলকাতা পুরসভার ডেপুটি মেয়র অতীনের গলায়। তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এত বড় একটি ঘটনার নৈতিক দায় পুরসভা এড়াতে পারে না। এর দায় এড়িয়ে যেতে পারেন না কাউন্সিলরও। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। বলেছেন, ‘‘আমি যদি কোনও এলাকার কাউন্সিলর হতাম, আর আমার এলাকায় এমন ঘটনা ঘটত, তা হলে এই ঘটনার দায় এড়াতে পারতাম না আমি।’’
অতীনের মতো একই কথা বলেছেন বিরোধী নেতারাও। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকিও পুরসভার ভূমিকার দিকে আঙুল তুলেছেন। দাবি তুলেছেন, প্রভাবশালী কেউ জড়িত থাকলে তাঁকেও গ্রেফতার করা হোক। নওশাদ যা-ই বলুন, অভিযুক্ত প্রোমোটার মহম্মদ ওয়াসিম কিন্তু একপ্রকার ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছেন কাউন্সিলর শামস ইকবালকে। আদালত থেকে বেরোনোর সময় মঙ্গলবার ভাবেভঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর কোনও দোষ নেই। কাউন্সিলরের সঙ্গে তাঁর ছবিও প্রকাশ্যে এসেছে, যা নিয়ে সরব বিরোধীরা। এ নিয়ে অতীন যদি কাউন্সিলরকে দোষ দিতে চাননি। তাঁর মতে, ছবি তোলা মানেই ঘনিষ্ঠ নয়।
মেয়র এবং ডেপুটি মেয়রের এই ‘ভিন্ন’ মতের মাঝেই সক্রিয় হয়েছে পুরসভা। দিনভর একাধিক পদক্ষেপ করেছে তারা। বিল্ডিং বিভাগের মোট চার জনকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। বদলে অন্য বিভাগ থেকে বিল্ডিং বিভাগে আনা হয়েছে নতুন চার জনকে। ভেঙে পড়া বাড়ির আশপাশের বাড়িগুলিরও স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। শহর জুড়ে বেআইনি নির্মাণের উপর নজরদারি চালানোর জন্য ওয়ার্ড অফিসারদের ময়দানে নামানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।
অন্য দিকে, গার্ডেনরিচকাণ্ডে দ্রুত শুনানির আর্জি মঞ্জুর করেনি কলকাতা হাই কোর্ট। মঙ্গলবার ওই ঘটনায় আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিজেপি নেতা রাকেশ সিংহের আইনজীবী। বৃহস্পতিবার এই মামলার শুনানি হতে পারে।
আরও এক জনের দেহ উদ্ধার
গার্ডেনরিচের ঘটনাস্থল থেকে আরও এক ব্যক্তির দেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মৃতের নাম মহম্মদ জামিল (৪০)। মঙ্গলবার রাতে গার্ডেনরিচে ভেঙে পড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপ থেকে জামিলকে উদ্ধার করা হয়। তার পর দ্রুত অ্যাম্বুল্যান্সে করে হাসপাতালে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখানে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। গার্ডেনরিচকাণ্ডে এখনও পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রশাসন সোমবার যে পরিসংখ্যান দিয়েছিল, তাতে ৯ জন নিহতের পরিচয় মিলেছিল। তাঁরা হলেন, আকবর আলি (৩৪), রিজওয়ান আলম (২২), হাসিনা খাতুন (৫৫), শামা বেগম (৪৪), মহম্মদ ইমরান (২৭), মহম্মদ ওয়াসিক (১৯), নাসির আহমেদ (৫৯), নাসিমুদ্দিন (২৪), শেখ আবদুল্লা (১৮)। ওই পরিসংখ্যান থেকেই জানা গিয়েছিল, গার্ডেনরিচের ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ জন। তাঁদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এসএসকেএমে ভর্তি রয়েছেন তিন জন। গার্ডেনরিচের হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৯ জন। পাঁচ জনকে চিকিৎসার পর এসএসকেএম থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন, জাহারা বেগম, মহম্মদ আসলাম, শাহিনা খাতুন এবং নুর সালিম ইসলাম। এক জনের নাম জানা যায়নি। আহতদের মধ্যে রয়েছে তিন শিশুও।
