প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহিত
প্রায় দে়ড় বছর হয়ে গেল অতিমারির। করোনার বিভীষিকা যেন কাটছেই না। রোগ-ব্যাধির ভোগান্তির পাশাপাশি মানুষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে কাজ হারানোর দুশ্চিন্তা। বহু মানুষ গত বছর লকডাউনেই কাজ হারান। বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন বাড়ি বসে অনলাইনে নতুন কোনও ব্যবসা করা। কিন্তু দেড় বছর পর তাঁদের সেই লড়াই কতদূর পৌঁছল? খোঁজ করল ‘আনন্দবাজার ডিজিটাল’।
বেলঘরিয়ার মেয়ে পর্ণা চৌধুরী। পেশায় কম্পিউটার ডিজাইনার। ট্রেনে করে শিয়ালদহ আসতেন রোজ কাজ করতে। কিন্তু ট্রেন বন্ধ হতে অফিস পৌঁছনোর পথও বন্ধ হয়ে এলে। তখন তাঁর এক মামি-শাশুড়ি ফেসবুকের একটি গ্রুপে তাঁকে যোগ করেন। শাড়ির পসরা নিয়ে পোস্ট করতেন পর্ণা। ১৫ হাজার সদস্যের মধ্যে কেউ প্রথমে পাত্তা দিতেন না তাঁকে। তারপর ধীরে ধীরে তাঁর পরিচিতি বাড়ে। শাড়ি থেকে কুর্তা-ব্লাউজ-পালাজো— সব কিছুই এখন বিক্রি করেন অনলাইনে। তাঁর ইচ্ছে, পুঁজির জোর বাড়লেই নিজে পোশাক ডিজাইন করা শুরু করবেন।
পর্ণার মতো বহু মানুষ রয়েছেন নেটমাধ্যমে। কেউ নিজে চাকরি হারিয়েছেন, কারও বাবা-স্বামী-ভাই হারিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে তাঁরা বেছে নিয়েছেন বিকল্প আয়। দেড় বছরে তাঁরা অনেকেই টিকে রয়েছেন নিজের পরিশ্রমের ফলে। অনলাইনে ব্যবসা শুরু সকলেই করতে পারেন। কিন্তু সাফল্যের পথ ততটা মসৃণ নয়। হাজার হাজার মানুষের মধ্যে নিজের পরিচিতি তৈরি করা, মানুষের মনে ছাপ ফেলা, নিজের অভিনব সৃষ্টি তুলে ধরা, এগুলি যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ। তবে পর্ণার কথায়, ‘‘গড়পড়তা জিনিস বিক্রি করলে বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। তবে নিজস্ব কোনও সৃষ্টি তুলে ধরতে পারলে, তার চাহিদাও তৈরি হয়।’’
প্রতীকী ছবি। ছবি: সংগৃহীত
সল্টলেকের তরুণী চন্দ্রিমা পাল। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্রী। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পেয়েও সংস্থা থেকে কাজ শুরু করার ডাক আসেনি। অন্য কোনও চাকরিও তেমন জুটছিল না। বরাবরই রূপচর্চার ঘরোয়া টোটকা নিয়ে তাঁর উৎসাহ। তাই উপার্যনের আশায় বাড়ি বসে প্রাকৃতিক ফেস স্ক্রাব, ফেশিয়াল অয়েল, ফেস মাস্ক তৈরি করে অনলাইনে বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। তাঁর ব্যবসা এখন চলছে রমরমিয়ে। কিন্তু বাধা-বিপত্তিও রয়েছে প্রচুর। ‘‘ক্যাশ অন ডেলিভারি’র পরিষেবা এই অতিমারির পরিস্থিতিতে দেওয়া খুব মুশকিল। কিন্তু অনেক বয়স্ক মানুষ অনলাইনে টাকা মেটাতে খুব একটা সড়গড় নন। তাঁরা তাই কিনতে চান না। আবার সকলের মানসিকতাও এক নয়। অর্ডার করার পর আমি হয়তো কাঁচা মাল কিনে প্রোডাক্ট তৈরি করে ফেলেছি। তার পরে টাকা দেওয়ার সময় ক্রেতারা আর কিনতে চাইছেন না। আমার সে ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। অনেক ঝামেলায় পড়ে শিখেছি আমি। এখন অগ্রিম টাকা না নিয়ে কাজ শুরু করি না,’’ বললেন চন্দ্রিমা।
ঘনঘন লকডাউনের ফলে অসুবিধাও নানা রকম। দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা মৌমিতা গুপ্ত আগেও অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা করতেন। কিন্তু অতিমারিতে পোশাকের বিক্রি তেমন হচ্ছিল না। তখন তিনি নানা রকম কেক, চকোলেট তৈরি করা শুরু করলেন। অন্য দোকান-বাজার এই সময় বন্ধ থাকায় তাঁর অর্ডারও আসে প্রচুর। কিন্তু ডেলিভারি করাও সমস্যা হয়ে যায় পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ হওয়ায়। ‘‘আমি কাস্টমাইজড কেক তৈরি করি। কোনওটা মিষ্টি দেওয়া, কোনওটা পিঠে-পুলি দেওয়া। সেগুলো খুবই যত্ন করে ডেলিভার করতে হয়। না হলে নষ্ট হয়ে যায়। অ্যাপের মাধ্যমে ডেলিভার করলে অনেক সময় তাঁরা ঠিক করে নিয়ে যান না। তাতে কেক পুরো নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের নিজস্ব পরিকাঠামো খুব বড় নয় যে গোটা কলকাতায় ডেলিভার করতে পারব,’’ বললেন মৌমিতা।
তবে বাধা-বিপত্তির মাঝেও পরিশ্রমই শেষ কথা। যাঁরা সেটা করতে প্রস্তুত, তাঁরা অনলাইনে ব্যবসা করে দিব্যি টিকে থাকতে পারছেন। মৌমিতা জানালেন, তিনি রোজ এত কেকের অর্ডার পান, সেটা সামলাতে আগের পোশাকের ব্যবসায় আর তেমন মন দিতে পারছেন না। চন্দ্রিমা এখন ব্যবসার পাশাপাশি অনলাইনে বিভিন্ন কোর্স করছেন যাতে ব্যবসা আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। পর্ণা এখন টাকা জমিয়ে নিজস্ব টেরালিং ইউনিট খুলেছেন। ক্রেতারা মাপ বলে দিলে তাঁদের পছন্দ মতো পোশাক তৈরি করে পাঠান। পর্ণা-মৌমিতার মতো বহু মানুষ অনলাইনে ব্যবসা কী ভাবে বাড়ানো যায়, সেই দিকে মন দিয়েছেন অতিমারির দেড় বছর পর।