গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের উদ্যোগে ‘জল ঢেলে দিল’ পটনা হাই কোর্ট। সে রাজ্যে সরকারি চাকরি এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ বৃদ্ধির প্রস্তাব সংক্রান্ত যে বিল গত বছর তাঁর সরকার বিধানসভায় পাশ করিয়েছিল, তা খারিজ করল আদালত।
বৃহস্পতিবার পটনা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিনোদ চন্দ্রনের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়েছে, বিহারে জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করা যাবে না। গত বছরের ৫ নভেম্বর বিহার বিধানসভায় ওই বিল পাশ করানোর সময় নীতীশ ছিলেন ‘মহাগঠবন্ধন’ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। জোট বদলে তিনি এখন এনডিএ-তে।
নভেম্বরের গোড়ায় বিহার বিধানসভায় জাতগণনার দ্বিতীয় রিপোর্ট পেশের পরেই তৎকালীন জেডিইউ-আরজেডি-কংগ্রেস মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবে সংরক্ষণ বাড়ানোর বিল পেশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ বিধানসভার অধিবেশনে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে বলেছিলেন, ‘‘পিছিয়ে পড়াদের অধিকার দিতে আমাদের সরকার বদ্ধপরিকর।’’ এর পর বিল পাশ করিয়ে বিহারে অনগ্রসর (ওবিসি) এবং অতি অনগ্রসরদের (ইবিসি) জন্য সংরক্ষণ ২৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি, তফসিলি জাতির (এসসি) সংরক্ষণ ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাবও ছিল ওই বিলে।
বিহারে ওবিসি এবং ইবিসি-দের জন্য ২৭ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকলেও বিহারের জনসংখ্যায় তাঁদের হার বেশি। আসল সংখ্যা প্রকাশ্যে এলে ওবিসি কোটায় আরও সংরক্ষণের দাবি উঠবে বলে আগেই মনে করা হয়েছিল। কার্যক্ষেত্রে তা-ই হয় গত ২ অক্টোবর জাতসমীক্ষার প্রথম রিপোর্ট প্রকাশের পরে। এর ফলে তথাকথিত উচ্চবর্ণ বা জেনারেল ক্যাটেগরি (অসংরক্ষিত)-র উপর আঁচ আসবে বলে জাতগণনার বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, এই ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির ফলে বঞ্চিত হবে ‘মেধা’।
সুপ্রিম কোর্টের অনুমোদন নিয়ে শেষ পর্যন্ত জাতগণনার রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন নীতীশ। তাতে বিহারের বাসিন্দাদের জাতভিত্তিক আর্থিক অবস্থার তুলনামূলক পরিসংখ্যান পেশ করা হয়েছিল। জানানো হয়েছিল, সে রাজ্যের ৩৩ শতাংশ অনগ্রসর (ওবিসি) এবং অতি অনগ্রসরের (ইবিসি) অর্থনৈতিক অবস্থান দারিদ্রসীমার নীচে। অন্য দিকে, তফসিলি জাতির (এসসি) মধ্যে গরিব ৪২ শতাংশেরও বেশি।
জাতগণনার ওই রিপোর্টে বিহারের তথাকথিত উচ্চবর্ণ, অর্থাৎ অসংরক্ষিত (জেনারেল) শ্রেণির আর্থিক হালও উঠে এসেছিল। জানানো হয়েছিল, দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারী ‘জেনারেল কাস্ট’-এর মানুষের সংখ্যা প্রায় ২৬ শতাংশ। চার জনের পরিবারের মাসিক আয় ৬,০০০ টাকার কম হলে সেই পরিবারকে ‘দরিদ্র’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় ওই রিপোর্টে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘অংসরক্ষিত’ আসন কমাতে সক্রিয় হন নীতীশ। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে নীতীশের বর্তমান সহযোগী বিজেপি নেতাদের একাংশও সে সময় তাঁর বিরুদ্ধে ‘সামাজিক বিভাজনের’ অভিযোগ তুলেছিলেন।
ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই জাতভিত্তিক সংরক্ষণে সক্রিয় হয় নীতীশ সরকার। বিধানসভায় সর্বসম্মতিতে বিল পাশের পরে গত ২১ নভেম্বর জাতভিত্তিক সংরক্ষণ ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৫ শতাংশ করার সরকারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছিল। তার পরেই পটনা হাই কোর্টে কয়েকটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে তার বিরোধিতা করা হয়। গত মার্চে শুনানি শেষের পরে রায়ঘোষণা স্থগিত রেখেছিল পটনা হাই কোর্ট।
আবেদনকারী পক্ষের এক আইনজীবী রীতিকা রানি বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমাদের আবেদনে জানিয়েছিলাম যে সংশোধনীগুলি সংবিধানের ১৪ (সমতা এবং আইনের সমান সুরক্ষা), ১৬ (কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বিষয়ে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের অধিকার) এবং ২০ নম্বর (ফৌজদারি কার্যবিধিতে কিছু অধিকার রক্ষা) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করেছে। সেই দাবির সারবত্তা মেনে নিয়েছে আদালত।’’
আবেদনকারীদের পক্ষের অন্য এক আইনজীবী, নির্ভয় প্রশান্ত বলেন, ‘‘আমরা ইন্দ্র সাহনি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় উদ্ধৃত করে সওয়াল করেছিলাম। সম্প্রতি মরাঠাদের জন্য সংরক্ষণ সংক্রান্ত মামলাতেও শীর্ষ আদালত স্পষ্ট করেছে, কোনও রাজ্য সরকার ৫০ শতাংশের বেশি জাতভিত্তিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারে না। নীতীশ সরকার অসাংবিধানিক পদক্ষেপ করেছিল।’’