মেয়রের গলায় ‘অসহায়ত্ব’
সোমবার মেয়র ফিরহাদ পূর্বতন বাম সরকারের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। মঙ্গলবার তাঁর কথাবার্তায় কিছুটা ‘অসহায়ত্ব’ প্রকাশ পেল। তিনি বলেন, ‘‘বেআইনি নির্মাণ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমি দূর করতে পারছি না।’’ পাশাপাশি অবশ্য তিনি এ-ও জানিয়েছেন, বেআইনি নির্মাণ ঠেকানোর চেষ্টা তিনি চালিয়ে যাবেন, হাল ছাড়বেন না। যে এলাকায় বহুতল ভেঙে পড়ার ঘটনাটি ঘটেছে তা ফিরহাদের বিধানসভা কলকাতা বন্দর এলাকার মধ্যেই পড়ে। মঙ্গলবার ফিরহাদ বলেন, ওই এলাকায় যে এ ভাবে বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে, তা তাঁর জানা ছিল না। তার পরেই ‘ব্যাধি’র কথা বলেন তিনি। আঙুল তোলেন কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের কর্মীদের দিকেও। স্থানীয় কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে বিজেপির অভিযোগও মানতে চাননি তিনি। জানিয়েছেন, ওই বিভাগের কর্মীদের শো কজ় করা হয়েছে। ভিত তৈরির সময়েই যদি ধরা যায়, তা হলে এ সব হয় না। কলকাতা পুরসভায় মেয়র পরিষদে বিল্ডিং বিভাগের দায়িত্ব ফিরহাদেরই। তবে ফিরহাদ কার্যত মেনে নিয়েছেন, তিনি মেয়র হিসাবে বেআইনি নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তাঁর আরও দাবি, ২০২১ সাল থেকে তিনি বেআইনি নির্মাণ ভাঙার বিষয়ে পদক্ষেপ করছেন। তাঁর সময়ে কলকাতায় ৮০০-র বেশি বেআইনি নির্মাণ ভাঙা হয়েছে। যার মধ্যে বেশ কিছু নির্মাণ গার্ডেনরিচ এলাকার বলেও জানিয়েছেন মেয়র।
‘ভিন্ন সুর’ ডেপুটি মেয়রের
বিল্ডিং বিভাগের দিকে আঙুল তুলেছেন মেয়র। কাউন্সিলরের দোষ নেই বলেই মনে করেন তিনি। কিন্তু ডেপুটি মেয়র অতীন অন্য কথাই বললেন মঙ্গলবার। তিনি জানান, পুরসভা এর দায় এড়াতে পারে না। তাঁর কথায়, ‘‘এত বড় একটি ঘটনার নৈতিক দায় পুরসভা এড়াতে পারে না। এর দায় কাউন্সিলরও এড়িয়ে যেতে পারেন না।’’ যদিও ধৃত প্রোমোটারের সঙ্গে কাউন্সিলরের ছবি নিয়ে কারও দোষ তিনি দেখতে চাননি। তিনি জানান, ছবি তোলা মানেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এটা ভাবা ঠিক নয়। রাজনীতিকদের পাশে বিভিন্ন মঞ্চে দাঁড়িয়ে অনেকেই ছবি তোলেন। তার মানে এই নয় যে, তাঁর বানানো বাড়ি ভেঙে পড়েছে বলে সেই রাজনীতিক দায়ী হবেন। অতীন এ কথা বললেও কাউন্সিলরের দায় এড়ানোর বিষয়টি মানতে চাননি। তিনি বলেন, ‘‘আমি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে শুনেছি, উনি এই অবৈধ নির্মাণের কথা জানতেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমি যদি কোনও এলাকার কাউন্সিলর হতাম, আর আমার এলাকায় যদি এমন ঘটনা ঘটত, তা হলে আমি এই ঘটনার দায় এড়াতে পারতাম না।’’
প্রোমোটারের ‘ক্লিনচিট’
