Advertisement
৩০ অক্টোবর ২০২৪
Myanmar Violence

অর্ধেক মায়ানমার ‘মুক্ত’, সেনার নিষ্পেষণ মাত্রাছাড়া

আত্মগোপনকারী সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মী সোয়ে মিন্টের কথায়, এই মুহূর্তে, ২০২৪-এর জুলাইয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি মায়ানমারে। একের পর এক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সেনাশাসক জুন্টা মরিয়া হয়ে উঠেছে।

মায়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীর টহল। মুক্ত এলাকায়।

মায়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীর টহল। মুক্ত এলাকায়। —নিজস্ব চিত্র।

অনমিত্র চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ ০৮:৩৭
Share: Save:

সেনাশাসকদের বিরুদ্ধে মরণপণ প্রতিরোধের লড়াই চলছে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে। সেই গৃহযুদ্ধে মানবিক বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে দেশটির প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ।

আত্মগোপনকারী সাংবাদিক ও নাগরিক অধিকার কর্মী সোয়ে মিন্টের কথায়, এই মুহূর্তে, ২০২৪-এর জুলাইয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি মায়ানমারে। একের পর এক লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সেনাশাসক জুন্টা মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশবাসীর উপরেই বিমান হানা চালাচ্ছে। হতাহতের সংখ্যা ঠিক কত, তার হিসাব রাখারও উপায় নেই।

এমনই এক পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসীর কানে মায়ানমারের বাসিন্দাদের দুর্দশা এবং গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের কথা পৌঁছে দিতে ছাত্রাবস্থায় দুঃসাহসিক পদক্ষেপ করেছিলেন সোয়ে মিন্ট। ১৯৯০-এর ১০ নভেম্বর ব্যাঙ্কক থেকে রেঙ্গুনগামী তাই এয়ারওয়েজ়ের বিমান ছিনতাই করে কলকাতায় এনে নামিয়েছিলেন। সঙ্গী ছিলেন ব্যাঙ্কক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী টিন চ। কলকাতা বিমানবন্দরে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তারা জানতে চান, কোন শর্তে তাঁরা যাত্রীদের মুক্তি দেবেন? সোয়ে জানিয়েছিলেন, কলকাতা বিমানবন্দরে সাংবাদিক বৈঠক করতে দিতে হবে তাঁদের, যেখানে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরাও হাজির থাকবেন।

সেনাদের দখলমুক্ত অজ্ঞাত এলাকা থেকে ইন্টারনেট ফোনে সোয়ে সম্প্রতি বলেন, “জুন্টাদের নির্যাতন যতই তীব্র হোক, কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের কথা ভাবিনি। আমাদের নেত্রী আউং সান সু চি বরাবর বলেছেন, হিংসা গণতন্ত্র আদায়ের পথ হতে পারে না।” সোয়ের কথায়— “আমরা সে দিন বিমানটি আকাশে ওড়ার পরেই পাইলটের কাছে যাই। পাইলটকে জানাই— বিমানের দখল নিচ্ছি, কিন্তু আমাদের সঙ্গে অস্ত্র বা বিস্ফোরক কিছুই নেই। সঙ্গের ‘লাফিং বুড্ডা’ মূর্তিটি শান্তির প্রতীক। যাত্রীদের বলি, কারও ক্ষতি হবে না।” সোয়ে জানান, যাত্রীরা সকলেই দুই কিশোর ছিনতাইকারীর পাশে দাঁড়ান।

এর পরে ভারত সরকারের আশ্রয়ে দিল্লিতে থাকার সময়ে ১৯৯৮-এ ‘মিজ়িমা’ নামে একটি সাময়িকী প্রকাশ শুরু করেন সোয়ে। তাতে নিজের দেশের সেনাশাসক জুন্টার নির্যাতন ও স্বৈরাচারের বিবরণী এবং তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের খবর তুলে ধরতেন তিনি। সেই ‘মিজ়িমা’ গোষ্ঠী এখন এ দেশের অন্যতম প্রধান মিডিয়া সংগঠন। ২০০৩-এ আদালত সোয়ে এবং টিনকে সন্ত্রাসের অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়। ইতিমধ্যে বর্মা পরিণত হয়েছে মায়ানমারে। আইনসভা গঠন ও নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। দেশে ফিরে যান তাঁরা। তবে সোয়ে বলেন, “ওই গণতন্ত্র ছিল লোক দেখানো। আইনসভার যে কোনও সিদ্ধান্তে ভিটো দেওয়ার ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখেছিল সেনারা।”

২০২০-র নভেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে সেনাসমর্থিত দলগুলির প্রার্থীরা প্রায় সকলেই পরাজিত হন। ২০২১-এর ২ ফেব্রুয়ারি ছিল আইনসভার নতুন সদস্যদের শপথের দিন। ঠিক তার আগের দিন ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে মায়ানমারের সামরিক বাহিনী তাতামাদো (বর্মি উচ্চারণে তাতামাদঅ)। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পরে নভেম্বরের নির্বাচনকে বাতিল ঘোষণা করে সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর নেতৃত্বাধীন সামরিক জুন্টা। সাজানো বিচারে দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী সু চি এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে। তার পরে নিশানা করা হয় সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক দলগুলিকে। সোয়ে জানাচ্ছেন, সেনাশাসনের বিরুদ্ধে কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করলেই তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।

তিন বছরে ইরাবতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। জুন্টার বজ্রআঁটুনি কি এতটুকু শিথিল হয়নি? সোয়ে বলেন, “আরও কঠিন হয়েছে। গুম ও খুন বেড়েছে। তবে রাজধানী নেপিদ এবং ইয়াঙ্গন শহর বাদে প্রায় সর্বত্র এখন তাতামাদোর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধ। এই মুহূর্তে দেশের অর্ধেকটাই প্রতিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে।
মানুষ সেনাশাসকদের আর গুরুত্ব দিচ্ছেন না।”

সোয়ে বলেন, “সেনারা গণতান্ত্রিক পরিসর না-রাখায় নিরুপায় হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধে নামতে হয়েছে মানুষকে। একশোরও বেশি প্রতিরোধ বাহিনী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তাদের রাজনীতি, মত, পথ আলাদা হলেও এখন অভিন্ন কর্মসূচি— তাতামাদোর উৎখাত।”

ঘর সামলাতে চিনের দ্বারস্থ তাতামাদোর জুন্টা (স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল)। তাদের ডাকে চিন সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে, জুন্টাদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছে। তবে তাতে কর্ণপাত করেনি প্রতিরোধ বাহিনীগুলি। এখন ফের চিনে গিয়েছেন জুন্টা-প্রতিনিধি। আর নিজেদের মধ্যে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করেছে প্রতিরোধ বাহিনীগুলি, উদ্দেশ্য মুক্তাঞ্চলকে কী ভাবে ফেডেরাল স্টেট হিসেবে ঘোষণা করে তা টিকিয়ে রাখা যায়।

(চলবে)

অন্য বিষয়গুলি:

Myanmar Myanmar Army Myanmar Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE