রেণু খাতুন। যাঁর ডান হাত কব্জি থেকে কেটে নিয়েছিলেন তাঁর স্বামী। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আনন্দবাজার অনলাইন যখন আমায় এই লেখাটা লেখার অনুরোধ করল, প্রথমে ভাবলাম, আমি? আমি কেন? তার পর মনে হল, আমিই তো! কারণ, সারা বাংলা তো আমাকে এখন এই পরিচয়েই চেনে! আমিই সেই রেণু খাতুন। যার ডান হাতটা কব্জি থেকে কেটে নিয়েছিল তার স্বামী। এ লেখা তো আমারই লেখা উচিত।
খবরে পড়ছিলাম, বধূ নির্যাতনে আমাদের রাজ্য শীর্ষে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (এনসিআরবি)-র সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক বছরে গার্হস্থ্য হিংসার প্রায় ২০ হাজার (১৯,৯৫২) ঘটনার কথা নথিবদ্ধ হয়েছে এই রাজ্যে। ওই ২০ হাজারের মধ্যে আমিও তো এক জন! ফলে এই লেখা লিখছি। তবে বাঁ-হাতে। কারণ, ছোটবেলা থেকে যে হাতে আমি লিখে অভ্যস্ত ছিলাম, আমার সেই ডান হাত আর কব্জি থেকে নেই। তবু আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব। বধূ নির্যাতনের ‘শিকার’ হয়ে। বধূ নির্যাতনের প্রতিবাদ হয়েও।
আমার স্বামীকে ভালবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কোনও দিন ভাবিনি আমাকে এমন ঘটনার শিকার হতে হবে! ভাবিনি, আমার হাতটা কব্জি থেকে কেটে নেওয়া হবে। আমাকে মানুষ হিসাবে গ্রাহ্যই করা হবে না! নিদেনপক্ষে, প্রাণীও নয়! মেয়ে বলেই এমনটা করতে হবে আমার সঙ্গে? এমন করা যায়!
আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এই লেখাই লিখেছেন রেণু খাতুন। নিজস্ব চিত্র।
প্রথমেই বলব, মেয়েরা হচ্ছে একটা সুন্দর ফুলের মতো। বাবা-মা তাঁদের রাজকুমারীকে অন্যের হাতে তুলে দেন অনেক বিশ্বাস আর ভরসা করে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মূল্য অনেকে রাখতে পারেন না। যে দিন থেকে এই সমাজটাকে বুঝতে শিখেছি, জানতে শিখেছি, সে দিন থেকেই শুনছি, মেয়েদের উপর অত্যাচারের কথা। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে এমনই হচ্ছে। হয়েই যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, আমরা তত আধুনিক হচ্ছি। আর সেই সমস্যার পরিসর দীর্ঘায়িত হয়ে চলেছে। মাঝেমাঝে মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আসে। এ কোন সমাজ? এ কোন সমাজে আমরা বাস করি? দিনের পর দিন বধূ নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে চলেছে। তা হলে আমরা কি শিক্ষা অর্জন করছি? না কি শুধুই সার্টিফিকেট!
গৃহহিংসা কম-বেশি সব বাড়িতেই হয়ে থাকে। সে সবের বেশির ভাগই থানা-পুলিশ অবধি পৌঁছয় না। তার পরেও বছরে এ রাজ্যে প্রায় ২০ হাজার গৃহহিংসার ঘটনার কথা থানায় পৌঁছেছে। আর তাতেই আমাদের রাজ্য শীর্ষে! বেশি অভিযোগ নথিভুক্ত হওয়ার মানে আমি যত দূর বুঝি, এ রাজ্যের মহিলারা তুলনামূলক ভাবে অন্য রাজ্যের মহিলাদের চেয়ে তাঁদের অধিকারবোধ, ন্যায়-অন্যায়ের বোধ সম্পর্কে অনেক বেশি সচেতন। সচেতনতা বেশি হলে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ে। সে ক্ষেত্রে অনেক বেশি দোষীকে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব। আমার যেমন অভিযোগ না করে উপায় ছিল না! আমার হাতটাই কেটে নেওয়া হয়েছিল! বাকি অত্যাচারের কথা এই লেখায় না-ই বা উল্লেখ করলাম!
গত ৪ জুন রাতে কুৎসিত ঘটনাটা ঘটার পর আলোড়ন উঠেছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং আমার পাশে ছিলেন। পুলিশ-প্রশাসন ছিল। যোগ্যতা অনুযায়ী আমার চাকরির ব্যবস্থাও হয়েছে। আমি এখন কাজ করি। মুখ্যমন্ত্রী নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলেন। আমার সেটা শুনতে এবং মানতে ভাল লাগে। নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি পুরুষ-সমাজের মানসিকতার পরিবর্তনও অনেক বেশি জরুরি। তবেই এ সব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হয়তো। একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে যদি আমরা মানবিকতা, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ববোধ গড়ে তুলতে পারি, তা হলে বোধ হয় এই সমাজকে, এই পৃথিবীকে একটা নতুন রূপ দিতে পারব।
গত ৪ জুন রাতের কুৎসিত ঘটনাটা ঘটার পর আলোড়ন উঠেছিল সারা রাজ্যে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
গার্হস্থ্য হিংসার মতো নির্মম, নোংরা কিছু হয় বলে মনে হয় না। আমার ঘৃণা হয়। শুধু মাত্র এই নোংরা মানসিকতার জন্য এই পৃথিবী থেকে হাজার হাজার সুন্দর ফুল ঝরে যাচ্ছে। যাঁরা এই অত্যাচারটা করেন, তাঁদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়— যখন আপনারা কোনও মেয়ের উপর অত্যাচার করেন, তখন কি দেখতে পান না তার অসহায় মুখটা? বাঁচার জন্য কত কাতর আর্জি জানায় সে। জীবনটা ফিরে পেতে চায় সে। কিন্তু মনে হয়, সেই আর্তনাদ শোনার মতো কেউ থাকে না। তাই তাকে চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে হয়। আমাকেও হয়তো হত। শুধু হাতের উপর দিয়ে গিয়েছে!
কিন্তু সেই রাতের পর থেকে আমার ভিতরে এক অন্য অনুভূতি তৈরি হয়েছে। শারীরিক যন্ত্রণা তো রয়েইছে। পাশাপাশি, এখন প্রত্যেক নিপীড়িত, অত্যাচারিত মেয়ের আর্তনাদ আমার কানে ভাসে। চোখের সামনে ছবি দেখতে পাই। অত্যাচারী মানুষগুলোর কাছে আমার প্রশ্ন, এ সব করে কী আনন্দ পান? যে জীবন দান করতে পারেন না, সে জীবন কেড়ে নেওয়ার অধিকার নেই আপনাদের! এ বার মেয়েদের নিজের সম্পত্তি ভাবাটা বন্ধ করুন। সুন্দর ফুলটাকে পা দিয়ে না পিষে ভাল করে সাজিয়ে রাখতে শিখুন। কথাটা বলছি, কারণ বধূ নির্যাতনের মতো নোংরা, কুৎসিত কাজ আসলে নিকৃষ্টতম মানসিকতার পরিচয় দেয়। আমি সেটাই মনে করি।
তবে আনন্দবাজার অনলাইনের জন্য এ লেখা লিখতে গিয়ে হাতে একটা অন্য তেজ অনুভব করছি। দু’হাতেই। আমার যে হাত কেটে নেওয়া হয়েছে, সেই হাতেও। কারণ, ওরা আমার মনটাকে মেরে ফেলতে পারেনি। পারে না। আর সেই মন নিয়েই আমরা গর্জে উঠব বার বার। জানাব দোষীদের শাস্তির দাবি। এক দিন না এক দিন ওদের হারতেই হবে।
একটু ভুল লিখলাম, জেদটা আরও তীব্র করে লিখতে চাইছি, এক দিন না এক দিন ওদের হারাতেই হবে। হারাবই আমরা নারীরা। তবে হাত কেটে নয়। হাতটা ভাল করে ধরতে শিখিয়ে।
(লেখক বধূ নির্যাতনের শিকার, পেশায় সরকারি কর্মী। মতামত নিজস্ব)