ডেপুটি মেয়র যা-ই বলুন, প্রোমোটার কিন্তু অন্য কথাই বলেছেন। বিরোধীরা বার বার স্থানীয় কাউন্সিলরের দিকে আঙুল তুলেছে। মেয়র ফিরহাদ তা মানেননি। ‘ক্লিনচিট’ দিয়েছিলেন স্থানীয় কাউন্সিলর ইকবালকে। ফিরহাদ জানিয়েছিলেন, কোন গলিতে কী হচ্ছে, তা কাউন্সিলরের জানার কথা নয়। এ বার ধৃত প্রোমোটার ওয়াসিমও সে রকমই জবাব দিলেন। বহুতল নির্মাণের কথা কি কাউন্সিলর জানতেন? আদালত থেকে বেরোনোর সময় অভিযুক্ত প্রোমোটারের উদ্দেশে এই প্রশ্ন করতেই তিনি মাথা নাড়েন। মঙ্গলবার বিকেলে ধৃত ওয়াসিম ওই প্রশ্নের জবাবে মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন, না কি প্রশ্নের জবাব দিতে চাইলেন না, তা তাঁর শরীরী ভাষা থেকে স্পষ্ট নয়। তবে পুলিশ ভ্যানে উঠে প্রোমোটার বলেন, ‘‘ইঞ্জিনিয়ার জানতেন।’’ কিন্তু কোন ইঞ্জিনিয়ারের কথা বলতে চাইলেন, সেটাও স্পষ্ট করেননি। প্রসঙ্গত, ধৃতের সঙ্গে কলকাতা পুরসভার ১৩৪ নম্বরের কাউন্সিলর ইকবালের ছবি প্রকাশ্যে এসেছে। তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি। এ বার সেই জল্পনা অভিযুক্ত প্রোমোটারও খারিজ করলেন।
বিল্ডিং বিভাগে রদবদল
গার্ডেনরিচকাণ্ডের পর থেকে সমালোচনার মুখে পড়েছে কলকাতা পুরসভা। তার জেরে মঙ্গলবার কলকাতা পুরসভার বিল্ডিং বিভাগে বড়সড় রদবদল হল। বিল্ডিং বিভাগের মোট চার জনকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। বদলে অন্য বিভাগ থেকে বিল্ডিং বিভাগে আনা হয়েছে নতুন চার জনকে। অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) দেবব্রত ঘোষকে বিল্ডিং বিভাগ থেকে সরিয়ে পাঠানো হয়েছে, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-১ বিভাগে। তাঁর সঙ্গেই সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) শুভম ভট্টাচার্যকেও ওই একই বিভাগে পাঠানো হয়েছে। দু’জন সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) সবুজ বিশ্বাস ও তন্ময় কুইল্যাকে যথাক্রমে জল বণ্টন বিভাগ এবং টালি নালা ও নগর বিকাশ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। বদলে বিল্ডিং বিভাগের নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) পদে আনা হয়েছে বরুণ সরকারকে। তাঁকে টালি নালা ও নগর বিকাশ বিভাগ থেকে এই দায়িত্বে আনা হয়েছে। অন্য তিন জন সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার পদে আনা হয়েছে কুশল মণ্ডল, সত্যপ্রিয় সরকার এবং মনোজকুমার ঘোষকে। তাঁদের জল বণ্টন, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও টালি নালা ও নগর বিকাশ বিভাগ থেকে বিল্ডিং বিভাগে আনা হয়েছে।
পুর-নজরদারি
নির্মীয়মাণ বহুতল ভেঙে পড়ার পর সক্রিয়তা বাড়িয়েছে কলকাতা পুরসভা। সোমবার পুরসভার বিল্ডিং বিভাগের ডিজির সঙ্গে বৈঠক করেন মেয়র ফিরহাদ। সেই বৈঠকে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ১৫ নম্বর বরো এবং ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে শো কজ় করেছে পুরসভার বিল্ডিং বিভাগ। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের জবাব দিতে বলা হয়েছে। গার্ডেনরিচের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কড়া পদক্ষেপ করতে মেয়রের উদ্যোগে বিশেষ নির্দেশিকা জারি করেছে কলকাতা পুরসভা। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, এখন থেকে প্রতি দিন সকাল সাড়ে ১০টায় অফিসে ঢুকেই ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারেরা নিজেদের ওয়ার্ড পরিদর্শন করবেন। সেই ওয়ার্ডের কোথাও কোনও বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখবেন তাঁরা। মঙ্গলবার কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান রঞ্জিত শীল দাবি করেছেন, ‘‘গত দেড়-দু’মাসে ২০টিরও বেশি বাড়ি বেআইনি নির্মাণের অভিযোগে ভাঙা হয়েছে। এই ঘটনার পর কলকাতা পুরসভা বেআইনি নির্মাণ নিয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ করবে।’’ কলকাতা পুরসভার অফিসারদের ওয়ার্ডে বেআইনি নির্মাণ পরিদর্শন ও নোটিস দেওয়াকে ‘নাটক’ বলে কটাক্ষ করেছেন ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষ।
অন্য বাড়ির স্বাস্থ্যপরীক্ষা
গার্ডেনরিচকাণ্ড থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা এক ঝাঁক বাড়ির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন পুর কর্তৃপক্ষ। কলকাতা পুরসভা সূত্রের খবর, প্রাথমিক ভাবে স্বাস্থ্যপরীক্ষার কাজ শুরু করতে মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে গিয়েছেন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়রেরা। রবিবার গভীর রাতে নির্মীয়মাণ বাড়িটি ভেঙে পড়ার পর ওই এলাকার একাধিক নির্মাণ নিয়ে অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, ভেঙে পড়া বাড়িতে তো বটেই, ওই এলাকার বেশির ভাগ আবাসনের কোনওটি আংশিক বেআইনি, কোনওটি আবার পুরোপুরি বেআইনি ভাবে তৈরি করেছেন প্রোমোটারেরা। এমন অভিযোগ পাওয়ার পর স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়রেরা ওই এলাকার একাধিক বাড়ির স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে কলকাতা পুরসভায় একটি রিপোর্ট দেবেন বলে জানা গিয়েছে। কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা ছ’টি বাড়ি আপাতত চিহ্নিত করা হয়েছে। ওই বাড়িগুলির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রাথমিক ভাবে কাজ শুরু করেছে পুরসভা। সোমবার রাতেই ওই ছ’টি বাড়িকে কলকাতা পুরসভার তরফে নোটিস পাঠানো হয়েছে। কলকাতা পুরসভা সূত্রে খবর, ভেঙে পড়া বাড়িটির লাগোয়া আরও একটি পাঁচ তলার বাড়ি নজরে এসেছে পুর আধিকারিকদের। সেই বাড়িটি আবার এক দিকে হেলে পড়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়েরা। আগামী ২১ মার্চ কলকাতা পুরসভায় ওই সব নির্মীয়মাণ বিপজ্জনক বাড়িগুলি নিয়ে শুনানি হবে। সেই শুনানির পর যাবতীয় পদক্ষেপ করবে পুরসভা।
দ্রুত শুনানি নয়
গার্ডেনরিচের ঘটনায় দ্রুত শুনানির আর্জি মঞ্জুর করল না কলকাতা হাই কোর্ট। মঙ্গলবার ওই ঘটনায় আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিজেপি নেতা রাকেশ সিংহের আইনজীবী। তাঁর বক্তব্য, গার্ডেনরিচে বেআইনি নির্মাণ ভেঙে কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। ওই এলাকায় এমন আরও অন্তত ৫০টি বেআইনি নির্মাণ রয়েছে। রাতের অন্ধকারে ওই সব নির্মাণ করা হয়। বুধবার বিষয়টি নিয়ে দ্রুত শুনানি করা হোক। প্রধান বিচারপতি টিএস শিবজ্ঞানম এবং বিচারপতি হিরণ্ময় ভট্টাচার্যের ডিভিশন বেঞ্চ এই বিষয়ে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করার অনুমতি দেয়। ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবার মামলাটির শুনানি হতে পারে। মঙ্গলবার কলকাতা হাই কোর্টে বেআইনি নির্মাণ সংক্রান্ত অন্য একটি মামলার শুনানিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিচারপতি অমৃতা সিংহ। গার্ডেনরিচকাণ্ড উঠে এসেছে তাঁর মন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘‘কয়েক সেকেন্ডে একটি বাড়ি ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। অথচ একটি বাড়ির বাইরের অংশ ৩০ দিনেও ভাঙা গেল না!’’
বিরোধীদের দাবি
মঙ্গলবার সকালে গার্ডেনরিচের দুর্ঘটনাস্থলে হাজির হন আইএসএফ নেতা নওশাদ সিদ্দিকি। তিনি দাবি করেন, গার্ডেনরিচে বাড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনায় কলকাতা পুরসভা এবং প্রশাসনকেই দায় নিতে হবে। এখানেই শেষ নয়। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়েই পাঁচ দফা দাবি তোলেন নওশাদ। এক, সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে, তা আরও দ্রুত গতিতে হতে হবে। দুই, পুকুর এবং জলাশয় বুজিয়ে কী ভাবে বেআইনি ভাবে বহুতল বানানো হল, তার দায় কলকাতা পুরসভা এবং প্রশাসনকে নিতে হবে। তাঁর তৃতীয় দাবি, জনরোষকে চাপা দিতে শুধু প্রোমোটারকে গ্রেফতার করিয়ে তাঁর উপর দোষ চাপিয়ে পিঠ বাঁচানো যাবে না। মানুষকে এ ভাবে ভুল বোঝানো যাবে না। চার, যাঁরা এই অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের প্রত্যেককে গ্রেফতার করতে হবে। তাঁদের মধ্যে যদি বড় কোনও নাম বেরিয়ে আসে, তবে তাঁকেও গ্রেফতার করতে হবে বলে দাবি নওশাদের। তাঁর পঞ্চম দাবি, যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যাঁদের কোনও আত্মীয়স্বজন মারা গিয়েছেন, তাঁদের অতিরিক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যাঁদের বাড়ি ভেঙেছে, যত দিন না বাড়ি তৈরি হচ্ছে, তাঁদের বাড়ি ভাড়া দিয়ে সরকারকে রাখতে হবে। তিনি সেখানে রাজনীতি করতে যাননি বলেও দাবি করেন নওশাদ। পুরসভার তরফে যদিও জানানো হয়েছে, ‘অবান্তর’ দাবি তুলে রাজনীতি করলে চলবে না। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হয়েছে। তৃণমূলের তরফে অভিযোগ তোলা হয়েছিল, বাম আমলেই কলকাতায় বেআইনি নির্মাণের সূচনা হয়। বাম জমানায় কলকাতা পুরসভায় সঠিক ভাবে অডিট হত না বলেও শাসকদল অভিযোগ তোলে। মঙ্গলবার আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সাংবাদিক বৈঠক করে তার জবাব দেন সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ তথা কলকাতার প্রাক্তন মেয়র বিকাশ ভট্টাচার্য। তিনি পাল্টা বলেন, ‘‘তৃণমূলের রাজনৈতিক ডিএনএ-তে দু’টি বিষয় রয়েছে। এক, অসত্য আর দুর্নীতি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের পর আমি যখন মেয়র হয়েছিলাম, সেই সময়ে বকেয়া অডিট আমরাই করিয়েছিলাম।’’