বাংলাদেশের সর্বত্র পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন এমন ব্যাপক এক চরিত্র অর্জন করেছে, শাসক দলের পরিবর্তন তাতে মৌলিক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে না। তার মানে এই নয় যে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনে দিন বদলের ইতিহাস প্রভাবই ফেলে না। গত বছরের অগস্টের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে প্রতিবাদী জনতা এবং সরকারের মধ্যে পাঁচ সপ্তাহব্যাপী দ্বন্দ্বের যে সহিংস রূপ দেখেছি এবং যার উত্তাপ এখনও অনুভব করা যায়, তার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই ভেবেছেন যে, এ বার হয়তো নববর্ষ উদযাপন আগের মতো হবে না। কিন্তু দৃশ্যত তা ঘটেনি।
তবে এমন একটা বিবৃতি সব কথা বলে না।
পাকিস্তান আমলে বিশেষত গত শতাব্দীর ষাট-এর দশকে ছায়ানট-এর উদ্যোগে যখন রমনার বটতলায় পহেলা বৈশাখ পালনের ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়, তা ছিল সেই সময়ে বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের এক সাংস্কৃতিক রাজনীতি। ১৯৭৫ সালে অগস্ট মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর এই উৎসব উদযাপনে রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রভাব চোখে পড়ে। এই বছর যখন নতুন অন্তর্বর্তী অরাজনৈতিক সরকার ক্ষমতাসীন, তখনও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বলয় থেকে এই উৎসব মুক্ত হতে পারেনি।
সেই পাকিস্তানি আমলে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের সময় থেকে প্রধান যে আপত্তি ছিল বা আছে তা হল এটি প্রধানত ‘হিন্দুয়ানি উৎসব’। আর বিগত কয়েক বছরে এই দেশে ইসলামি চিন্তার বিস্তারে সক্রিয় রাজনৈতিক দল, তাদের সাংস্কৃতিক শাখা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সব সংগঠন উদারতাবাদী সমাজভাবনারও প্রবল বিরোধী। সোমবারের সংবাদপত্রেও এমন একটি খবর ছাপা হয়েছে। যেখানে এমন একটি সংগঠন নববর্ষ পালনের বিপরীতে ‘তৌহিদবাদী সংস্কৃতির দিকে ফিরে আসার আহ্বান’ জানাচ্ছে। এমনই এক সংগঠনের বোমা হামলায় ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে কয়েক জন নিহত এবং অনেকেই আহত হয়েছিলেন। এক দশকের বেশি সময় পার হলেও তার বিচার হয়নি।
এ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আর্ট কলেজ থেকে একটি বর্ণিল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। এর প্রাথমিক নাম আনন্দ শোভাযাত্রা হলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অভিব্যক্তিতে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৪৩২ সালের পহেলা বৈশাখের ঠিক আগে এই নাম ‘মঙ্গল’ থেকে ‘আনন্দ’-এ ফিরে আসে। মঙ্গল কথাটিকে রাজনৈতিক ভাবে বিচার না করে এর মধ্যে হিন্দুয়ানির গন্ধকেই চিহ্নিত
করা হয়।
এ বার যাঁরা এই শোভাযাত্রা সংগঠনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তাঁরা ক্ষমতাসীনদের তুষ্ট করতে শোভাযাত্রায় এমন সব অনুষঙ্গ ব্যবহার করতে চেয়েছেন যাতে শেখ হাসিনার প্রতি প্রবল প্রত্যাখ্যান জানানো যায়। নাম না করে পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীকে এবং আওয়ামী লীগকে ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অত্যন্ত শক্তিশালী সামাজিক চর্চা বাংলাদেশে চলছে। তাই এ বার নববর্ষ উদ্যাপনে রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেক বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। নববর্ষ উদযাপনে ছায়ানটের অনুষ্ঠান (যা শুরু সকাল ৬টায়) সংবাদপ্রচারে এ পর্যন্ত প্রাধান্য রাখলেও এ বার প্রায় সব ক’টি টিভি চ্যানেলে প্রথমেই আনন্দ শোভাযাত্রার (যা শুরু সকাল ৯টায়) সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করা হয়। বাঙালির জীবনের এই সর্ববৃহৎ উৎসবকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করার জন্য কোনও প্রধান রাজনৈতিক সংগঠনই পিছিয়ে থাকেনি। শুধু আওয়ামী লীগ ছাড়া। এই দলটি এখন ভীতবিহ্বল। বিএনপি বৈশাখী মেলা, মিছিল করেছে এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচিকেই এগিয়ে নিতে চাইছে।
এ বার অন্তর্বর্তী সরকার প্রত্যক্ষ ভাবে নববর্ষ উদ্যাপনে উদ্যোগী হয়েছে। সরকারের সহযোগিতা নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে সেখানে সরকারবিরোধী অবস্থান নেওয়া বা বিবৃতির অবকাশ থাকে না। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতেই হয়। প্রচ্ছন্ন ভাবে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার উদ্দেশ্য থাকলেও দেশের বাঙালি ছাড়া অন্যান্য যে সব নৃগোষ্ঠী রয়েছে, তাদেরও সরকারি সাহায্যে নববর্ষ পালনে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এবং এ বিষয়ে সরকারি মুখপাত্ররা কৃতিত্বও জাহির করেছেন। সরকারপ্রধান জাতির উদ্দেশে চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন এবং সেখানেও রাজনৈতিক অনুষঙ্গ উপেক্ষা করা যায় না।
নববর্ষ উদ্যাপনের বিষয়টিকে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃজনে ব্যবহার করা হয়েছে। এ বার সর্বত্রই যাতে এই উৎসব উদযাপিত হয় সে জন্য সরকারের দিক থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার ভবনের সামনে উন্মুক্ত সড়কে আধুনিক এবং যার মধ্যে বাঙালিয়ানা হয়তো অতটা পাওয়া যাবে না তেমন কনসার্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বোধ করি, এ বারই প্রথম বাংলাদেশের ঢাকার বৃহদায়তন কারাগারে এবং আঞ্চলিক ভিত্তিতে অন্যান্য কারাগারের মধ্যেও বন্দি এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মিলে নববর্ষের মিছিল করেছেন। এ বারই প্রথম সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সংবাদপত্রে এক পৃষ্ঠাব্যাপী ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে।
কবি ফরহাদ মজহার লিখেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতি সরলরৈখিক কালকেন্দ্রিক না, ঋতুকেন্দ্রিক।’ এই উচ্চারণের মাধ্যমে আমরা যেন রবীন্দ্রনাথের কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। তাই মনে এই বিশ্বাস গভীর ভাবে প্রোথিত যে, কোনও শাসকগোষ্ঠী নববর্ষের মতো সামাজিক উৎসবকে মালিকানায় নেওয়ার চেষ্টা করলেও বাঙালি নিজের মৃত্তিকালগ্ন জাতীয় পরিচয়কেই তুলে ধরবে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)