গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
বাংলা প্রবাদ বলে ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়’। কোভিড অতিমারির মাঝে আমেরিকায় গত ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সেই বাংলা প্রবাদের সার্থক প্রতিফলন। নির্বাচন যুদ্ধে হার হয়েছে রাজার। কিন্তু হার স্বীকার করতে রাজি নন তিনি। জনগণের নেওয়া সিদ্ধান্তকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ভোট পুনর্গণনা শুরু হয়েছে কয়েকটি রাজ্যে। ফলত, নির্বাচনের পরেও দেশের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত নিয়ে যে টানাপড়েন চলছে, সেই অরাজকতার মাঝে কোভিডে প্রাণসংশয় হচ্ছে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের।
একথা অনস্বীকার্য যে, নির্বাচনের আগেও কোভিড-আক্রান্ত আমেরিকা মোট মৃত্যুসংখ্যায় সারা বিশ্বে প্রথম ছিল। সেটা কার্যত ট্রাম্প শাসনব্যবস্থার ব্যর্থতা। গত পাঁচমাস ধরে ট্রাম্প সরকারের করোনাভাইরাস টাস্ক ফোর্স একরকম অচল অবস্থায় ছিল। কোভিড নিয়ন্ত্রণের সেই অব্যবস্থাই ট্রাম্পের হারের অন্যতম কারণ বলে অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। আমেরিকায় করোনাভাইরাসে মৃত এখন আড়াই লক্ষের একটু বেশি। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নতুন কোভিড প্যান্ডেমিক টাস্কফোর্স তৈরি করলেও তা স্বাভাবিকভাবেই বাধার সম্মুখীন। কারণ, নির্বাচন শেষ হয়েছে বলেই তো স্বীকার করছে না ট্রাম্প সরকার! নিয়মানুযায়ী, নবনির্বাচিত হবু প্রেসিডেন্টকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট। নতুন প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাগ্রহণের শপথ নেন নতুন বছরের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে। ট্রাম্প যেহেতু নির্বাচনের ফলাফল পুরোপুরি মেনে নেননি এবং সে বাবদে ক্ষমতা হস্তান্তরেও নিমরাজি, তাই এই অতিমারির মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা আমজনতার।
সমস্যাটা জটিলতর রূপ নিয়েছে আর একটি কারণে। এর মধ্যেই আমেরিকার ফাইজার এবং মডার্না নামের দু’টি সংস্থা কোভিড ভ্যাকসিন বাজারে আনার জন্য আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ আডমিনিস্ট্রেশান’-এ ‘আপৎকালীন অনুমতিপত্র’ (এমারজেন্সি অ্যাপ্রুভ্যাল অথরাইজেশন) জমা দিয়েছে। দু’টি কোম্পানিরই দাবি— তাদের ভ্যাকসিন ৯০ শতাংশেরও বেশি কার্যকরী। সুতরাং বাজারে ভ্যাকসিন এলে অতিমারির মারণ চেহারা অনেকটাই বদলে যাবে। যদিও ভ্যাকসিন নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষার শেষ পর্যায়ের কার্যকারিতার বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনও কোনও জার্নালে প্রকাশিত হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিকরা আশাবাদী যে, ভ্যাকসিনটি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও মৃত্যুহার রোধ করতে সক্ষম।
ভ্যাকসিন এলেও তার সুষম বণ্টন নিয়ে ঈশান কোণে কালো মেঘের ছায়া দেখছেন অনেকে। —ফাইল চিত্র
আরও পড়ুন: ৭০ শতাংশ কার্যকরী অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা, দাবি
যেহেতু প্রথমেই চাহিদা অনুযায়ী কোটি কোটি ভ্যাকসিন তৈরি করা অসম্ভব, তাই আমেরিকার কোনায় কোনায় কোভিড রুগী, স্বাস্থ্যকর্মী বা বয়স্কদের কাছে যাতে ভ্যাকসিন সর্বাগ্রে পৌঁছয়, তার প্রস্তুতিপর্ব আগে থেকেই নির্ধারিত করা আছে। কিন্তু নির্বাচনের সিদ্ধান্তে আস্থা-হারানো ট্রাম্প সরকারের রাজনৈতিক চাপানউতরে বাজারে ভ্যাকসিন এলেও তার সুষম বণ্টন নিয়ে ঈশান কোণে কালো মেঘের ছায়া দেখছেন অনেকে। ওদিকে, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানানো হয়েছে, আমেরিকায় মৃত্যুহার যেভাবে রকেট গতিতে বাড়ছে, তাতে আগামী বড়দিনের মধ্যে মৃতের সংখ্যা ৩ লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০ জানুয়ারি সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪ লক্ষে। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে চর্চিত চিন্তা— অনুমতি পাওয়ার পর ভ্যাকসিনের সরবরাহ যেন ব্যাহত না হয়। ভ্যাকসিনের সরবরাহ পূর্ব-নির্ধারিত পরিকল্পনায় চললে মৃত্যুসংখ্যা আড়াই লক্ষের আশেপাশে আটকে রাখা সম্ভব হবে।
আরও পড়ুন: সংক্রমণ ঠেকাতে কী ব্যবস্থা, ৪ রাজ্যের কাছে হলফনামা চাইল সুপ্রিম কোর্ট
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, একটি সফল ভ্যাকসিন বাজারে আনতে সাধারণত ১০ থেকে ১৫ বছর সময় লাগে। পাঁচের দশকে মিসেল্স ভাইরাসের ভ্যাকসিন এসেছিল ভাইরাস আইসোলেশনের প্রায় ৯ বছর পর। পোলিও ভাইরাসের ক্ষেত্রে সময় লেগেছিল ২০ বছর! এখনও অবধি সবথেকে তাড়াতাড়ি এসেছে মাম্পস ভ্যাকসিন। তা-ও চার বছর অপেক্ষার পর। সেক্ষেত্রে মাত্র ১ বছরের মধ্যে কোভিড ভ্যাকসিনের ‘সাফল্য’ আমাদের জীববিদ্যা ও বায়ো টেকনোলজির অগ্রগতিকে স্যালুট জানাতেই পারে।
আমেরিকায় বাড়ছে কোভিডে মৃত্যু। —ফাইল চিত্র
প্রসঙ্গত, ফাইজারের ভ্যাকসিনের সীমাবদ্ধতা হল, সেটি প্রায় মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখতে হবে। যা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ বা ভারতের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই অসম্ভব। সেই নিরিখে মডার্নার ভ্যাকসিন সেক্ষেত্রে অনেকটাই আশাপ্রদ (মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেই রাখা যায় )। আবার ফাইজার ইতিমধ্যেই তাদের সরবরাহ চেনের ডিস্ট্রিবিউটরদের সাথে পরিকাঠামো নিয়ে অনেকটা এগিয়ে গেছে । তবে ফাইজার বা মডার্না নির্মিত ভ্যাকসিনের সাফল্যকে ১০০-য় ১০০ দেওয়া এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। কারণ, অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য এখনও জানা বাকি। যেমন ভ্যাকসিনের অনাক্রম্যতা (ইমিউনিটি) কতদিন স্থায়ী হবে বা বিভিন্ন বয়সের সাথে অনাক্রম্যতার রূপ কেমনভাবে বদলাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু একটা ছোটো কাচের শিশির মধ্যে থাকা তরলের সূচ মারফত মানবশরীরে প্রবেশ করার অধিকার যদি হাজারো মানুষের মৃত্যু রোধ করতে পারে, তাহলে সেই শক্তির কাছে মাথা নত হয়ে যায় অজান্তেই। আমেরিকানরাও এর বাইরে নন।
তাই ট্রাম্প এবং তাঁর সরকারের উচিত সসম্মানে হারটি স্বীকার করে প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদের আগামী ৬০ দিন কোভিড অতিমারির শাসনব্যবস্থার কম্পাসের কাঁটা ঘোরানো। আমেরিকার ভিতর ও বাইরে সকলের চোখ এখন ওই কাঁটার দিকেই।
(লেখক ওয়াশিংটনের বাসিন্দা, জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এপিডেমিওলজি বিভাগে গবেষণারত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy