How this road initially made for army turned into a book town later on dgtl
College Street
প্রায় দু’শো বছর আগে তৈরি হয়েছিল কলেজ স্ট্রিট, কিন্তু কলেজের জন্য নয়!
সুষ্ঠু শাসনের জন্য উন্নত সড়কব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। কলকাতাকে সাজানোর প্রথম লগ্নেই এ কথা বুঝেছিলেন ব্রিটিশরা। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে ১৭৯৩ অবধি, অর্থাৎ লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্যন্ত কলকাতার রক্ষণাবেক্ষণ ও শান্তিরক্ষার মূল দায়িত্ব ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী বা সিভিল সারভেন্টের উপর। তাঁকে বলা হত কলকাতার জমিদার।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১১:১৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৫
সুষ্ঠু শাসনের জন্য উন্নত সড়কব্যবস্থা অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। কলকাতাকে সাজানোর প্রথম লগ্নেই এ কথা বুঝেছিলেন ব্রিটিশরা। অষ্টাদশ শতকের শুরু থেকে ১৭৯৩ অবধি, অর্থাৎ লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পর্যন্ত কলকাতার রক্ষণাবেক্ষণ ও শান্তিরক্ষার মূল দায়িত্ব ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক কর্মচারী বা সিভিল সারভেন্টের উপর। তাঁকে বলা হত কলকাতার জমিদার।
০২১৫
কিন্তু এই রাজকর্মচারীর কাজে সন্তুষ্ট ছিল না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে নতুন আইন জারি হয়। সেই আইন অনুযায়ী কলকাতার জমিদারের কাছ থেকে সব ক্ষমতা নিয়ে নেওয়া হয়। পরিবর্তে তৈরি হয় নতুন পদ ‘জাস্টিসেস অব পিস’। তাঁকেই সব ক্ষমতা দেওয়া হয়। তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল কলকাতার সড়কব্যবস্থার উন্নয়ন।
০৩১৫
অষ্টাদশ শতকের শেষ লগ্নে ফোর্ট উইলিয়ামের জেনারেল হন লর্ড ওয়েলেসলি। তিনি যুদ্ধ বিগ্রহ সামলে মন দেন কলকাতার উন্নয়নে। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি হয় ‘লটারি কমিটি’। ওয়েলেসলির উদ্যোগে এরপরে ১৮০৬-১৮৩৬, এই সময়সীমার মধ্যে কলকাতা জুড়ে তৈরি হয় আর্টেরিয়াল সড়ক। সেই পর্বেই নির্মিত হয় আজকের কলেজ স্ট্রিট।
০৪১৫
প্রথমে কিন্তু এই সড়কের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক ছিল না। বরং শাসকদের দৃষ্টি ছিল, কী ভাবে তৎকালীন ব্যারাকপুর ও দমদম সেনাছাউনির সঙ্গে ফোর্ট উইলিয়ামের যোগাযোগকে সুষ্ঠু ও দ্রুত করা যায়। সৈন্য ও রসদের যোগানে যাতে কোনও সমস্যা না থাকে, সেই বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।
০৫১৫
আজকের কলেজ স্ট্রিট দিয়েও সে সময় সামরিক বাহিনী নিয়মিত যাতায়াত করত। কিন্তু ক্রমে এই রাজপথের মূল পরিচয় হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই। সেই পরিচয়ের মূলে রয়েছে হিন্দু কলেজ, আজকের প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ এর আগেই এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ‘সংস্কৃত কলেজ’। কিন্তু রাস্তার নামের সঙ্গে ‘কলেজ’ শব্দটি জুড়ে যায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই।
০৬১৫
তবে হিন্দু কলেজের গোড়াপত্তন কিন্তু এই রাজপথে নয়। শোভাবাজার রাজপরিবারের তৎকালীন কর্তা রাধাকান্ত দেব এবং ব্রিটিশ শিক্ষাবর্তী ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি শুরু হয় হিন্দু কলেজ। দেব পরিবাবের অন্যান্য সদস্যদের পাশাপাশি রাজা রামমোহন রায়ও ছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত।
০৭১৫
মাত্র ২০ জন ছাত্রকে নিয়ে প্রথম ক্লাস শুরু হয়েছিল গরানহাটায় (আজকের চিৎপুর) গৌরচাঁদ বসাকের বাড়িতে। মূলত হিন্দু পরিবারের ছাত্রদের জন্য হলেও প্রতিষ্ঠানের দরজা খোলা ছিল অহিন্দুদের জন্যেও। গৌরচাঁদ বসাকের বাড়িতে ঘরভাড়া করে কয়েক দিন এর পঠনপাঠন চলেছিল।
০৮১৫
এরপর চিৎপুরের আর একটি ঠিকানায় ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয় কলেজ। তারপর বউবাজারের একটি ঠিকানা ঘুরে হিন্দু কলেজ এসে পৌঁছয় আজকের কলেজ স্ট্রিটে। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে এর পঠনপাঠন হতে থাকে সংস্কৃত কলেজে। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের ভবন যা দেখি, তা তৈরি হয়েছিল ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে।
০৯১৫
হিন্দু কলেজ নতুন ঠিকানায় আসার সঙ্গে দ্রুত বদলে গেল জায়গাটির চালচিত্র। ঠনঠনিয়া থেকে এলাকার পরিচিতি হয়ে দাঁড়াল কলেজপাড়া। আরও পরে, রাস্তার নাম হল কলেজ স্ট্রিট। স্বভাবতই এখানে পড়ুয়া সমাগম বৃদ্ধি পেল। বাড়ল বইয়ের চাহিদাও।
১০১৫
তখনও এখানে ফুটপাত তৈরি হয়নি। রাস্তার ধারে চট বিছিয়ে পুরনো বই বিক্রি করতে বসতেন বিক্রেতারা। কাঙ্খিত বইয়ের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতেন ক্রেতারা। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তাঁরা বই পড়তেন। সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে।
১১১৫
কিন্তু সে সব বই ছিল ইংরেজিতে। শিক্ষামূলক বাংলা বই বলতে তখন কিছু ছিলই না। সেই অভাব ও প্রয়োজন বুঝতে পেরে সমাধানে অবতীর্ণ হলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। ১৮৪৬-এর শেষে বা ১৮৪৭-এর শুরুতে তিনি শুরু করলেন তাঁর বইয়ের দোকান ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’। হিন্দু কলেজ, সংস্কৃত কলেজের কাছেই ছিল তাঁর দোকান। পরে মদনমোহন তর্কালঙ্কারও শুরু করেছিলেন বইয়ের ব্যবসা।
১২১৫
তার আগেই ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ক্যালকাটা স্কুলবুক সোসাইটি। হিন্দু কলেজের কাছেই ছিল তাদের ছাপাখানা। ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে তারা বইয়ের ব্যবসা শুরু করে। সে সময় ইংরেজি বইয়ের ব্যবসায় তারাই ছিল অগ্রণী। তবে জনপ্রিয়তা ও চাহিদায় এদের পরেই ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সংস্থার প্রকাশিত বই। ক্রমে কলেজ স্ট্রিটে বিস্তৃত হয় বইয়ের ব্যবসা। এই এলাকার আদি বই-ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন গিরীন্দ্রনাথ মিত্র এবং উপেন্দ্রনাথ ধর।
১৩১৫
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও এবং তাঁর অনুগামীদের ‘ইয়ং বেঙ্গল’ সোসাইটির আন্দোলনের আঁতুড়ঘর ছিল সেকালের হিন্দু কলেজ এবং কলেজ স্ট্রিট। পরবর্তী কালেও বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে এই রাজপথ।
১৪১৫
কলকাতা জুড়ে সড়কপথের বিস্তারকে সমাজবিজ্ঞানী ও গবেষকরা কল্যাণমূলক বলতে নারাজ। তাঁদের মতে, এই উন্নয়ন নিছক সাধারণ মানুষের জন্য ছিল না। বরং, এই রাজপথ নির্মাণের জন্য বাদ পড়েছিল কৃষিজমি। পুনর্বাসনের ফলে নির্বাসিত হয়েছিলেন সাধারণ মানুষ। তবে নগরায়নের জন্য নতুন নতুন জীবিকার সৃষ্টিও হয়েছিল।
১৫১৫
কৃষকশ্রেণি কলকাতা ছেড়ে প্রান্তবাসী হলেন। পরিবর্তে শহরে ভিড় করলেন কুলি, মজুর, গৃহস্থের ভৃত্য, কারিগর, পাল্কি বেহারা, গাড়োয়ানের মতো নাগরিক কাজভিত্তিক কর্মীরা। তাঁদের থাকার জন্য ধীরে ধীরে জন্মাতে লাগল বস্তিবাড়ি। সেইসঙ্গে সমাজের অন্যপ্রান্তে জন্ম নিল মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও স্বল্প বেতনের কারিগর শ্রেণি।(ঋণস্বীকার: ১. কলিকাতার রাজপথ সমাজে ও সংস্কৃতিতে: অজিতকুমার বসু, ২. কলিকাতা দর্পণ: রাধারমণ মিত্র, ৩. এ হিস্ট্রি অব ক্যালকাটাজ স্ট্রিটস: পি থঙ্কপ্পন নায়ার, ৪. টেন ওয়াকস ইন ক্যালকাটা: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত, ৫. এ জে ওয়াকার্স গাইড টু ক্যালকাটা: সৌমিত্র দাস)