শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ঢুকে পড়েছেন বিক্ষোভকারীরা। বুধবার কলম্বোয়। রয়টার্স
আজ যদি আমাকে রাতে গাড়ি চালিয়ে দূরে যেতে বলেন, আমি কিন্তু ভয় পাব।
ছ’বছর ধরে কর্মসূত্রে শ্রীলঙ্কায় আছি। এত দিন স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে স্রেফ গুগল ম্যাপ হাতে করে অসম্ভব সুন্দর এই দ্বীপরাষ্ট্র চষে বেড়িয়েছি। দিনে-রাতে গাড়ি চালিয়েছি। কিন্তু এখন আর সেই সুখের সময় নয়। এ দেশের বহু ছাপোষা মানুষের হাতে দু’মুঠো খাবার কেনার পয়সা নেই। তাই তারা অনেকেই নাকি ছিনিয়ে খাচ্ছেন। কোনও দেশের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে সরকারের গোটা কাঠামো ভেঙে পড়লে এমনই হয়। হতদরিদ্র আম আদমির ভিড়ে মিশে যায় দুষ্কৃতীরাও। খবর পাচ্ছি, প্রত্যন্ত এলাকায় চুরি-ছিনতাই বেড়ে গিয়েছে। কে আর ঝুঁকি নেবে?
কলকাতার গড়িয়ায় আমার বাড়ি। এখানে যে কলম্বো-২ ইউনিয়ন প্লেস এলাকায় থাকি, প্রধানমন্ত্রীর দফতর-সহ গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবনগুলো তার থেকে খুব দূরে নয়। সাম্প্রতিক বিক্ষোভের জমায়েতমুখী কিছু রাস্তা এ দিক দিয়েও গিয়েছে। তাই বাড়ির ২৪ তলার জানলা দিয়ে মাঝেমধ্যে আমারও চোখে পড়ে কিছু টুকরো ছবি। রাষ্ট্রপতির সচিবালয় যেখানে, সেই গল ফেস এলাকায় বেশ কিছু দিন ধরেই দেশের নানা এলাকা থেকে আসা প্রতিবাদীরা ভিড় জমাচ্ছিলেন। আজ ওই দিকে কাঁদানে গ্যাস উড়তে দেখেছি। আকাশে ঘুরছিল হেলিকপ্টার। গত মে মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষে ইস্তফা দেওয়ার পরে সরকারপন্থীদের সঙ্গে প্রতিবাদীদের খণ্ডযুদ্ধ বেধেছিল। তখন দেখেছিলাম, রাস্তায় বাস জ্বলছে। আমাদের বাড়ির কাছেই বেইরা লেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আস্ত গাড়ি।
আমার নিজের গাড়িতে খানিকটা তেল ভরে সেটাকে আপাতত গ্যারাজেই বসিয়ে রেখেছি। কারণ, এ দেশে জ্বালানি তেলের লিটার-পিছু দাম তিন হাজার টাকা ছুঁয়েছে। তাই খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি ব্যবহারের প্রশ্ন নেই। অফিস তো যেতেই হবে। অফিস থেকে একটা ভ্যান পাঠিয়ে আমাকে এবং অন্য সহকর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদের বিল্ডিংটা আধুনিক বলে এখানে সটান স্টোরেজ থেকে পাইপলাইনে করে রান্নার গ্যাস ফ্ল্যাটে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। এটা না হলে সমস্যা ছিল। এ দেশে এখন একটা এলপিজি সিলিন্ডারের তো তিরিশ হাজার টাকাও দাম উঠেছে!
দিনে তিন-চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, ওষুধ নেই। সরকারি সাহায্যে চলা অনাথ আশ্রমগুলোর দুর্দশা চরমে। আমরা কলম্বোর বিদেশিরা এখানে একটা সাংস্কৃতিক সংগঠন চালাই। চেষ্টা-চরিত্র করে আমরা কলকাতা থেকে জাহাজে প্রায় ৩০০ টন চাল-ডাল-আলু আনাতে পেরেছি। তাতে প্রায় ১০,৬০০ বাচ্চা অন্তত তিন মাস খেতে পারবে।
এর মধ্যেই আমার ক্লাস এইটে পড়া মেয়ের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার মনে হয়, বিক্ষোভকারীরা চূড়ান্ত আন্দোলনে ঝাঁপানোর আগে স্কুল-কলেজের পরীক্ষাগুলো শেষ হওয়ার অপেক্ষা করছিলেন। মে মাসের ওই সংঘর্ষের পরে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের ইস্তফার দাবিতে অনড় হয়ে বসেন তাঁরা। গোতাবায়া গা-ঢাকা দেওয়ার পর থেকে তো তাঁর প্রাসাদের দরজা হাট করে খোলা। সেনাবাহিনীও জানে, প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ দখল করতে আসা লক্ষ মানুষের ভিড়কে ঠেকাতে গেলে রক্তস্রোত বইবে।
কিন্তু আসল সমস্যার কী হবে? যা বুঝছি, আরও দু’-এক বছরের আগে আর্থিক সঙ্কটের হাত থেকে শ্রীলঙ্কার পুরোপুরি রেহাই নেই। আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডারের সঙ্গে অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে কিছু কথাবার্তা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন শ্রীলঙ্কায় একটা কাজ-চালানোর মতো সরকার তৈরি হলেও তারা কোনও সাহসী পদক্ষেপ করবে বলে আমার মনে হয় না।
(লেখক একটি ভারতীয় সংস্থার বিভাগীয় প্রধান)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy