তবু অনন্ত জাগে... ইউক্রেনের রাজধানী কিভ জুড়ে অব্যাহত রুশ বাহিনীর হানা। ধ্বংসলীলার মধ্যেই শনিবার আশ্রয় শিবিরে জন্ম হল এই শিশুকন্যার। পিটিআই
দক্ষিণ-পশ্চিম কিভের আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক নিষ্প্রাণ বহুতল। তার পেট থেকে এক খাবলা অংশ কেটে ফেলে দিয়েছে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র। পরিত্যক্ত আবাসন, জনমানুষ নেই তাতে। তাই প্রাণহানি ঘটেনি। তবে আশপাশে থাকা কিছু লোক জখম হয়েছেন। ইউক্রেনের রাজধানী কিভ-জুড়ে এমন দৃশ্য অহরহ। রাশিয়ার দাবি, তারা বসতি এলাকায় হামলা করছে না। তবে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা ছবিতেই স্পষ্ট, সে দাবি কত বড় মিথ্যে! রাজধানী দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রুশ বাহিনী। কাল সারা রাত বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপেছে কিভ। সরাসরি যুদ্ধ চলেছে শহরের রাস্তায়। ইউক্রেন সরকার জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ১৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে রুশ হানায়। আহত হাজারেরও বেশি। রাশিয়া এখনও পর্যন্ত তাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা কিছু ঘোষণা করেনি।
যুদ্ধ আজ তৃতীয় দিনে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন, কিভ এখনও তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। অস্ত্র হাতে নিজে পথে নেমেছেন প্রেসিডেন্ট। গত কাল থেকেই সেনাবাহিনীর সঙ্গে কালাশনিকভ হাতে দেখা গিয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট পেত্রো পোরোশেঙ্কাকে। সাধারণ মানুষের হাতেও তুলে দেওয়া হচ্ছে আগ্নেয়াস্ত্র। পরিবারের প্রবীণ সদস্য, নারী ও শিশুদের নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে যুদ্ধে নামছেন যুবকেরা। এ পর্যন্ত কোনও দেশ ইউক্রেনের হয়ে লড়তে সেনা-সাহায্য পাঠায়নি। আমেরিকা আজ উদ্ধারকাজে সাহায্যের প্রস্তুাব দিয়েছিল।
খোদ প্রেসিডেন্ট জ়েলেনস্কিকে নিরাপদ আশ্রয়ে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল বলে শোনা গিয়েছে। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছেন তিনি। তাঁর ঘনিষ্ঠ এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিয়েছেন, যুদ্ধ এখানে চলছে। আমাদের যুদ্ধাস্ত্র চাই। গাড়ি লাগবে না।’’
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ ঘোষণা করার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গত কাল কিভে ঢুকে পড়েছিল তাঁদের সেনা। আজ ক্রমশ রাজধানীকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে তারা। আকাশপথে লাগাতার হামলা চালানো হচ্ছে শহর জুড়ে। ইউক্রেনের বিভিন্ন প্রান্তে সেনাছাউনিগুলোও তাদের লক্ষ্য। ইউক্রেনের আর্মি ফেসবুকে পোস্ট করে আজ জানিয়েছে, রাজধানীর মূল সড়কে হামলা চালাচ্ছিল রাশিয়া। তারা তা সমূলে প্রতিহত করেছে। শোনা যাচ্ছে, এর পরেও ছোট ছোট দল তৈরি করে রুশ সেনা এগনোর চেষ্টা করছে। ব্রিটেনের একটি সূত্র অবশ্য জানিয়েছে, রাশিয়া যা-ই দাবি করুক, রাজধানীর মূল অংশ থেকে তারা এখনও বহু দূরে। কার্ফুর সময় আজ আরও বাড়ালেন কিভের মেয়র ভিতালি ক্লিতসকো। কাল রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কার্ফু জারি ছিল। আজ তার সময় বাড়িয়ে করা হয়েছে, বিকেল ৫টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা। ক্লিতসকো বলেন, ‘‘কার্ফু চলাকালীন কোনও সাধারণ মানুষ রাস্তায় থাকবেন না। ওই সময়ে কাউকে যদি রাস্তায় দেখা যায়, ধরে নেওয়া হবে তিনি শত্রুদের হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।’’ মেয়র ক্লিতসকো ও তাঁর ভাই, দু’জনেই দেশের বিখ্যাত বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। দেশবাসীর উদ্দেশে একটি ভিডিয়া বার্তায় তাঁরা বলেছেন, ‘‘এই যুদ্ধে কেউ জিতবে না। সবাই শুধু হারাবে। সাহসী হন। দেশের সকল বাসিন্দাকে বলছি, রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের একজোটে লড়তে হবে। যত ক্ষণ আমরা এক সঙ্গে থাকব, তত ক্ষণ আমরা শক্তিশালী।’’ ইতিমধ্যেই এ দেশে হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া। রুশ হামলার ভয়ে অন্তত ১ লক্ষ ২০ হাজার বাসিন্দা দেশ ছেড়ে পোল্যান্ড, মলডোভা ও অন্যান্য পড়শি দেশগুলোয় পালিয়ে গিয়েছেন। রাষ্ট্রপুঞ্জের আশঙ্কা, যুদ্ধ যদি এ ভাবে চলতে থাকে, তা হলে অন্তত ৪০ লক্ষ মানুষ আশ্রয়হীন হবেন।
ইউক্রেন থেকে হাঙ্গেরির সীমান্ত শহর জ়াহোনিতে পালিয়ে আসা শরণার্থীরা জানিয়েছেন, অনেকেই পালাতে চান। কিন্তু যাঁদের যুদ্ধে লড়ার মতো বয়স রয়েছে, তাঁদের দেশ ছেড়ে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। ভিলমা সুগার নামে ৬৮ বছর বয়সি এক প্রবীণ বলেন, ‘‘আমার ছেলেকে আসতে দেওয়া হয়নি। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে আমার। শান্ত থাকতে পারছি না। ওকে ওরা আসতে দিল না।’’ যাঁরা পালাতে পারেননি, তাঁরা বাড়ির নীচে বেসমেন্টে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকের বাড়িতে সেই ব্যবস্থা নেই। তাঁরা রয়েছেন সাবওয়ে স্টেশন, মাটির নীচে পার্কিং লটে। রাশিয়া মুখে অস্বীকার করলেও, স্কুল, বসতি এলাকা, রাস্তা, সেতুতে হামলা চালাচ্ছে তাদের বাহিনী। ইউক্রেনের কতটা অংশ আদৌও সে দেশের সরকারের হাতে রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রক দাবি করেছে, ইউক্রেনের দক্ষিণের শহর মেলিটোপোল পুরোপুরি ভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। সেই সঙ্গে দেশের পূর্ব দিকে ডনবাস এলাকার দখল নিয়েছে রুশ-সমর্থনপ্রাপ্ত বিদ্রোহীরা। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশের দাবি, ইউক্রেন সরকারকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর পুতিন। তিনি সেটাই করবেন এবং যে কোনও উপায়ে ইউক্রেনকে নিজের সাম্রাজ্যে জুড়বেন। নতুন করে তৈরি হবে ইউরোপের মানচিত্র। জ়েলেনস্কি অবশ্য আজও স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর সেনাবাহিনী যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালাবে না। রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। কিভের রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি ভিডিয়ো বার্তায় জানান, তিনি এই শহরে আছেন। যারা বলছে, ইউক্রেনের সেনা অস্ত্র নামিয়ে রেখেছে, তারা ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘আমরা অস্ত্র নামিয়ে রাখব না। দেশকে রক্ষা করব। আমাদের অস্ত্র সত্যি এবং আমাদের সত্য আমাদের জমি, আমাদের দেশ, আমাদের সন্তানেরা। আমরা সবাইকে রক্ষা করব।’’
পুতিন গত কাল বলেছিলেন, ইউক্রেন অস্ত্র নামিয়ে রাখলে তিনি আলোচনায় বসতে রাজি। জ়েলেনস্কি আজ জানিয়েছেন, গ্রহণযোগ্য নয় এমন শর্ত মানতে তাঁরা রাজি নন। তবে আলোচনায় বসতে তাঁদের আপত্তি নেই। এমনকি শুক্রবারই জ়েলেনস্কি জানিয়েছেন, নেটোয় যোগ দেওয়ায় যাবতীয় পরিকল্পনা বাতিল করছেন এবং ভবিষ্যতে নিরপেক্ষ অবস্থান নেবেন। তুরস্ক এবং আজ়েরবাইজান রাশিয়ার সঙ্গে যে শান্তি আলোচনা করতে চেয়েছে, তাকেও স্বাগত জানিয়েছেন জ়েলেনস্কি। কিন্তু দু’পক্ষের এ ধরনের প্রস্তাব-বিনিময়েও যুদ্ধ থামার লক্ষণ দেখা যায়নি। রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে আজ প্রায় সকলেই রাশিয়ার বিরোধিতা করেছে। সে সব ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে রুশ নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ জানিয়েছেন, তাঁদের উপরে নিষেধাজ্ঞা চাপানো হলে, তারাও পাল্টা আঘাত করবেন। পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কই ছেদ করে দেবেন। মেদভেদেভ বলেন, ‘‘আমাদের তো তেমন নির্দিষ্ট কোনও প্রয়োজন নেই কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার। বরং যুদ্ধক্ষেত্রে ও দূরবীনে একে অপরকে দেখব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy