Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
US Presidential Election

হার-জিতের ব্যবধান হতে পারে সবচেয়ে কম, ফলাফল নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে

গভীর রাতে টুইট করে ট্রাম্পের অভিযোগ, সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ভোট দিচ্ছেন অনেক জায়গায়।

সমানে সমানে হোয়াইট হাউস দখলের লড়াই। —ফাইল চিত্র

সমানে সমানে হোয়াইট হাউস দখলের লড়াই। —ফাইল চিত্র

শুভময় মৈত্র
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০২০ ১৩:৩১
Share: Save:

মার্কিন দেশে বেলা গড়াচ্ছে। কিন্তু এখনও থিতু হয় নি ভোটফল। ভারতে বৃহস্পতিবার সকালে হয়তো জানা যাবে কি হল, অর্থাৎ আমেরিকায় চৌঠা নভেম্বর রাতে। তবে ফলাফল বেরোলেও সমস্যা হয়তো সহজে মিটবে না। পুনর্গণনার দাবি উঠবে, লড়াই চলতে পারে আদালতেও। সমীক্ষা বলেছিল ভোট শতাংশে জো বাইডেন এগিয়ে থাকবেন। সেখানে বিশেষ ভুল নেই। প্রায় সবসময়েই এগিয়ে থেকেছেন বাইডেন, এবং ভারতীয় সময় বৃহস্পতিবার কাকভোর কিংবা রাত একটায় তিনি আগের এক কিংবা দেড় শতাংশের ব্যবধান বাড়িয়ে আপাতত দু শতাংশ ভোটে এগিয়ে। তবে সমীক্ষায় যে বেশ অনেকটা ব্যবধানের কথা বলা হয়েছিল অক্টোবর মাসে, তেমন কিন্তু আদৌ ঘটে নি। আর এখানে মনে রাখতেই হবে যে যে কোনও নির্বাচনেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হলে ভোট শতাংশ আর আসনের সম্পর্ক একেবারে গুলিয়ে যায়।

অর্থাৎ দেশ জুড়ে ভোট শতাংশে অনেক এগিয়ে থাকলেও লাভ নেই, বরং কম ব্যবধানে এক একটি রাজ্য জিতে নিয়ে সেখানকার সব আসন বগলদাবা করাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখনও পুরো বিষয়টা পরিষ্কার না হলেও যে কটি রাজ্যে আসন বেশি এবং লড়াই হাড্ডাহাড্ডি সেটা বুঝতে কোন অসুবিধে নেই। আপাতত রাজ্যগুলো হল জর্জিয়া (১৬), মিশিগান (১৬), নেভাদা (৬), নর্থ ক্যারোলিনা (১৫) আর পেনসিলভেনিয়া (২০)। এগুলো বাদে বাইডেন এগিয়ে ২৪৮ আর ট্রাম্প এখনও ২১৪ তেই আটকে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে এখনও সঠিক ফল জানতে বেশ কিছুটা সময় বাকি। তবে ভীষণ লড়াই চলা রাজ্যগুলোর দিকে তাকিয়ে বাইডেন যে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা বেশি সেকথা বলতেই হচ্ছে। এই সময়টাতে সামনের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের জেতার আশা কম। বিশেষ করে আরিজোয়ানার ১১ আর উইসকনসিনের ১০ টা আসন চলে যাওয়ায় বাইডেনের সম্ভাবনা সত্যিই অনেকটা বেড়েছে। এই প্রসঙ্গে এই সময়ে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্কটা কষে ফেলা যাক। এই ভবিষ্যৎবাণী সত্যি হলে তা হবে তত্ত্বের হিসেবে সবথেকে কম ব্যবধানে জেতা-হারার ফলাফল। মিশিগানের ১৬ আর নেভাডার ৬ মিলে হয় ২২। এই দুই রাজ্যে ভালোই এগোচ্ছেন বাইডেন। ২৪৮ এর সঙ্গে ২২ যোগ করুন, পাবেন ২৭০। বাকি সব আসন ট্রাম্প সাহেব পেয়ে গেলেও পৌঁছবেন ২৬৮-তে। অর্থাৎ ফলাফল দাঁড়াবে বাইডেন ২৭০ বনাম ট্রাম্প ২৬৮। শুধু মার্কিন দেশ কেন? সম্ভবত বিশ্ব ইতিহাসে এমন কান ঘেঁষা ফল কখনো দেখা যায় নি।

আমেরিকায় বেশ কিছু রাজ্য আছে যেখানে ভোট না হলেও চলে। তারা সব সময়েই হয় রিপাবলিকান অথবা ডেমোক্র্যাটদের দিকে ঝুঁকে আছেন। তাঁদের নিয়ে আলোচনা কম। অন্য দিকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সেইসব রাজ্য, যেখানে সামান্য শতাংশের ব্যবধানে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এগুলিই সুইং স্টেট। দোদুল্যমানতার শেষে এঁরা কোন দিকে ঘেঁষবেন তার ওপরই নির্ভর করবে সামগ্রিক ভোটের ফল। মনে রাখতে হবে, বেশি ভোট পেলেই কিন্তু আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হওয়া যায় না। তা হলে গতবার হিলারি ক্লিনটনই কুর্সিতে বসতেন। কিন্তু সিকি কোটির বেশি ভোট পেয়েও (যা নাকি ২ শতাংশের বেশি) তিনি হারেন আসনের হিসেবে। এ বারেও সেই একই কথা। সেই কারণেই সমীক্ষা বলেছিল দু’শতাংশের মত ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও তিনি একেবারেই নিশ্চিন্ত নন। কারণ কম ভোট পেয়েও হিসেব করে কয়েকটি রাজ্যে জিতে গেলেই রিপাবলিকানদের পোয়া বারো। সেই হিসেবে নাকি তিন-চার শতাংশ ভোটে বাইডেন এগিয়ে থাকলেও আসনের হিসেবে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। আর মতদানের হিসেবে ৫ শতাংশের মতো বেশি থাকলে তবেই নিশ্চিত হতে পারতেন বাইডেন। তেমনটা এখনও হচ্ছে না। সেই সঙ্গে খবর পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিচ্ছু রাজ্যে ভোট গণনা নিয়ে যথেষ্ট অশান্তি হবে। ভোটের সম্পূর্ণ ফলাফল আসতে কয়েকদিন লেগে যেতে পারে এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

বিষয়টা যে বেশ জটিল, সেটা বোঝা যাচ্ছে। কারণ গণনা শুরুর দিনের রাত বারোটা পার হলেও জেগে ছিল দুই যুযুধান পক্ষ। এই পর্যায়েই মাঝরাতে বক্তব্য রেখেছেন বাইডেন। দাবি করছেন, তিনিই জিতবেন। আবার গভীর রাতে টুইট করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ, সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ভোট দিচ্ছেন অনেক জায়গায়। একে তিনি বলছেন ‘ভোট চুরি’। পাশাপাশি সেই মাঝরাতেই ট্রাম্পও ঘোষণা করেছেন তিনিই জিতছেন। একইসঙ্গে অবশ্য গণনা বন্ধের দাবিতে আদালতে যাওয়ার হুমকিও ফের দিয়েছেন তিনি।

কোভিডের হানায় বাকি বিশ্বের মতই আমেরিকাও নাজেহাল। বেকারত্ব আকাশ ছুঁচ্ছে। কালো মানুষের প্রতি অবিচারে ফুঁসছে বড় অংশের মানুষ। মার্চ এপ্রিলে সাধারণ করদাতাদের কাছে কিছু ডলার পৌঁছলেও, তারপর থেকে কিন্তু খুব বেশি কিছু ভাবতে পারেননি ট্রাম্প সাহেব। ভোটের আগে জনগণের কাছে কোভিড প্রতিষেধক পৌঁছে দিতে পারলে হয়তো অনেকটা ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা ছিল বর্তমান প্রেসিডেন্টের। তেমনটাও ঘটেনি। ফলে সোজা ভাবনায় ট্রাম্পের হেরে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সমীক্ষাও তাই বলছিল গত দু’মাস ধরে। কিন্তু একেবারে শেষের দিকে কোলাকুলি সেয়ানে সেয়ানে। মনে রাখতে হবে, বিপুল সংখ্যক মানুষ ভোট দিয়েছেন এই নির্বাচনে। যা অনেক সময়েই ক্ষমতা বদলের লক্ষণ। তবে হেরে গেলে নির্বাচনী ফলাফল না মেনে নেওয়ার যে রেওয়াজ, তা সাধারণত পিছিয়ে থাকা দেশগুলোর। এবার সেই ছোঁয়াচ মার্কিন দেশেও লেগেছে। এতটাই বিভাজনের রাজনীতি ঢুকে পড়েছে সে দেশে যে ট্রাম্প হেরে গেলে নাকি হোয়াইট হাউস না ছেড়ে আইনি লড়াইতে নামবেন। বাইডেনও তেমনটাই বলছেন। যাই হোক, সে সব রাজনীতির ভবিষ্যৎ। আপাতত খেলা শুধু সংখ্যার।

চলছে ভোটগণনা। ছবি: রয়টার্স

আরও পড়ুন: লাইভ: হোয়াইট হাউসের দৌড়ে সমানে টক্কর বাইডেন-ট্রাম্পের

এই ফুরসতে ভোট শুরু হওয়ার সময়টায় একটু ফিরে তাকানো যাক। নভেম্বর তিন, মার্কিন দেশে শুভ ভোটদিন। শীতকাল, সূর্য উঠতে দেরি হয় আমেরিকায়। তাই দিন শুরু হয় ঘন্টাখানেক পরে। পয়লা নভেম্বর মাঝরাতে ঘড়ির কাঁটা যখন দুটো ছুঁইছুঁই, তখন তাকে পিছিয়ে একটা করে দেওয়াটাই ডে-লাইট সেভিং। আর প্রতি ৪ বছর অন্তর তার পরেই প্রথম সোম পার করে যে মঙ্গলের ঊষা, সেখানেই বুথে গিয়ে ভোট দেওয়া শুরু। তবে দেশটা ভৌগোলিক ভাবে অনেক বড়। তাই ভারতের মত একটাই সময় নয়, বরং বিভিন্ন টাইম জোন। পূর্ব উপকূলে অতলান্তিক থেকে সূর্য ওঠা শুরু, আর অনেকটা পরে গিয়ে তা আলো দেবে প্রশান্ত মহাসাগরকে। প্রত্যন্ত প্রান্ত ধরলে শুধু মার্কিন দেশের পূর্ব পশ্চিমেই সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টা। এত কথা বলার কারণ, আমাদের কলকাতায় যখন হেমন্তের বিকেল, তখন মার্কিন দেশে বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, আবার বেড়েছে কোভিড। দিন কয়েক আগেই বিভিন্ন সমীক্ষায় বাইডেনের পক্ষে দেশজোড়া জনমত ট্রাম্পের থেকে ৯ শতাংশ বেশি থাকলেও শেষ দিকে হাওয়া ঘুরেছে চটজলদি। সেপ্টেম্বর থেকে ক্রমাগত পিছোতে থাকলেও একেবারে শেষ মুহূর্তে ট্রাম্প লড়াইয়ের ময়দানে ফিরেছেন দারুণ ভাবে।

আবেগ-উচ্ছ্বাসে রাস্তায় বাইডেন সমর্থরা। ছবি: রয়টার্স

আরও পড়ুন: আবার অঘটন? চিন্তা বাইডেনের

তার মধ্যেও প্রথম বিশ্বে তেসরা নভেম্বর ভোর ছ’টাতেই শেষ দিনের ভোটের তোড়জোড় শুরু। শেষ দিনের ভোট, কারণ আমেরিকাতে আগের থেকেই ভোট দিয়ে দেওয়া যায়। আর আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে এবার নির্বাচন শুরু হওয়ার আগেই ভোট পড়ে গেছে ১০ কোটির বেশি। গতবারের আগে কাজ সেরে ফেলা জনমতের থেকে দ্বিগুণ। মনে রাখতে হবে ২০১৬-তে সব মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ১৩ কোটি ৬৬ লক্ষের কিছু বেশি। বোঝাই যাচ্ছে কোভিড পরিস্থিতিতে এ বার বুথে গিয়ে ভোট দিতে চাননি বেশ কিছু মানুষ। তবে শেষ দিন বুথেও ভিড় হয়েছে যথেষ্ট। সব মিলিয়ে যা খবর তাতে গত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বার ভোটদানের হার আগের সব রেকর্ড ভেঙে দেবে।

আশা-নিরাশার দোলাচলে ট্রাম্প অনুগামীরাও। ছবি: রয়টার্স

এখন যা পরিস্থিতি তাতে ট্রাম্প হয়তো হারতে চলেছেন। তবে তাতেই বা কি? চিন বা রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়কদের মতোই হার-জিত ভুলে বসে থাকতেই পারেন সাদা বাড়ির দরজায় ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে। সেই জন্যেই তো বারবার কোর্টে যাওয়ার কথা উঠছে। অন্য দেশে নির্বাচন পদ্ধতি পর্যবেক্ষণ করতে গম্ভীর মুখে বিদেশে পাড়ি দেন আমেরিকার প্রতিনিধিরা। এ বার দেখা যাক নিজের দেশে গণতন্ত্র বাঁচানোর ক্ষমতা তাঁদের কতটুকু! সঙ্গে এটাও মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে বাইডেন ক্ষমতায় এলেই মার্কিন দেশে সব সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি মোটেই বার্নি স্যান্ডার্সের মত বামঘেঁষা নন, বরং আলগা ডানদিকে ঝুঁকে থাকে মধ্যপন্থী। ধনতন্ত্রের স্বর্গরাজ্যে কোভিদের কালবেলায় ক্ষমতায় এলে তিনি আমজনতার জন্যে কি করেন সেটা দেখতেই মুখিয়ে আছেন অনেকে। ট্রাম্পকে চেনা হয়ে গেছে। এবার যদি জিতে যান, ভোটের আগে আর ফলপ্রকাশের পরে দুই বাইডেনের মধ্যে তুলনা করাটাও সহজ হবে।

(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত।)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy