Climate Change

জলবায়ুর পরিবর্তনে বদলে যাচ্ছে অর্থনীতির অভিমুখ, ভারত কতটা লাভবান হচ্ছে এতে

জলবায়ুর পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদি বদল আনছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। কার্বন-মুক্তির জন্য বদলে যাচ্ছে শিল্পের অভিমুখ। ভারত এই চ্যালেঞ্জকে কী ভাবে দেখছে?

Advertisement

টি এন নাইনান

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১০:৪৫
Share:

শেষের সে ভয়ঙ্কর দিন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। ফাইল চিত্র ।

একুশ শতকে জলবায়ুগত পরিবর্তন সভ্যতার সামনে এক নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কার্বন নির্গমনের ব্যাপারে ‘নেট জিরো’ (যে পরিমাণ গ্যাস উৎপন্ন হচ্ছে এবং যে পরিমাণ বায়ুমণ্ডল থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে সাম্যাবস্থা)-র লক্ষ্য এখন প্রায় সর্বজনীন স্তরে গৃহীত সিদ্ধান্ত। এই উদ্যোগ থেকে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের দ্বারা অর্থনীতির সামগ্রিক বদলের সম্ভাবনার কথাও বলা হচ্ছে।

Advertisement

কার্যত প্রায় সব রকমের শিল্পক্ষেত্রেই (তা শক্তি উৎপাদনই হোক অথবা পরিবহণ বা নির্মাণশিল্প বা ভারী প্রযুক্তির মতো ক্ষেত্র) এই পরিবর্তন বিপুল বদল আনতে সমর্থ এবং এই পরিবর্তন পরিবেশ সংক্রান্ত বাণিজ্য, যেমন সৌরশক্তি উৎপাদনের প্যানেল নির্মাণ বা ব্যাটারি তৈরির মতো ক্ষেত্রকে আরও বেশি উদ্দীপিত করতে পারছে। মাইক্রোচিপ উৎপাদনের মতো ব্যবসায়, যেখানে বিপুল পরিমাণ শক্তি ও সেই সঙ্গে বিশেষ ধাতুর প্রয়োজন পড়ে, সেখানে এই পরিবর্তন গতি নিয়ে আসতে সমর্থ হবে। গ্যাস ও খনিজ তেল সংবহনের জন্য ব্যবহৃত পুরনো হাইড্রোজেন পাইপলাইন গ্রিডগুলি বদলে নতুন গ্রিড লাগানো এবং সর্বত্র চার্জিং স্টেশন স্থাপনের বিষয়টিও এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন। এমতাবস্থায় এ কথা ভাবা অসম্ভব যে, কোনও বড় শিল্পক্ষেত্র এই পরিবর্তনের আঁচ থেকে দূরে থাকবে। সার উৎপাদনে ‘গ্রিন অ্যামোনিয়া’-র সন্ধান চালু থাকবে বা জীবাশ্মজাত জ্বালানির ব্যবহারের পরিবর্ত খোঁজা শুরু হবে। এই সব দেখে দু’এক দশকের মধ্যে অর্থনীতির পরিচিত চেহারাটি আমূল বদলে যেতে পারে বলেই মনে হয়।

যুক্তিসঙ্গত ভাবেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে সংবাদ শিরোনামে যেন পরিবর্তনের জন্য নির্দেশিকা উঠে আসছে। পাকিস্তানে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া বন্যা পরিস্থিতিতে সে দেশের অর্থনীতির প্রায় ৯ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে এই ক্ষতি ৫০ শতাংশে গিয়েও ঠেকতে পারে। অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষির ক্ষেত্রে বীজ বোনার প্রচলিত ছাঁদকেই বদলে দিয়েছে, অরণ্যগুলিতে দাবানলের প্রবাহ তৈরি করছে, ব্রিটেনের মতো ‘শীতের দেশ’-এ ভারতের মতো প্রখর গ্রীষ্মের সৃষ্টি করেছে। হিমালয়ে হিমবাহের গলন, দক্ষিণ মেরুর বরফের রাজ্যে সুবিশাল ভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের স্ফীতি এবং সব রকমের প্রাণীর স্বাভাবিক বাসভূমি (প্রজাপতি থেকে পান্ডা ভালুক) যে ভাবে শীতলতর এলাকা থেকে উষ্ণমণ্ডলের দিকে চলে যাচ্ছে, তাতে কখনও কখনও মনে হতে পারে, এই বুঝি সৃষ্টির অন্তিমলগ্ন সমাগত। শেষের সে ভয়ঙ্কর দিন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে।

Advertisement

এই সব কিছু মাথায় রেখে কেউ যদি বৃহৎ সংস্থাগুলির দ্বারা ঘোষিত বিনিয়োগ পরিকল্পনাগুলির দিকে নজর করলে দেখতে পাবেন, জলবায়ুগত পরিবর্তনের বিষয়টি প্রায় সব জায়গাতেই উপস্থিত। বিদ্যুৎচালিত গাড়ি এবং স্কুটারনির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগ এবং উদ্যোগ বাড়ছে, রেল পরিবহণের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভাবে বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশনের দিকে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে শুরু করেছে, সৌর এবং বায়ুশক্তি উৎপাদক ক্ষেত্রগুলির পুনর্বিন্যাস ঘটানো হচ্ছে, ‘গ্রিন হাইড্রোজেন’ উৎপাদনের লক্ষ্যে সেগুলির ব্যবহার বাড়ছে। এ কথাও মাথায় রাখতে হবে যে, একেবারে প্রথাসিদ্ধ বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও পরিবেশগত ভাবনার প্রয়োগ বেশ নিয়মিত হয়ে পড়েছে। শক্তির ন্যূনতম ব্যবহারের প্রতি তারা সজাগ হয়ে উঠেছে। সেই সঙ্গে নজর দিচ্ছে, যাতে বর্জ্যের পরিমাণ কমে (বর্জ্য পুনর্নবীকরণের দিকে সচেতনতা বাড়ছে)। উপাদান-নিবিড় উৎপাদন থেকে তারা সরে আসছে। সিমেন্ট থেকে ইস্পাত, ভোগ্যপণ্যের প্যাকেজিং, এমনকি, জাহাজে প্রেরণের ক্ষেত্র পর্যন্ত (অনায়াসে জল কেটে সেই জাহাজ যাতে যেতে পারে, তার জন্য আরও মসৃণ রং উৎপাদন)— সমস্ত কিছুই এই পরিবর্তনের অঙ্গ।

মানবিক কার্যকলাপকে কার্বনমুক্ত করার প্রক্রিয়া দাঁড়িয়ে থাকবে ডিজিটাইজেশন, সংযোগ এবং ডেটাবিপ্লব দ্বারা ইতিমধ্যেই প্রস্তুত মঞ্চের উপর। এর ফলে প্রাত্যহিক যোগাযোগ পরিণতি পাবে ভার্চুয়াল বৈঠকে। টেলিমেডিসিন এবং এমনকি (যদিও এর মধ্যে খানিক সন্দেহের গন্ধ থেকেই যায়) শিক্ষা ও সেই সঙ্গে ব্যাঙ্কিংয়ের মতো ক্ষেত্রেরও ক্রমশ ভার্চুয়াল হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া এই কার্বনমুক্ত জীবনযাত্রার সূত্রপাত ঘটিয়ে দিয়েছে। কোভিড অতিমারি এই পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে।

এ সব কিছু থেকে জীবনযাপনের এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। মহানগরের থেকে দূরে এক নতুন এবং অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব এলাকায় উপযুক্ত পরিকাঠামো-সহ গড়ে উঠবে নয়াবসত। দ্রুতগামী আন্তঃশহর ট্রেন পরিষেবা চালু হলে সেখানকার যাপন আরও বেশি স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠতে পারে। চণ্ডীগড় বা জয়পুরের তুলনামূলক ভাবে মন্থর জীবনে যে আরাম পাওয়া যেতে পারে, দরকার পড়লে ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে যে জীবন থেকে দিল্লির মহানাগরিক পরিসরে পৌঁছনো যেতে পারে, সেই জীবনকে কেন মানুষ বেছে নেবেন না? অথবা দিল্লির মতো মহানগরের প্রায় হাতায় অবস্থিত মেরঠে বাস করেও তো একই রকম স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যেতে পারে! সেখান থেকে দিল্লি এক ঘণ্টারও কম সময়ে পৌঁছনো যায়।

সঙ্কট এবং সুযোগ-সুবিধার সহাবস্থান বহু রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিক ভাবে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। শুধু মাত্র সঙ্কট এতখানি পেরে উঠত কি না সন্দেহ! যদিও ইউরোপ এবং অন্যত্র ইউক্রেন সঙ্কট অনেক রাষ্ট্রকেই কার্বন-নির্ভরতায় ফিরতে বাধ্য করেছে, তবু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রায় সব রাষ্ট্রই কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে। ইনসেন্টিভ এবং ভর্তুকি প্রদান করে কাঙ্ক্ষিত ধাঁচের বিনিয়োগকে সম্ভব করে তুলেছে। জানা গিয়েছে যে, রিলায়্যান্স তার গ্রিন এনার্জি প্রকল্পের জন্য গুজরাত সরকারের কাছে কচ্ছে ১৮০০ বর্গ কিমি জায়গা চেয়েছে। প্রার্থিত এলাকাটি দিল্লির চেয়েও সামান্য বড়। শুধু অম্বানী আর আদানি বা টাটাই নয়, ইন্ডিয়ান অয়েল বা ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কর্পোরেশনের মতো সরকারি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান, লারসেন অ্যান্ড টুর্বো, রিনিউ পাওয়ার ইত্যাদিও নতুন সুযোগের সন্ধান করছে এই বিশেষ ক্ষেত্রে। এমনকি, পরিবহণ পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা ‘ওলা’-ও বৈদ্যুতিক স্কুটার তৈরির ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছে। হোম ডেলিভারির ব্যাপক চল খুচরো ব্যবসার ধারণাকেই বদলে দিয়েছে।

এই আপাদমস্তক পরিবর্তনে কিছু শিল্পক্ষেত্র যে সমস্যায় পড়বে, সে কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। পর্যটন ও হোটেল ব্যবসা, অফিস সরঞ্জামের বাজার এর দ্বারা ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভিডিয়ো স্ট্রিমিংয়ের কারণে। বাণিজ্যিক রিয়্যাল এস্টেট সংস্থাগুলি তাদের দফতরের আয়তন কমাচ্ছে অথবা একেবারেই উঠিয়ে দিচ্ছে। সেই সব শূন্যস্থানে শহর থেকে দূরে বাসরত মানুষ সাময়িক ভাবে ঘর ভাড়া নিচ্ছেন। রিয়্যাল এস্টেটের ব্যবসা তার সুযোগ খুঁজে নিচ্ছে শহরের বাইরে। এমনকি, শহরতলিও পার হয়ে নতুন জনবসতি নির্মাণের মাধ্যমে, যেখানে স্বচ্ছল মানুষ তাঁদের নিজস্ব ছন্দে বাঁচতে পারবেন। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, পরিবর্তনের এই খেলায় ভারত অনেক দেরিতে যোগ দিয়েছে। এবং সেই কারণেই সে এক অপরিকল্পিত সুবিধা লাভ করছে। প্রাচীনের খুব কম অংশকেই ধ্বংস করে নতুনের আগমনের পথ প্রশস্ত করার সুবিধা ভোগ করছে ভারত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement