বাঁ দিক থেকে হাফিজুল মোল্লা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শেখ নুর আমিন। —ফাইল চিত্র।
২০২২ সালের ৩ জুলাই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে পাকড়াও হন এক আগন্তুক। তাঁর কাছ থেকে মেলে প্রচুর সিম কার্ড এবং একটি লোহার রড। পুলিশ জানতে পারে পুরো এক রাত মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ভিতরে ঘাপটি মেরে ছিলেন হাফিজুল মোল্লা নামে ওই ব্যক্তি। ঠিক এক বছর ১৭ দিন পর আবারও শোরগোল। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে থেকে গ্রেফতার আর এক আগন্তুক। তাঁর নাম শেখ নুর আমিন। তবে হাফিজুলের মতো শুধু লোহার রড নয়, নুরের কাছে মিলেছে আগ্নেয়াস্ত্র, ভোজালি এবং মাদক দ্রব্য। কী কারণে ২১ জুলাই, শুক্রবার তিনি মুখ্যমন্ত্রীর কালীঘাটের বাড়ির সামনে গিয়েছিলেন তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে উদ্দেশ্য যে ‘মহৎ’ নয়, তা বলাই যায়। আর কাকতালীয় ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে দুই অনুপ্রবেশকারীর ‘অভিযান’ ঠিক একই মাসে— জুলাই।
শুক্রবার দুপুর। ধর্মতলায় তৃণমূলের ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের মঞ্চে আর কিছু ক্ষণের মধ্যেই যোগ দেওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাড়ি থেকে আর আধ ঘণ্টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ার কথা তাঁর। আচমকা শুরু হইচই। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি লাগোয়া ‘মিলন সংঘ’ ক্লাবের গেটের পাশ দিয়ে নিরাপত্তার বেড়াজাল ডিঙিয়ে জোর করে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়তে চান এক যুবক। তাঁকে বাধা দেয় কালীঘাট থানার পুলিশ। কিন্তু ওই চালক বেপরোয়া। তাঁকে পাকড়াও করে চমকে যায় পুলিশ। একে একে উদ্ধার হয় ভোজালি, আগ্নেয়াস্ত্র। পুলিশের দাবি, মাদকও ছিল। ২১ জুলাই সমাবেশের দিন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির সামনে এমন অনভিপ্রেত ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য ছড়ায়।
যা যা মিলেছে ওই গাড়িতে
যে গাড়িটি নিয়ে নুর মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির গলিতে ঢুকেছিলেন, সেটি এখন কালীঘাট পুলিশের জিম্মায়। পুলিশ সূত্রে খবর, ‘পুলিশ’ লেখা গাড়িটির নম্বর ডব্লিউবি ০৬ইউ **৭৭। এবং সেটা শেখ নুর আমিন নামে এক ব্যক্তির নামে রয়েছে। যে হেতু পাকড়াও হওয়া ব্যক্তির নামও তাই, ধরে নেওয়া হয়েছে, গাড়ির মালিকও তিনি। তল্লাশি চালিয়ে নুরের কাছ থেকে বিএসএফ এবং অল ইন্ডিয়া পুলিশ লেখা আইবি-র পরিচয়পত্র পায় পুলিশ। মিলেছে পুলিশের টুপি, পুলিশের বেল্ট এবং একটা কার্ডে লেখা সিজিও কমপ্লেক্সের ঠিকানা। কিন্তু নুর ঠিক কী উদ্দেশ্য নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পাড়ায় পুলিশের গাড়ির আড়াল নিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন, তা স্পষ্ট নয়।
কে এই আগন্তুক?
তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, নুর আদতে পশ্চিম মেদিনীপুরের আলিগঞ্জ কসাইপাড়ার বাসিন্দা। তবে কলকাতায় তাঁর ব্যবসা রয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে পঞ্চান্ন গ্রামের মার্টিনপাড়ায় একটি দোকান রয়েছে নুরের। স্থানীয়দের দাবি, দোকানটি নুর কিনেছিলেন। ‘ইন্টিরিয়র ডেকরেশন’-এর ব্যবসা আছে তাঁর। ওই দোকানে বসেই কাজ সামলান নুর। কৃষ্ণ দাস নামে এক স্থানীয় বাসিন্দার দাবি, ‘‘দোকানটি বেশ সাজানো-গোছানো। মাঝেমধ্যে সেখানে নুরের এক ভাই আসতেন।’’ জানা যাচ্ছে, ওই দোকানের পিছনে একটি ঘরে থাকেন নুর। এর আগে ওই মার্টিনপাড়াতেই অন্য একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তিনি। যদিও নুরের বিষয়ে খুব বেশি কিছু জানেন না বলেই জানিয়েছেন স্থানীয়েরা। কারণ, তিনি কারও সঙ্গেই খুব একটা মেলামেশা করতেন না। স্থানীয় কৃষ্ণের কথায়, ‘‘উনি কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করতেন না। এক বার বাড়িতে ঢুকলে বার হতেন না। কেউ আসতেনও না ওঁর কাছে।’’
মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে আগ্নেয়াস্ত্র-সহ ধরা পড়া যুবকের পরিচয় জানার চেষ্টা হয় সঙ্গে সঙ্গে। পাওয়া যায় তাঁর পরিবারকেও। নুরের স্ত্রী পুনম বিবি স্বামীর কাণ্ড শুনে কার্যত বিস্মিত। স্বামীর কাছে অস্ত্র ছিল, এটা তিনি মানতেই চাইছেন না। মেদিনীপুর শহরের অলিগঞ্জের বাসিন্দা পুনম জোর গলায় দাবি করেছেন, ‘‘যে অস্ত্রের কথা বলছেন, সেটা লাইটার।’’ তিনি জানিয়েছেন, শুক্রবার সকালেই স্বামীর সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। নুর তাঁকে জানিয়েছেন, শনিবার রাতে বাড়ি ফিরবেন। আবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকে যাওয়ার কথাও জানিয়েছেন। পুনমের কথায়, ‘‘নুর বলেন, শুক্রবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাবেশ রয়েছে। তিনি হিউম্যান রাইটস প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশনের স্টেট মেম্বার। ওখান থেকে সমাবেশে যাওয়ার আমন্ত্রণ রয়েছে। ব্যস, এতটাই কথা হয়েছে।’’ আদতে নুর কী করেন? স্ত্রী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘তিনি বিএসএফের কটস্ সরবরাহ করতেন। এখন ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের ব্যবসা করেন।’’ নুরের শ্বশুর মুন্না হাজির জানান, মেদিনীপুরের শ্বশুরবাড়িতে সাত-আট বছর ধরে থাকছেন নুর। মিলিটারিতে মাল সরবরাহ করতেন জামাই।
দিদির মিটিংয়ে যাচ্ছি
শুক্রবার সকালে দোকান থেকে নুর যখন বার হয়েছিলেন, সামনে বসেছিলেন স্থানীয় এক বৃদ্ধা। কালো গাড়িতে চেপে রওনা হওয়ার আগে শেফালি দাস নামে বয়স্কার কাছে আশীর্বাদ চান নুর। তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘দিদির মিটিংয়ে যাচ্ছি। আমায় আশীর্বাদ করুন।’’ বৃদ্ধা যদিও তখন বোঝেননি, হঠাৎ কেন এ সব বলছেন নুর, যিনি কিনা অন্য দিন তেমন কথাই বলেন না!
নুরের গাড়ির চাকা তৃণমূলনেত্রীর ২১ জুলাইয়ের সমাবেশে যাওয়ার বদলে কালীঘাটে তাঁর বাড়ির দিকে গড়ায়। এবং তার পর এত কাণ্ড। সেই খবর পেয়ে চমকে ওঠেন শেফালি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি বসে রয়েছি। গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন উনি। বললেন, দিদির মিটিংয়ে যাচ্ছি। আমায় আশীর্বাদ করুন। হঠাৎ করে! কী আশীর্বাদ করব! এই প্রথম এ রকম করলেন যে!’’ তবে শেফালি এ-ও জানিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে এমনিতে মাঝে মধ্যে কথা বলতেন নুর। ব্যবহারটাও তো ভাল। নুরের আচার-ব্যবহার নিয়ে কোনও অভিযোগ নেই তাঁর। একই কথা বলছেন শেফালির পুত্র কৃষ্ণও। তিনি বলেন, ‘‘পাশে থাকতেন, শুধু সেই হিসাবেই চিনি।’’ তবে এক বার গাড়ি রাখা নিয়ে নুরের সঙ্গে তাঁর ঝামেলা হয়েছিল, সে কথাও জানিয়েছেন কৃষ্ণ। তাঁর কথায়, ‘‘গাড়ি পার্কিং করা নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল। তিনি কথা শোনেন না বলে এড়িয়ে যেতাম।’’ যে গাড়িতে চেপে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির গলিতে ঢুকতে চেয়েছিলেন নুর, তাতে ‘পুলিশ’ লেখা স্টিকার ছিল। সেই স্টিকারের প্রসঙ্গ কৃষ্ণের বক্তব্যেও উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ‘‘গাড়িতে পুলিশের স্টিকার ছিল। জিজ্ঞেস করলে বলেন, পুলিশের এক ম্যাডামকে নিয়ে আসার কাজ করি, তাই ওটা লাগানো। কয়েক মাস আগে নম্বর প্লেটে পুলিশের যেটা লেখা থাকে, সেটা তুলে দিলেন। তবে গাড়ির উপর পুলিশ লেখা তোলেননি।’’
অস্ত্র হাতে নুর: চালিয়ে দেব!
শুক্রবার সকালে নুরের গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ভোজালি, আগ্নোয়াস্ত্র মিলেছে। সেই আগ্নেয়াস্ত্র নাকি আগেও দেখেছিলেন মার্টিনপাড়ার প্রতিবেশীরাও। কৃষ্ণ জানিয়েছেন, দিন কয়েক আগে এক বার বচসার সময় ওই আগ্নেয়াস্ত্র বার করেছিলেন নুর। তবে সেটা আসল না নকল, তা জানেন না তিনি। কৃষ্ণের কথায়, ‘‘দিন কয়েক আগে অস্ত্র নিয়ে এক জনকে ভয় দেখিয়েছিলেন। ভোরবেলা একটা গাড়ি ঢুকছিল। ওঁর দোকানের সিঁড়িতে লাগে। তিনি শুয়েছিলেন তখন। বেরিয়ে এসে অস্ত্র দেখিয়ে বলেন, ‘চালিয়ে দেব।’’
অস্ত্র আইনে মামলা
নুরের গ্রেফতারি প্রসঙ্গে কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েল বলেন, ‘‘এমন একটা দিনে (২১ জুলাই) এই ঘটনাটিকে আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। ওই ব্যক্তির সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। ছিল বিভিন্ন সংস্থার পরিচয়পত্র। এর মধ্যে একটি বিএসএফের পরিচয়পত্রও ছিল। তবে জেরায় তিনি নানা রকম কথা বলছেন। এমনও বলছেন, তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসছিলেন। কিন্তু উনি যদি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতেই আসবেন, তা হলে তাঁর কাছে অস্ত্র ছিল কেন?’’ পুলিশ সূত্রে খবর, নুরের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৭০, ১৭১, ৪৬৫, ৪৬৭-সহ অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
অন্য দিকে, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির কাছ থেকে সশস্ত্র যুবককে গ্রেফতার করার ঘটনা নিয়ে মন্তব্য করেছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশের যে দায়িত্ব, তা তারা পালন করছে না বলেই এমন হচ্ছে।’’ কটাক্ষের সুরে বলেন, ‘‘তারা রাজ্যে ভোটসন্ত্রাসে মন দিয়েছেন। ফলে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। অবিলম্বে কালীঘাট থানার আইসি এবং ওসিকে সাসপেন্ড করা উচিত।’’
যত কাণ্ড জুলাইয়ে!
২০২২ সালের ২ জুলাই রাত দেড়টা নাগাদ পাঁচিল টপকে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি চত্বরে প্রবেশ করেছিলেন হাফিজুল মোল্লা নামে এক অভিযুক্ত। ৩ জুলাই ভোরে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির ভিতর থেকে হাফিজুলকে গ্রেফতারের সময় তাঁর কাছ থেকে লোহার রড উদ্ধার হয় বলে জানায় পুলিশ। নিরাপত্তারক্ষীদের নজরে এলে তাঁকে ধরতে গেলে পালানোর চেষ্টা করেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির নিরাপত্তা লঙ্ঘনের এই ঘটনায় অভিযুক্ত হাফিজুলকে লালবাজারে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেসাবাদ করেন সিআইডির গোয়েন্দারা। দীর্ঘক্ষণ তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন গোয়েন্দারা। জানা যায়, এর আগে নবান্নে ঢুকে পড়েছিলেন হাফিজুল। মন্দিরতলা থানার হাতে গ্রেফতারও হন। কেন বারবার মু্খ্যমন্ত্ররী নিরাপত্তা বেষ্টনি লঙ্ঘন করছেন হাফিজুল তার কারণ জানতে মরিয়া পুলিশ।
তদন্তে উঠে আসে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে অনুপ্রবেশের আগে অন্তত সাত বার ওই চত্বরে নজরদারি চালিয়েছেন হাফিজুল। কিন্তু কী কারণে সে মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে সে ঢুকেছিলেন, তা আজও জানাতে পারেনি কলকাতা পুলিশ। তল্লাশি চালিয়ে হাফিজুলের ১১টি সিম কার্ড এবং দু’টি মোবাইল ফোন উদ্ধার হয়। মোবাইলে আবার কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির আশপাশের বেশ কিছু ছবিও ছিল। হাফিজুল সম্পর্কে এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু তথ্য হাতে আসে পুলিশের। যেমন, ২০২১ সালের পুজোর সময় এক বার বাংলাদেশে বেআইনি ভাবে ঢুকেছিলেন তিনি। বিহার এবং ঝাড়খণ্ডেও গিয়েছিলেন। পুলিশের অনুমান, হাফিজুল মার্চ মাস থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির আশপাশে ঘোরাফোরা করছিলেন। এমনকি, ওই এলাকায় অনেকের সঙ্গে পরিচয়ও বাড়াচ্ছিলেন তিনি। অন্যদিকে হাফিজুলের বাবা মহিদুল মোল্লা দাবি করেন, ছেলের মাথার ঠিক নেই। পরে আলিপুর আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন এসএসকেএম হাসপাতালের চিকিৎসকেরা। তাতে বলা হয় হাফিজুল সুস্থ। ফলে হাফিজুলের পরিবার ও আইনজীবীর দাবি নস্যাৎ হয়ে যায়। ২০২৩ সালে আবারও মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির সামনে সেই জুলাই-কাণ্ড।