শ্বেতলানা আলেক্সিভিচ
খেতের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। চারপাশে শুধু মৃতদেহ আর মৃতদেহ। শয়ে শয়ে। কারও কপালে গুলি, কারও বা থেঁতলানো হাত-পা। কারও বয়সই ১৯-২০-র বেশি হবে না। তার মধ্যেই একটা দেহ একটু যেন নড়ে উঠল। পাশে পড়েছিল তারই রাইফেল। তুলে নিয়ে বেয়নেটটা ঢুকিয়ে দিলাম ছেলেটার পেটে। আমাদের দেশ লুঠতে এসেছিল যে!
এক নাগাড়ে বলে চলেছেন এক রুশ বৃদ্ধা। আর টেপ রেকর্ডার হাতে সেই কথা শুনছেন এক সাংবাদিক। বয়স তিরিশের কোঠায়। সাংবাদিক ভাবছেন, এ সব কথা লেখা যাবে তো আমাদের পত্রিকায়? যে যুদ্ধ নিয়ে আমাদের এত গর্ব, তার এই ভয়ঙ্কর চেহারাটা কী করে আমি পৌঁছে দেব পাঠকের কাছে?
পাঠকের কাছে ‘অন্য রকম খবর’ পৌঁছে দেওয়ার কাজটা আদপেই সহজ হয়নি সে দিনের সেই সাংবাদিকের পক্ষে। শ্বেতলানা আলেক্সিভিচ। ২০১৫-র সাহিত্যে নোবেলজয়ী।
১৯৪৮ সালে ইউক্রেনের স্ট্যনিস্লাভ শহরে জন্ম শ্বেতলানার। বাবা বেলারুসের লোক, মা ইউক্রেনের মেয়ে। বেলারুসের মিনস্ক শহরেই পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা। কয়েকটা খবরের কাগজে সাংবাদিকতা করার পরে চাকরি পান নামজাদা ‘নেমান’ পত্রিকায়। সেই পত্রিকাতেই এক ধারাবাহিক লেখার জন্য শুরু করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বামী-সম্তানহারাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া। তাঁদের মুখে যা শুনলেন, তা লিখে ফেললেন চটপট। কোনও কাটছাঁট না করেই।
প্রথমেই জুটল পত্রিকার সম্পাদকের দাঁত খিচুঁনি— ‘কী সব ছাঁইপাশ লেখেন! বানিয়ে বানিয়ে, সব আষাঢ়ে গপ্পো!’ তার পর এসে পড়ল খোদ সরকারের কোপ। প্রাক-পেরেস্ত্রোইকা সোভিয়েত রাশিয়ায় এমন কিছু বিষয় নিয়ে মুখ খোলা সম্ভব নয়, যা ‘মাদার রাশিয়া’র মহান ভাবমূর্তি কোনও ভাবে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। রুশ মেয়েরা তো দয়ালু মা, স্নেহশীলা স্ত্রী, কোমল স্বভাবের বোন। তারা কী করে রাইফেল তুলে নেয়? বেয়নেট ঢুকিয়ে দেয় শত্রুর পেটে? ফলে যা হওয়ার, হলো। প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন শ্বেতলানা।
উদ্বাস্তু লেখক-শিল্পীদের পাশে দাঁড়ায় এমন এক সংস্থার সাহায্যে মাতৃভূমি ছাড়েন শ্বেতলানা। পরের এগারো বছর কিছু দিন প্যারিস, তো কিছু দিন বার্লিন। তত দিনে অবশ্য রাশিয়ায় পটপরিবর্তন হয়েছে। ক্রেমলিনে গ্লাসনস্তের খোলা হাওয়া বয়েছে। যুদ্ধের বিধবাদের নিয়ে শ্বেতলানার যে বইয়ের পাণ্ডুলিপি ফিরিয়ে দিত একের পর এক প্রকাশক, সেই বই ছাপা হয়ে ২০ লক্ষ কপি বিক্রি হয়ে গিয়েছে। শুধু রুশ ভাষাতেই। ‘ওয়ারস আনওম্যানলি ফেসেস’ বা ‘যুদ্ধের অ-মেয়েলি মুখ’ নামের সেই বইটি সম্বন্ধে আজ নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘‘যন্ত্রণা আর লড়াইয়ের আশ্চর্য এক আখ্যান।’’
সাহিত্যে নোবেল সাধারণত পান গল্পকার-ঔপন্যাসিক-নাট্যকার-কবিরা। নন-ফিকশন ঘরানায় লিখে নোবেল পাওয়ার নজির বেশ কম। সেই ১৯৫৩ সালে তাঁর ব্রিটিশ ও দু’টি বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসের জন্য নোবেল পেয়েছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল। সাংবাদিকদের নোবেল পাওয়ার ঘটনাটি আরও বিরল। ১৯৫৪ সালের নোবেলজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে প্রথম জীবনে সাংবাদিকতা করেছেন। এ ছাড়া, শ্বেতলানা চতুর্দশ মহিলা সাহিত্যিক যিনি এই খেতাব পেলেন। সাহিত্যে নোবেলজয়ী পুরুষের সংখ্যা অবশ্য ১০৭!
পরের বইও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘বেঁচে থাকাদের’ নিয়ে— ‘দ্য লাস্ট উইটনেসেস’। এ বার শিশুদের কথা। তাদেরই মুখে। পরের বইও শিশুদের নিয়ে। নাম ‘জিন্কি বয়েজ’। সেটা কি?
জিঙ্ক, অর্থাৎ দস্তা। এই দস্তার কফিনে করেই আফগানিস্তান থেকে রুশ সেনাদের দেহ ফেরত আসত। যে সব সেনার অধিকাংশ নেহাতই কিশোর। ছেলে-হারা রুশ মা-বাবাদের সঙ্গে কথা বলেই এই বই লিখেছিলেন শ্বেতলানা।
যে ধাঁচে লেখেন শ্বেতলানা, নিজেই তার নাম দিয়েছেন ‘নভেল-কোরাস’। বহুস্বরের উপন্যাস। রক্ত-মাংসের মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁর লেখা সাজান সাংবাদিক। ইতিহাস রচনার এমন এক কাঠামো অনুসরণ করেন, যা নিতান্তই মৌখিক। কোনও সময় বা দেশের ইতিহাস বুঝতে সাধারণ মানুষের মুখের কথাকে এখন যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুঁথি-নির্ভর ইতিহাসের পাশেই তাই স্বমহিমায় জায়গা করে নিয়েছে ‘ওরাল হিস্ট্রি’। শ্বেতলানাকে সাহিত্য খেতাব দিয়ে আজ সেই ‘মৌখিক ইতিহাস’কে নতুন সম্মান দিল নোবেল কমিটি।
এখন কী লিখছেন? ৬৭ বছরের নোবেলজয়ীকে আজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা সাংবাদিকেরা। অল্প হেসে শ্বেতলানা বললেন, ‘‘এত দিন যুদ্ধ নিয়ে লিখেছি। এ বার লিখছি প্রেমের গল্প। আমার, আপনার মতো সাধারণ মানুষের ভালবাসার কাহিনী।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy