টাটকা ইলিশের গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তা সামান্য ডেবে গিয়ে, আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে
কলকাতায় এখন এই মাঘের বাজারেও কিন্তু রমরম করে ইলিশমাছ বিক্রি হচ্ছে। দক্ষিণের করুণাময়ী বাজার, বাঁশদ্রোণী বাজার, উত্তরের বেলেঘাটা জোড়ামন্দির বাজার, যেখানে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় একসময় লুঙ্গি-ফতুয়া পরে থলে হাতে বাজার করতে যেতেন— আমার এই কথার সাক্ষ্য দেবে। সবাই যতই বলুক, বিজয়া দশমীর পর ইলিশমাছ খেতে নেই আর সরস্বতী পুজোর আগে ইলিশ মাছ ছুঁতে নেই, কে শোনে কার কথা! একটু চোখ-কান খোলা রাখলে এইসময় মাছবাজারের খাঁজেখোঁজে ঝুড়ি ভর্তি খোকাইলিশের দেখাও পাওয়া যাবে। তবে এটা কিন্তু নির্জলা সত্যি, অসময়ের যুবতী ইলিশ মানে তা নিরানব্বই শতাংশ হিমঘরের। তাদের গায়ে কখনওই কিন্তু টাটকা ইলিশের রুপো গলানো জেল্লা থাকবে না। সবটা কেমন যেন ফ্যাকাসে ম্যাড়মেড়ে মনে হবে। আর গায়ে হালকা হলদেটে আভা এলে তো সেই মাছ বহু দিনের বাসি।
টাটকা ইলিশের গায়ে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তা সামান্য ডেবে গিয়ে, আবার আগের জায়গায় ফিরে আসবে। চাপ দিলে তা যদি একটুও না ডেবে যায়, তবে সেই মাছ বরফের। আর ডেবে গিয়ে টোল পড়ে গেলে তা অনেক দিনের পুরনো।
টাটকা ইলিশের চোখ চকচকে এবং তাতে লালচে ছোপ থাকে। বরফের মাছের চোখ ঘোলাটে সাদা। বহুদিনের বাসি হলে তা মনখারাপের মতো ধূসর। তাজা মাছের শরীর থেকে কোনও আঁশটে গন্ধ পাওয়া যায় না। তাতে নদীর জলের গন্ধ আর হাওয়ার গন্ধ লেগে থাকে। সমুদ্র ঘেঁষা খাঁড়ি বা মোহনা থেকে পাওয়া ইলিশের গায়ে থাকে সমুদ্রের নোনতা গন্ধ, যা মোটেই আঁশটে নয়। আঁশটে গন্ধ পাওয়া গেলে মাছটি নির্ঘাত বাসি।
সত্যবতীর গল্প আপনারা নিশ্চয়ই সবাই শুনেছেন! সত্যবতী মহাভারতের গোড়ার দিকের একটি চরিত্র। ভীষ্মর বাবা, রাজা শান্তনুর দ্বিতীয়া স্ত্রী হিসেবে তাঁকে সবাই জানেন। চেনেন চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য, কুরুবংশের এই দুই রাজার মা হিসেবে। কিন্তু এর বাইরেও সত্যবতীর একটা নিজস্ব পরিচয় আছে। তাঁর জন্ম হয়েছিল অদ্রিকা নামের এক মাছের পেটে, যে ছিল শাপগ্রস্ত অপ্সরা। সত্যবতীর পালক-পিতা ছিলেন ধীবরদের রাজা দাশ। মাছের পেটে জন্ম বলেই হয়তো সত্যবতীর গায়ে ছিল তীব্র আঁশটে গন্ধ। কেউ তাঁর কাছে ঘেঁষত না। এই কারণে তাঁর আর এক নাম ছিল মৎস্যগন্ধা। তিনি দাশরাজের কথা মতো যমুনা নদীতে পাকা জেলেনির মতো মাছ ধরতেন, সঙ্গে খেয়া পারাপারের কাজও করতেন।
এক বার সত্যবতীর কাছে খেয়া পারাপারের জন্য এলেন পরাশরমুনি। তিনি সত্যবতীর রূপে হাবুডুবু খেয়ে একশা। পরাশর নৌকায় উঠেই সত্যবতীর কাছ থেকে সরাসরি একটি বংশধর পুত্র কামনা করেছিলেন এবং তা পেয়েওছিলেন। আর সেই পুত্রই হলেন ব্যাসদেব। যদিও প্রাথমিক ভাবে পরাশরমুনিকে এড়াবার জন্যে সত্যবতী নিজের গায়ের আঁশটে গন্ধের কথা তাঁকে বলেছিলেন। কিন্তু তাতে বিশেষ সুবিধে হয়নি। প্রেম চোপরার মতো একটি মিচকে হাসি হেসে পরাশর এক ফুঁয়ে (পড়ুন বরে) সত্যবতীর দেহ চিরসুগন্ধময় করে দিয়েছিলেন। আর সে গন্ধ ছিল এমনই যার সৌরভ নাকি এক যোজন দূর থেকেও পাওয়া যেত।
প্রিয় পাঠক, আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন, অসময়ের বাজারে বাসি ইলিশের গায়ের আঁশটে গন্ধের কথা বলতে বলতে আমি খামোখা মহাভারতের মধ্যে ঢুকে পড়লাম কেন! এর কারণ হল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যবতী হয়তো বাস্তবের কোনও মানুষী ছিলেন না। ছিলেন একটি গোলগাল বড়সড় যুবতী ইলিশ মাছ, যাকে মুনি পরাশর নিজের হাতে টুকরো টুকরো করে অর্থাৎ ‘ব্যাস’ বরাবর বিভাজিত করে রান্না করেছিলেন। আর যে ভাবে আমাদের স্থানীয় বাজারে ওঠা অকালের যুবতী ইলিশেরা প্রথমে মৎস্যগন্ধা থাকে এবং পরে গেরস্তর হেঁসেলে ঢুকে সর্ষেবাটা, পোস্তবাটা, তেল, কাঁচালঙ্কা, নুন— এমন নানান মশলাপাতির সংস্পর্শে এসে রান্না করার সময় যোজনগন্ধায় পরিণত হয়, ইলিশ মহীষী সত্যবতীর ক্ষেত্রেও তার বাইরে কিছু ঘটেনি। তাই রান্নার সময় কড়াই স্বরূপ নৌকোয়, সত্যবতী নাম্নী ইলিশটি যখন পরাশর নামক রাঁধুনিটির সংস্পর্শে এসেছিল, তার ঠিক আগে উনুনের যে গলগলে ধোঁয়ায় চারিদিক ভরে উঠেছিল, তাকেই যত্ন করে রাজশেখর বসু লিখেছিলেন, ‘পরাশর তখন কুজ্ঝটিকা সৃষ্টি করলেন, সর্বদিক তমসাচ্ছন্ন হ’ল।’
কার্টুন: দেবাশীষ দেব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy